কক্সবাংলা রিপোর্ট :: কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে এলপিজি (লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয় ২০১৯ সালের মে মাসে। এ প্রকল্পের পরামর্শক, বিনিয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে বিলম্ব ও বিনিয়োগ প্রস্তাবের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এখনো প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে সরকারের বৃহৎ এ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন। এতে করে একদিকে যেমন পণ্যটির পরিবহন খরচ সাশ্রয়ী হবে, তেমনি গ্রাহকরাও কম দামে এলপিজি কিনতে সক্ষম হবেন।
অন্যদিকে এটি নির্মাণে যতদিন বিলম্ব হবে, সব পর্যায়ের গ্রাহককেও ততদিন বেশি দাম দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ব্যবসায়ী ও গৃহস্থালি পর্যায়ে এলপিজি সাশ্রয়ী করার জন্যই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশে বর্তমানে ১০ লাখ টন এলপিজির চাহিদা তৈরি হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে দ্বিগুণে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করা গেলে এ চাহিদার পুরোটাই সাশ্রয়ীভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে প্রকল্প নির্মাণে বিলম্ব হলে এলপিজি ব্যবহারের জন্য সব পর্যায়ের গ্রাহককেই আরো বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হতে পারে।
এ বিষয়ে এলপিজি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোম্যাক্সের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) ফিরোজ আহমেদ বলেন, এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ যত দ্রুত শেষ হবে, দেশে এলপিজির দাম তত দ্রুত সাশ্রয়ী হবে। একই সঙ্গে এলপিজির বাজার প্রসারিত হবে। তবে দ্রুত না হলে গ্রাহককে বর্তমান বাজার অনুযায়ী এলপিজি ক্রয় করতে হবে।
আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ীতে ৫০ হাজার টন এলপিজি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন টার্মিনাল নির্মাণে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে সরকার। চলতি মাসে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে বিপিসি। চলতি মাসে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগকারীদের প্রস্তাব বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারেনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ (ইএমআরডি)।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও জ্বালানিসংশ্লিষ্টদের সমালোচনার মুখে সেটির অগ্রগতিও থমকে গিয়েছে। মাতারবাড়ীতে টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশী তিনটি কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবনাও এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আলোচনার টেবিলে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাতারবাড়ীতে নির্মীয়মাণ গভীর সমুদ্রবন্দরে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পেতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে জাপানি তিন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তিন কনসোর্টিয়াম। দেড় বছর ধরে কোম্পানিগুলো ইএমআরডি ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে আসছে।
তবে কনসোর্টিয়াম নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ নীতিমালা না থাকায় এ উদ্যোগ বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে টার্মিনালের মালিকানা বণ্টন নিয়েও রয়েছে বেশকিছু জটিলতা।
বিপিসির চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক বলেন, টার্মিনাল নির্মাণে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সবার প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যাদের প্রস্তাব যৌক্তিক ও দেশের স্বার্থে লাভজনক হবে, সেটাকেই বিবেচনায় নেয়া হবে।
তিনি বলেন, এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে কোন কোম্পানির কী ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, আমরা সেটা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি। শুধু অভিজ্ঞতা থাকলেই হবে না, টার্মিনাল নির্মাণে
আমাদের একটা শেয়ার থাকবে, তারা কতটুকু আমাদের সেই শেয়ার দেবে, সেটা নিয়েও পর্যালোচনা চলছে। এছাড়া টার্মিনাল নির্মাণে তাদের ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, সেটিও আমরা জানতে চেয়েছি।
তবে জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ নীতিমালা প্রয়োজন। যেটি এখনো করা হয়নি। ফলে এসব কোম্পানির অভিজ্ঞতা যাচাইয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
ইএমআরডি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালের মে মাসে জাপানি কোম্পানি মিতসুইর নেতৃত্বে কোরীয় কোম্পানি এসকে গ্যাস ও দেশীয় কোম্পানি ইস্ট কোস্ট গ্রুপকে নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। এরপর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি দেয় জাপানের মারুবেনি করপোরেশন ও নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ভিটলকে নিয়ে গঠিত দ্বিতীয় আরেকটি কনসোর্টিয়াম। জাপানি কোম্পানি সুমিতোমো করপোরেশনের নেতৃত্বে তৃতীয় আরেকটি কনসোর্টিয়ামও এ প্রকল্পে কাজের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে।
এর মধ্যে মিতসুই গ্রুপের নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে জ্বালানি বিভাগের সম্ভাব্য একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা বহুদূর অগ্রসরও হয়েছিল। এমন এক পর্যায়ে ২০১৯ সালের শেষদিকে দ্বিতীয় প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে মারুবেনি করপোরেশন ও ভিটলের কনসোর্টিয়ামটি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের এলপিজি সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকলেও গভীর সমুদ্রবন্দরে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এর মধ্যে সুমিতমোর নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামটি টার্মিনাল নির্মাণের তৃতীয় প্রস্তাব দেয়।
বিপিসির একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে, মিতসুই বিপিসির কাছে ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগের জন্য একটি প্রস্তাব দিয়েছিল, যেখানে টার্মিনালে বিপিসিকে ৩০ শতাংশ মালিকানা দেয়ার কথাও বলা হয়। বিপিসিকে ৩০ শতাংশ মালিকানা দেয়ার প্রস্তাব দেয় মারুবেনিও।
তিন কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবের বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে বিপিসির শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যে তিনটি কোম্পানি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে, এসব কোম্পানির বিষয়ে আমরা আশাবাদী নই। এসব কোম্পানি কোয়ালিফাই করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দ্রুত করার লক্ষ্যে পরামর্শক নিয়োগ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় পড়েছে বিপিসি।
এ বিষয়ে জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাওয়ার সেল বিদ্যুত্সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তাদের জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট কাজে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। ফলে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টিও ঝুলে রয়েছে।
Posted ৩:২৯ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta