কক্সবাংলা রিপোর্ট :: কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জন্মহার কমানো যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে জনসংখ্যা। প্রতি বছর এ হার সাড়ে তিন শতাংশের বেশি। যে কারণে তিন বছরে লক্ষাধিক শিশুর জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশে এর আগে বিভিম্ন সময়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। বিপুল সংখ্যক এই শরণার্থীর আশ্রয় ও খাদ্য-চিকিৎসা জনবহুল বাংলাদেশের জন্য এমনিতেই বিশাল চাপ। তার ওপর রোহিঙ্গাদের অধিক সন্তান নেওয়ার প্রবণতা প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের জন্মহার না কমানো গেলে বিস্ফোরণ ঘটবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো।
অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী মাসের (আগস্ট) মধ্যে কাজ শুরু করতে চায় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়। বিষয়টি জানিয়ে এনজিও ব্যুরোকে চিঠিও দিয়েছে তারা। পরে এনজিও ব্যুরো থেকে এ বিষয়টি ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে জরুরি প্রকল্প প্রস্তাব দিতে গত সপ্তাহে সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠানো হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবস্থান করছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর (৩১ মার্চ ২০২১- এর তথ্যানুযায়ী) বাংলাদেশে প্রবেশ করা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা হচ্ছে ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ জন। এ হিসাব জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ রেজিস্ট্রেশনের তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরা হয়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ডের (ইউএনএফপিএ) সহযোগিতায় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ইউএনএইচসিআর-এর পপুলেশন সিট ও হেলথ সেক্টরের তথ্য অনুযায়ী, আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিবছর নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর হার ৩০ হাজার ৪৩৮ জন। প্রতি বছর অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ৪ জন। এক থেকে চার বছরের শিশুর সংখ্যা এক লাখ ৩৩ হাজার ৪১৪ জন। পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুর সংখ্যা এক লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৯ জন। এর বাইরে ভাসানচরে রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে আরও এক হাজার ৬৬০ জন।
এনজিও ব্যুরো থেকে গত ১১ জুলাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রায় পাওয়া অনুদানে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো (এনজিও) বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের (এফডিএমএন) দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জরুরি ত্রাণসামগ্রী সরবরাহের জন্য প্রতিনিয়তই নানা প্রকল্প (এফডি-৭) দাখিল ও বাস্তবায়ন করছে। যা প্রশংসনীয়। বৈদেশিক অনুদানের যথাযথ ব্যবহার এবং বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রীর চাহিদা দিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে ব্যুরোতে পাঠানো হয়। ওই চাহিদা পূরণে কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও ভাসানচরে সেবা প্রদানকারী বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো কর্তৃক সেক্টর-ভিত্তিক জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম প্রকল্প (এফডি-৭) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দাখিল করা যেতে পারে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিতে। এ জন্য ব্যাপকভিত্তিক জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ বিতরণ, দীর্ঘ মেয়াদি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং উপকরণ বিতরণের জন্যেও জরুরি প্রকল্প প্রস্তাব দিতে বলা হয়।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার সাড়ে তিন শতাংশের (৩.৫%) বেশি। বিষয়টি আসলেই উদ্বেগজনক। এজন্য আমরা জরুরি প্রল্পের প্রস্তাব চেয়েছি। আগস্টের মধ্যেই জন্ম নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করার আশা রাখছি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে অন্যান্য কাজগুলো আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর জন্য জরুরি প্রকল্পের অংশ হিসেবে আরও যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে— এলপিজি সিলিন্ডার বিতরণ, হেলথ পোস্ট প্রাইমারি হেলথ কেয়ার এবং ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন। পরিধানযোগ্য বস্ত্র, স্যান্ডেল, জুতা, কম্বল এবং বর্ষাকালে ব্যবহারের জন্য ছাতা বিতরণ করা হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেন পরিষ্কার, টয়লেট ও বাথিং ফ্যাসিলিটি স্থাপন এবং মেরামত, গৃহ পুনর্নির্মাণ, গৃহ সংস্কার, মেরামত, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষরোপণ, হোমস্টেড গার্ডেনিংয়ের অংশ হিসেবে চালের ওপর সবজি চাষ করা। সোলার প্যানেল মেরামত, সেলাই প্রশিক্ষণ, নিজস্ব পদ্ধতিতে সাবান তৈরি, কোভিড-১৯ সুরক্ষার জন্য মাস্ক তৈরি এবং ভাসানচরে অগ্রাধিকার দিয়ে হাঁসমুরগী পালন কার্যক্রম। ইউনিসেফের অর্থায়নে নির্মিত লার্নিং সেন্টারগুলোর পুনর্নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামত। ক্যাম্পে বিদ্যমান লার্নিং সেন্টারগুলোতে রোহিঙ্গা ভাষায় রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত এবং তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত উদ্বুদ্ধকরণ সভা ও সেমিনার আয়োজনসহ আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান এবং কান্টি ডিরেক্টরদের অনুরোধ করা হয়।
কক্সবাজারের পরিবার পরিকল্পনা অফিস সূত্রমতে, বিবাহিত রোহিঙ্গা নারীদের গড়ে সাত থেকে ১০টি সন্তান রয়েছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অনেকটি ছোট শিশু রয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি দিলেও রোহিঙ্গা নারীরা না খেয়ে তা ফেলে দিয়েছে। এর পরও হাল ছাড়েননি তারা। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিম্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সুফল তুলে ধরছেন তারা। একই সঙ্গে বিতরণ করা হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীও। এ ছাড়া প্রসবকালীন এবং নবজাতক ও প্রসূতির স্বাস্থ্যসেবাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮৫ জন শিশুর জন্ম হচ্ছে। সেই হিসেবে গত তিন বছরে লক্ষাধিক শিশুর জন্ম হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টে হত্যা ও নিপীড়নের মুখে মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। এজন্য বিভিন্ন উপকরণও তাদের দেওয়া হয়। কিন্তু সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাদেরকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে তাদের কোনো সচেতনতা ও আগ্রহ নেই। যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
Posted ৭:০৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৮ জুলাই ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta