বিশেষ প্রতিবেদক(১৯ ফেব্রুয়ারী) :: গত কয়েকবছর ধরে ভালো দাম পাওয়ায় কক্সবাজার জেলায় চলতি বছর ২০১৮ সালেও পুরোদমে লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছেন লক্ষাধিক চাষি। আবহাওয়া বেশ ভালো থাকায় ইতোমধ্যে লবণ উৎপাদনও হচ্ছে আশানুরূপ। সেই সঙ্গে হাসি ফুটেছে চাষিদের মুখে।
তাঁদের আশা, আবহাওয়া এভাবে থাকলে চলতি বছরও লবণ উৎপাদন রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সরকারি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদনের জন্য কায়িক শ্রম দিচ্ছেন চাষিরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) কক্সবাজারের আঞ্চলিক উপ-ব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী জানান, চলতি বছর লবণ উৎপাদন মৌসুমে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিপরীতে শিল্প ও ভোক্তাখাতে চলতি বছর দেশে লবণের চাহিদা রয়েছে ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন।
তিনি আরো জানান, চলতি বছর লবণ উৎপাদন মৌসুমে চট্টগ্রামের দুটি এবং কক্সবাজারের ছয় উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চলতি মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ২ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করেছেন চাষিরা। আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে এবার লবণ উৎপাদন রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলেও আশা করছেন বিসিকের এই কর্মকর্তা।
বিসিক সূত্র জানায়, মৌসুমের শুরুতে নভেম্বর মাসে অতিরিক্ত শীত ও কুয়াশা পড়ায় লবণ উৎপাদনের পরিবেশ তেমন অনুকূলে ছিল না। এই কারণে মৌসুম শুরুর দিকে লবণ উৎপাদনে কিছুটা ভাটা পড়ে। এর পরও প্রায় দুইমাসে লবণ উৎপাদন আশার সঞ্চার করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকলে আগামী মে মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে।
বিসিক কর্মকর্তা আরো জানান, চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে ১৩টি কেন্দ্রের (মোকাম) অধীনে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং আনোয়ারা উপজেলাসহ (আংশিক) ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। তন্মধ্যে চকরিয়া উপজেলার দরবেশকাটা মোকামে ১১ হাজার ৯৪১ একর, মহেশখালী উপজেলার লেমশিখালী মোকামে ৬ হাজার ৬১৮ একর,
উত্তর নলবিলা মোকামে ৬ হাজার ৫২৮ একর, গোরকঘাটা মোকামে ৩ হাজার ৮৭৭ একর, মাতারবাড়ি মোকামে ৫ হাজার ৫৮ একর, কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী মোকামে ১ হাজার ৮৫৩.৭৪ একর, কুতুবদিয়া উপজেলার পূর্ব বড়ঘোনা মোকামে ৫ হাজার ৭৮৮ একর, টেকনাফের মোকামে ২ হাজার ৪৬৬ একর, কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশিখালী, কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী ও মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে স্থাপিত লবণ প্রদর্শনী কেন্দ্রে ৯৪.২৬ একর, সদর উপজেলার গোমাতলীর ৩ হাজার ৩০৮ একর, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নে ২০০ একর, খুটাখালী ইউনিয়নের ফুলছড়িতে ৩ হাজার ৮৫০ একর ও বাঁশখালী উপজেলার সরল ঘোনার প্রদর্শনী কেন্দ্রে ৩৮৮ একর জমিতে লবণ
উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বিসিক কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী চলতি মাস থেকে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ব্যাপকহারে বেড়েছে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বড় কোনো বিপর্যয় না হলে বিসিক কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বেশ। অতীতের পরিসংখানে দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলের লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়।
বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকার কারণে প্রতিবছরই বিসিকের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে দেশে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন হয়ে আসছে। কিন্তু গতবছর (২০১৭) লবণ উৎপাদন
মৌসুমে পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। সে সময় ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে উৎপাদন হয়েছিল ১৩ লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন। এ কারণে চাহিদার বিপরীতে কম
উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন। সরকার বাধ্য হয়ে দেশীয় চাহিদা মেটাতে গিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করেছে।
চকরিয়া উপজেলার বদরখালীর লবণ চাষি মোহাম্মদ নুরুন্নবী, চৌয়ারফাঁড়ির রজিম আহমদ, পেকুয়ার মগনামার দিদারুল আলম কালের কণ্ঠকে জানান, গেল মৌসুমে লবণচাষিরা উৎপাদিত লবণের বেশ দাম পাওয়ায় চলতি মৌসুমে চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার আংশিক এলাকায় লবণচাষের পরিধি বেড়েছে।
তবে উৎপাদন মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে লবণের দাম কমিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছেন মধ্যস্বত্বভোগী একটি দালালচক্র।
তাঁরা অভিযোগ করেন, উৎপাদনের শুরুতে প্রতিমণ (৪৪ কেজিতে) লবণ ৩২০-৩৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারলেও লবণ উৎপাদন ভালো হতে দেখে ২০ থেকে ৪০ টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চললে চাষিরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই উৎপাদিত লবণের যাতে দরপতন না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা তাঁদের।
চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ‘কক্সবাজারের পাঁচ লাখ মানুষ লবণ শিল্পের সাথে জড়িত।
তাঁদের জীবন-জীবিকা লবণচাষের ওপরই নির্ভরশীল। লবণ উৎপাদনের জমির লাগিয়ত শ্রমিকদের মজুরিসহ সবধরনের উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে লবণের মূল্য স্থিতিশীল থাকা অতীব প্রয়োজন। ৪৪ কেজি লবণ ৩০০ টাকার কম মূল্যে বিক্রি করতে গেলে মাঠ পর্যায়ের চাষিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সুযোগে যে পরিমাণ লবণ বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে সেই লবণ এখনো দেশের বড় বড় মিল-কারখানার মালিকেরা মজুত রেখেছেন। তাই দেশের বড় বড় কম্পানিগুলো লবণ ক্রয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।’
Posted ৪:১৩ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta