মোসলেম উদ্দিন,উখিয়া :: কক্সবাজারের উখিয়ার ১৮ নং ক্যাম্পে শুক্রবারের নৃশংস ৬ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একপ্রকার নির্বাক হয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। লোকজন ঘর থেকেও তেমন বের হচ্ছে না। এদিকে ঘটনার পর ক্যাম্পে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। তবে ঘটনাস্থল ও সংলগ্ন ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ এপিবিএন পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো কিছু জানানো হয়নি।
তবে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের হামলায় শুক্রবার (২২ অক্টোবর) ভোরে তিন মাদ্রাসা শিক্ষক ও একজন ছাত্রসহ ছয় রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনায় নিহত মাদ্রাসাছাত্র আজিজুল হকের বাবা নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে শনিবার রাতে ২৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০ জনকে আসামি করে উখিয়া থানায় মামলা করেন। আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে।’
উখিয়ায় থাইনখালী আশ্রয়শিবিরে থাইনখালী শিবিরে গিয়ে দেখা গেছে, সড়ক ও অলিগলিতে চেকপোস্ট বসিয়ে টহল দিচ্ছে পুলিশ। ভেতরে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। এ সময় শিবিরের রাস্তাঘাটগুলো ফাঁকা, দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়। ছয় হত্যাকাণ্ডে ১০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
এই ছয় মাদ্রাসাশিক্ষক-ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবীকে হত্যার পেছনে চারটি কারণ তুলে ধরেছেন রোহিঙ্গা নেতারা। এগুলো হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ১৫০টির বেশি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রোহিঙ্গাদের গড়া পৃথক দুটি সংগঠন ‘উলামা কাউন্সিল’ ও ‘ইসলামী মাহাস’ নেতাদের মধ্যে বিরোধ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে-বিপক্ষে মতবিরোধ, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা নিয়ে দুই সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিরোধ। এর রেশ ধরে মাদ্রাসায় হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে শনিবার দুপুর ১টায় ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার (এসপি) নাঈমুল হক সংবাদ সম্মেলন করে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঘটনার বিস্তারিত জানান। শনিবার ভোর চারটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
আশ্রয়শিবিরের প্রতক্ষ্যদর্শী রোহিঙ্গারা জানান, ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ/৫২ ব্লকের দারুল উলুম নাদাওয়াতুল উলামা আল ইসলামিয়া মাদরাসায় হামলা করে আরসার শতাধিক সন্ত্রাসী। গভীর রাতে গ্রুপভিত্তিক হয়ে অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘটনাস্থল মাদ্রাসার তিন দিকে অবস্থান নেয় সন্ত্রাসীরা।
তাদের অভিযোগ, ২০-২২ সদস্যের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প জিম্মাদার কে/১৪ ব্লকের মোহাম্মদ বাছেরের ছেলে মৌলভী আকিজ ওরফে মৌলভী অলি (৪০)।
এ হামলায় অপর একটি গ্রুপের ৪০-৪৫ জনের নেতৃত্ব দেয় ৯ নম্বর বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি/৬ ব্লকের আব্দুল্লাহের ছেলে ডা. নুর কলিম ওরফে ওয়াক্কাস (৪০)। একই হামলায় তৃতীয় গ্রুপের ৪০-৪২ জনের নেতৃত্ব দেয় ৮ নম্বর বালুখালী /ইস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি/৪৪ ব্লকের মৌলভী জমির হোসেন ওরফে মৌলভী দিলদার হোসেন ওরফে মৌলভী আবু বক্কর (৪৫)।
এদের মাস্টার মাইন্ড বা অপারেশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কুতুপালং ৫ নম্বর ক্যাম্পের আরসা নীতিনির্ধারক জিয়াউর রহমান ও একই ক্যাম্পের জি/৫২ নং ব্লকের মৌলভী আবদুল জলিল। মাদরাসায় হামলায় অংশ নেওয়া আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি বা আরসার নেতৃস্থানীয়রা ঘটনার পরপর শুক্রবার ভোরে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এসব নেতৃস্থানীয় হামলায় অংশগ্রহণকারীরা বালুখালী ১১ নং ক্যাম্প হয়ে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী ও রাহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার পালিয়ে যায়। সীমান্তের বালুখালী, ধামনখালী, রাহমতের বিল ও আঞ্জুমানপাড়ার বিপরীতে নো ম্যান্স ল্যান্ডের মিয়ানমার অংশে গিয়ে আত্মগোপন করে রয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
সীমান্তের মিয়ানমার অংশের তুমব্রু লাওয়া, নাইছাডং, চাকমারকূল নো ম্যান্স ল্যান্ডে নাফ নদীর তীরে আরসার অস্থায়ী ঘাঁটি রয়েছে। মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যায় অংশ নেওয়া সন্ত্রাসীরাও সেখানে অবস্থান করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আরসার নীতিনির্ধারকেরা সীমান্তের তুমব্রু জিরো পয়েন্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া থেকে পার্বত্য রেজুপাড়া অংশের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়ান।
এই ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডের মিয়ানমার অংশে কিছু রোহিঙ্গার অবস্থানের তথ্য আমার পেয়ে থাকি। অংশটি যেহেতু মিয়ানমারের, তাই ওখানে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে ক্যাম্প থেকে চুরি করে কিছু রোহিঙ্গা নিয়মিত ইয়াবা পাচারে মিয়ানমার যাতায়াত করে থাকে। বিজিবি এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীকে প্রতিনিয়ত আটক করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে ডজনেরও বেশি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। গুরুতর অপরাধের পেছনের তাদের হাত থাকে। সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড থেকেই এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয় বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।
২০১৭ সাল ও এর আগে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন দুই উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সীমান্তের ব্যবধান আধ থেকে এক কিলোমিটার। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুম, অস্ত্র, স্বর্ণ, মানব ও মাদক পাচারের নিরাপদ জোন হিসেবে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা ব্যবহার করছে সীমান্তের জিরো পয়েন্ট বা নো ম্যান্স ল্যান্ডকে।
হয়।
Posted ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta