কক্সবাংলা রিপোর্ট :: কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ শীর্ষক মেগা প্রকল্পের পুনঃদরপত্র প্রক্রিয়াতেও সক্রিয় সেই পুরনোরাই। এর আগে যাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে টেন্ডারটি বাতিল হয়েছিল তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি অন্যত্র সরিয়েও দেয়া হয়নি। ফলে আগের প্রকল্প পরিচালকসহ অন্য অনেকেই এর সঙ্গেই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
এ নিয়ে মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এর আগে দরপত্র বাতিল করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর আগে মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার রিপোর্টের ভিত্তিতে লঘু ভুলের জন্য এ প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) আমিনুল হাসিবকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি ছিল ইতোমধ্যে সেটি ভুলও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি চাকরি ফিরে পাননি। অথচ ২ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে প্রথম দফায় ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও খোদ প্রকল্প পরিচালক এখনও বহাল আছেন।
অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্প পরিচালক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ আমলা হওয়ায় তিনি আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তার হাত দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে প্রথম দফায় দাখিলকৃত টেন্ডারের সব ধরনের কার্যক্রম। এ ঘটনার জন্য তাকে শোকজ পর্যন্ত করা হয়নি।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসাধু কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সরানো হয়নি, ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে পুনঃদরপত্রকরণ প্রক্রিয়াতেও সেই একই কুশীলবরা সক্রিয়। এ অবস্থায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এবং দরপত্রে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলো আবারও একই দুর্নীতির আশঙ্কা করছেন।
তাদের বক্তব্য, যদি এ দফায় কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এ মেগা প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, আগে খুব বেশি অনিয়ম হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে আরও বেশি স্বচ্ছ করার জন্য টেন্ডার বাতিল করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, যেহেতু বড় অনিয়ম হয়নি তাই পুরনোদের সরানো হয়নি। তারা অভিজ্ঞ সে বিবেচনাতেই বহাল আছেন। তবে একটি কোম্পানিকে কেন রেসপন্সিভ করা হয়েছিল তা নিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে প্রশ্ন উঠেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সম্প্র্রতি বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। এর ফলে বিমানবন্দরের বর্তমান ৯ হাজার ফুট দীর্ঘ রানওয়েকে মহেশখালী চ্যানেলের দিকে ১৭শ’ ফুট সম্প্রসারিত করে ১০ হাজার ৭শ’ ফুটে উন্নীত করা হবে। কিন্তু উন্নয়নমূলক প্রকল্পে জালিয়াতি এবং দরপত্র মুল্যায়নে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়। এ কারণে মন্ত্রিসভা কমিটি প্রকল্পটির প্রথম টেন্ডার বাতিল করে পুনঃদরপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইতোমধ্যে দ্বিতীয় দফায় টেন্ডারও আহ্বান করা হয়েছে। ১ অক্টোবর পুনঃদরপত্র উন্মুক্ত করার কথা আছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, পুনঃদরপত্র প্রক্রিয়ায়ও আগের সব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কুশীলবরাই দায়িত্বে রয়েছেন।
প্রথম দফায় ১০টি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র জমা পড়ে। পরে দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বেবিচকের মূল্যায়ন কমিটি চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। ২৫ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে দরপত্রটিতে নানা অনিয়ম ও ভুল ধরা পড়ে।
এ কারণে বিষয়টি যাচাই এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা তদন্তে দরপত্রগুলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পাঠানো হয়। আইএমইডির অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, রেস্পন্সিভ দরদাতা সিআরসিসি হারবারের অভিজ্ঞতার সনদে কারও স্বাক্ষর নেই।
স্বাক্ষরবিহীন এ সনদে চীনের গুয়ানজু প্রদেশে একটি প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য চুক্তির তারিখ উল্লেখ করেছেন ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর। কিন্তু কাজ শুরুর প্রকৃত তারিখ উল্লেখ করেছে ২০১১ সালের ১৮ নভেম্বর। অর্থাৎ চুক্তির তিন বছর আগেই কাজ শুরু করছিল প্রতিষ্ঠানটি।
আবার কাজ শেষ করার তারিখ দেখানো হয়েছে ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর। কিন্তু সম্পন্ন কাজ হস্তান্তরের তারিখ দেখানো হয় ২০১৫ সালের ১৮ জুন। অর্থাৎ, কাজ শেষ করার প্রায় ১.৫ বছর আগেই সম্পন্ন কাজ হস্তান্তরের দাবি করেছে সিআরসিসি হারবার।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার নির্দেশে আইএমইডিতে পাঠানো কাগজপত্রেও ‘টেম্পোরারি কন্সট্রাকশন কন্ট্রাক’র সপক্ষে কোনো দলিল ছিল না। অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত ইংরেজি অনুবাদের যেসব কাগজ সংযুক্ত করা হয়েছে সেখানে চায়না বা বাংলাদেশের কোনো নোটারি পাবলিক বা নিবন্ধিত কোনো অনুবাদকের স্বাক্ষর বা সিল ছিল না। এর আগে একই ধরনের ঘটনার জন্য বিশ্বব্যাংক এ প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল।
চীনের বেইজিংয়ে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস দাখিলকৃত কাগজপত্র নির্ভুল ও সঠিক এ সংক্রান্ত কোনো সনদ দেয়নি। দরপত্রের শর্তে কমপক্ষে ১৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল। সিআরসিসি হারবারের মূল গ্রুপ সিআরসিসির নিজস্ব বিবরণী অনুযায়ী, কোম্পানি প্রতিষ্ঠা ২০০৭ সালে হলেও সিআরসিসি হারবারের প্রতিষ্ঠার তারিখ ২০১১ সালের ৭ জুলাই। এ অনুযায়ী মূল কোম্পানির বয়সই ১৩ বছর। একাজে অভিজ্ঞতাই চাওয়া হয়েছে ১৫ বছর।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জর্জিয়ার একটি প্রকল্পে বড় ধরনের জালিয়াতির জন্য বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালের ৫ জুন সিআরসিসি এবং এর অধীন সব কোম্পানিকে ৯ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে। চলতি বছরের ৩ মার্চ ওই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও ২৪ মাসের জন্য শর্ত সাপেক্ষে সিআরসিসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বরেছেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকাকালীন সংশ্লিষ্ট কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ উন্নয়ন সহযোগী কোনো দেশ বা সংস্থার কোনো প্রকল্প কাজে অংশ নিতে পারবে না। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের বিশ্ব ব্যাংকের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর এ প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বেবিচক। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা থাকার তথ্য গোপন করে দরপত্রের সিডিউল কেনে সিআরসিসি হারবার। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ২০২০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ দফা দরপত্র খোলার তারিখ পেছানো হয়।
আইএমইডি দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরও যেসব অনিয়ম দেখতে পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- মূল্যায়ন কমিটি থেকে পোস্ট কোয়ালিফিকেশন সম্পাদন না করা। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে দাখিলকৃত বিভিন্ন আর্থিক ও কারিগরি দলিলপত্রও যাচাই করা হয়নি। পিপিআর অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় যে কোম্পানিটির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল সেটির বার্ষিক টার্নওভারও যাচাই করেনি মূল্যায়ন কমিটি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অগ্রাধিকার প্রকল্পের দরপত্রে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রচেষ্টা কোনোভাবেই বরদাশত করা ঠিক হবে না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পূর্বের দরপত্রের অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথ আইনের আওতায় আনা উচিত। তারা আরও মনে করছেন, পুনঃদরপত্র প্রক্রিয়া একটি সুদক্ষ, অভিজ্ঞ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
Posted ৩:২৮ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta