কক্সবাংলা রিপোর্ট :: বিতর্কিত সেই শর্ত রেখেই বৃহস্পতিবার আলোচিত কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের পুনঃদরপত্র খোলা হচ্ছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর এই প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া একবার বাতিল করেছিল ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এরপর শুরু হয় পুনঃদরপত্র প্রক্রিয়া। কিন্তু সরকারি ক্রয়বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক আগের সেই বিতর্কিত শর্ত এবারও রেখে দেওয়া হয়। এ কারণে আবারও চীনা একটি কোম্পানি ছাড়া বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত কোনো কোম্পানিই এই দরপত্র প্রক্রিয়ায় টিকে থাকতে পারবে না বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে পুনঃদরপত্র প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগও করেছে একটি কোম্পানি। অভিযোগের জবাবে সিপিটিইউ আন্তর্জাতিক দরপত্রকে স্থানীয় দরপত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেছেন, সরকারি ক্রয়বিধিমেনেই দরপত্রের শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রথমবার দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিলের সময় দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী আগের সব শর্ত বহাল রেখেই পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সরকারি ক্রয়বিধির বাইরে কিংবা সংগতিহীন কোনো শর্তই যোগ করা হয়নি। স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজ চলছে।
বিতর্কিত শর্ত :
পুনঃদরপত্রের অর্থনৈতিক বিষয়াদি-সংক্রান্ত শর্তের মধ্যে দুটি ক্ষেত্রে (১৫ ও ৩২ নম্বর শর্ত) বলা হয়েছে, সংশ্নিষ্ট দরদাতা কোম্পানিকে অবশ্যই বাংলাদেশের কোনো তফসিলি ব্যাংকে হিসাব থাকতে হবে। ব্যাংকে চলতি মূলধন কিংবা ঋণসুবিধা গ্রহণের দলিলাদি দিতে হবে। অপর শর্তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি তফসিলি ব্যাংকে কাজ-সংক্রান্ত লেনদেনের হিসাব বিবরণ দেখাতে হবে।
অন্যদিকে, সরকারি ক্রয়বিধির ৪৯ নম্বর ধারায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে দরদাতার যোগ্যতার সমর্থনে আবশ্যকীয় দলিলপত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ, বা দরপত্রদাতা বা আবেদনকারী যে দেশের নাগরিক সেই দেশের সংশ্নিষ্ট পেশাগত বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত হওয়ার কাগজপত্র অথবা যোগ্যতার সমর্থনে শপথপূর্বক ঘোষণাপত্র, বা দরপত্র বা আবেদনকারীর মূল দেশের বা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের শর্ত মোতাবেক কোনো পেশাগত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত সনদপত্র’, ‘ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য সম্পর্কিত যথোচিত ব্যাংক প্রতিবেদন, ব্যক্তি যে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই দেশের কোম্পানি আইনের বিধান অনুসারে ব্যালেন্সসিট প্রকাশ আবশ্যক হওয়া সাপেক্ষে উক্ত ব্যক্তির ব্যালেন্সসিট বা এর প্রয়োজনীয় উদ্ৃব্দতাংশ’, ‘কর পরিশোধ করার বিষয়টি প্রমাণের ক্ষেত্রে ক্রয়কারী উক্ত বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সনদপত্র এবং দরপত্রদাতা বিদেশি নাগরিক হলে তিনি যে দেশের নাগরিক সে দেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সনদপত্র এবং উক্ত সনদপত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের উল্লেখ থাকতে হবে।’
অর্থাৎ, সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সে দেশের ব্যাংক হিসাব এবং ব্যাংকের সনদই গ্রহণযোগ্য। এখানে বাংলাদেশের কোনো তফসিলি ব্যাংকে হিসাব এবং চলতি মূলধন থাকার বিষয়টি আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে যুক্ত করার বিষয়টি সরকারি ক্রয়বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এটি যুক্তিযুক্তও নয়।
সিপিটিইউ সূত্র জানায়, এ-সংক্রান্ত একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এর জবাবে সিপিটিইউ জানিয়েছে, বেবিচকের দরপত্রের শর্ত দেখে এই দরপত্রটি স্থানীয় দরপত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এটি আন্তর্জাতিক দরপত্র হলে সে ক্ষেত্রে ধারা ৪৮ ও ৪৯ প্রযোজ্য হবে। কিন্তু বেবিচকের দরপত্র আহ্বানের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে এই দরপত্রটি আন্তর্জাতিক দরপত্র হিসেবে আহ্বান করার কথা উল্লেখ রাখা দরকার ছিল। কারণ এখানে সমুদ্রের একাংশ ভরাট করে রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্পও নেই।
এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, এই একটি বিতর্কিত শর্তের কারণেই প্রথম দরপত্র প্রক্রিয়ায় চীনের একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আন্তর্জাতিক অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানই দরপত্রে কার্যত অংশ নিতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে সরকারের বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডির প্রতিবেদনে ওই চীনা কোম্পানির অসত্য তথ্য ধরার পর সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি দরপত্রটি বাতিল করে। কিন্তু তার পরও এই বিতর্কিত শর্ত রাখা হয়েছে। সূত্রমতে, বেবিচক ঘিরে থাকা বহু বছরের একটি প্রভাবশালী ঠিকাদারি গোষ্ঠীর পছন্দের চীনা কোম্পানিকে দরপত্রে একমাত্র যোগ্য হিসেবে আবারও নির্বাচিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এসব করা হয়েছে।
প্রথম দরপত্র :
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর এই প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বেবিচক। ওই সময়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক নিষিদ্ধ থাকার তথ্য গোপন করে দরপত্রের শিডিউল কেনে চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি হারবার। এ ছাড়া চীনা কোম্পানিটির স্বাক্ষরবিহীন সনদসহ কোম্পানি-সংক্রান্ত তথ্যে বড় ধরনের অসংগতিও ধরা পড়ে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক এই চীনা কোম্পানির নিষিদ্ধ থাকার তথ্য গোপন করার বিষয়টি পরবর্তী সময়ে জানাজানি হলে ২০২০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তিন দফা দরপত্র খোলার তারিখ পেছানো হয়। কারণ ৪ মার্চ বিশ্বব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দরপত্র খোলা হলে সিআরসিসি হারবারকে যোগ্য দরদাতা হিসেবে নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না।
এ কারণে নানা কারণ দেখিয়ে তিন দফা পিছিয়ে ১৯ মার্চ সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এর আগে কভিড-১৯ মহামারির কারণে ১৬ মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া অন্য সব দেশের সঙ্গে ঢাকার ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্বব্যাপী ফ্লাইট বন্ধ থাকায় মহামারির ভেতরে ১৯ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র খোলার কাজ সম্পন্ন না করার জন্য দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য সাতটি কোম্পানি লিখিত আবেদন করে। অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু তা আমলে না নিয়ে ১৯ মার্চ দরপত্র খুলে অনেকটা গোপনেই দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বেবিচক।
Posted ৩:২৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta