বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের উখিয়া শরনার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের এক মাস পার না হতেই আরও ৬ জনকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গা আসার পর এটিই সবচেয়ে বড় হত্যাকান্ড। এ নিয়ে গত তিন বছরে ২৩২টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলো।জানা যায়,উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮)তে একটি সড়কের পাশে মাদ্রাসা ও মসজিদটি পরিচালনা করে ‘ ইসলামী মাহাস’ নামের রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন। প্রত্যাবাসন নিয়ে এ ইসলামী মাহাস নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা বা আল ইয়াকিনের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। সর্বশেষ ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত সন্দেহে যে অর্ধশত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক হয়েছিল তাদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে ইসলামী মাহাসের নেতারা সাহায্য করেছেন এ ধারণা থেকে মাদরাসা-মসজিদটিতে গভীর রাতে হামলা চালায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা বা আল ইয়াকিন। এর আগেও মসজিদ-মাদরাসাটি দখলের জন্য এর আগেও কয়েকবার হামলা চালিয়েছিল আরসা সদস্যরা।
শুক্রবার ভোররাত সাড়ে তিনটায় ওই মাদ্রাসায় হামলা চালায় ৪০ থেকে ৫০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছয়জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়েছে। হামলার ঘটনায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘ আরাকান স্যালভেশন আর্মি’–আরসাকে (আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত) দায়ী করছেন স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতারা। কারণ, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া–না যাওয়া (প্রত্যাবাসন) নিয়ে ইসলামী মাহাস নেতাদের সঙ্গে আরসার বিরোধ চলে আসছিল। তবে পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আরসা বা আল ইয়াকিনের কেনো অস্তিত্ব নেই।
‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ নামের ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মৌলভি দিন মোহাম্মদ বলেন, দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র মিলে অন্তত ২৫ জন মসজিদে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তে যান। এ সময় অস্ত্রধারীরা মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। মসজিদের বাইরে পাহারায় ছিল আরও ৪০ জনের বেশি মুখোশধারী সন্ত্রাসী। গুলির আওয়াজ শুনে সাধারণ রোহিঙ্গা এবং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা এগিয়ে এলে তাঁদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়।
হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী ২ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিস (৩২), বালুখালী-৯ নম্বর শিবিরের ব্লক-২৯–এর বাসিন্দা ইব্রাহীম হোসেন (২২), বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক আজিজুল হক (২৬) ও মোহাম্মদ আমিন (৩২), একই মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী-১৮ নম্বর শিবিরের, ব্লক-এফ-২২–এর নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫) এবং মাদ্রাসাশিক্ষক ও ২৪ নম্বর শিবিরের হামিদুল্লাহ (৫৫) । এর মধ্যে প্রথম চারজন ঘটনাস্থলেই এবং অপর দুইজনকে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রথমে রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এই হামলায় সাতজন নিহত হওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু পরে তারা জানিয়েছে ওই হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছে। আগে ওই হামলায় মাদ্রাসাছাত্র ও ১৮ নম্বর শিবিরের ব্লক এইচ-৫২–এর বাসিন্দা নুর কায়সার (১৫) নিহত বলা হয়েছিল| আসলে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদ্রাসার আশপাশে থাকা কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ (৪৮) বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। আরসা নেতা আবদুর রহিমের নেতৃত্ব ২০ থেকে ২৫ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ওই হামলা চালিয়েছিল। এ পর্যন্ত মুহিবুল্লাহ হত্যার সঙ্গে জড়িত আরসার ৫ জন সদস্য ও ৪০ জনের বেশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। আরসা সদস্যদের আটকের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে ইসলামী মাহাসের সদস্যরা সহযোগিতা করেছেন—এই ধারণা থেকে ওই মাদ্রাসা-মসজিদে হামলা চালানো হয়।
রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার বিষয়ে আলোচনা করায় সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ আল-ইয়াকিন ক্যাডাররা শিক্ষক নূর আলম ওরফে হালিম ক্যাম্প-২৪-এর শিক্ষক হামিদুল্লাহসহ তিন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। মসজিদ-মাদ্রাসাটি দখলের জন্য এর আগেও কয়েকবার হামলা চালিয়েছিল আরসা সদস্যরা।
রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার খান বলেন, সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছয়জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। হামলার কারণ, কারা হামলা করেছে—সেসব ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। এ ঘটনায় মুজিবুর রহমান নামের একজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা অথবা আল ইয়াকিন নামের কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা এবং আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপতৎরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে ওই শিবিরে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।
শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ নেওয়াজ হায়াত। তবে তাঁরা এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
চরমপন্থি সংগঠন আল ইয়াকিন
১৯৯০ সালের শুরুতে রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, তখন থেকেই ক্যাম্পগুলোতে আরসা নামের একটি সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এই গ্রুপের নেতারা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন।
এই সংগঠনটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ঘোর বিরোধী। তাদের নেতারা কখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের খুঁজছে। গেলে তাদের দণ্ড ভোগ করতে হবে। এ জন্য তারা চান না যে রোহিঙ্গারা কখনও তাদের দেশে ফিরে যাক। সে কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে যেসব সংগঠন কাজ করছে, সেগুলোর সঙ্গে তাদের একটা বিরোধ রয়েছে।
আরসাকে রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে দাবি করে মিয়ানমার সরকার। স্থানীয়ভাবে এটি ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তাদের এক রিপোর্টে বলছে, সংগঠনটি মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্বারা।
সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা পুরনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ওইসময় আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে মিয়ানমার থেকে অন্তত সহস্রাধিক রোহিঙ্গা (আরএসও জঙ্গী) আফগানিস্তানে গমন করেছিল। সেখানে গেরিলাযুদ্ধে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা নিহত হয়। মারা যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে চট্টগ্রামে ও কক্সবাজারে এনআইডিধারী রোহিঙ্গাদের স্বজনরাও রয়েছে। তন্মধ্যে ইদ্রিছ জিহাদীর সহোদর ইউনুচ জিহাদী অন্যতম।
প্রশিক্ষণ শেষে আফগানযুদ্ধে মারা যাওয়া রোহিঙ্গা জঙ্গী ইউনুচ জিহাদীর সহোদর এদেশের নাগরিক দাবিদার ইদ্রিস জিহাদী, ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা জঙ্গী শায়খ ছালামত উল্লাহ, মাস্টার আয়ুব, আবু সিদ্দিক আরমান, এনায়েত, নূর হোসেন, মৌলবি শফিক, আবুসিদ্দিক, রুহুল আমিনসহ এক শ্রেণীর রোহিঙ্গা নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে আরসার সঙ্গে। রোহিঙ্গা নেতা মৌলবি আবু সিদ্দিক আরমান, হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, শায়খ ছালামত উল্লাহ, হাফেজ হাসিম, বাইট্টা শামসু, মৌলবি শফিক, মৌলবি ইদ্রিস, চট্টগ্রামে বসবাসকারী ব্যবসায়ী নূর কামাল ও মৌলবি নূর হোছাইনসহ অনেকে তালেবান, হুজি, আল কায়েদা, আল্লাহর দল, আরএসও এবং আল-ইয়াকিন ক্যাডারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তাদের অর্থ যোগানদাতা বলে জানা গেছে। তারা প্রায় সময় সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিরোধী নানা অপকর্মে উস্কানি দিয়ে থাকে।
জানা যায়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির হচ্ছে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির। এই ক্যাম্পে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রিত। পার্শ্বস্থ বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এই দুটি শিবিরে জনসংখ্যা যেমন বেশি, অপরাধ কর্মকা-ের সংখ্যাও বেশি। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মধ্যে চাঁদা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় গোলাগুলি, মারামারি, খুনখারাবি এবং নতুন রোহিঙ্গা আগমনের ঘটনা এই ক্যাম্পে নিত্যনৈমিক্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৬সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ এই ক্যাম্পের পাশেই থাইংখালীর লন্ডাখালী নামের পাহাড় থেকে তালেবান খ্যাত হরকাত-উল জিহাদ আল ইসলামী (হুজির) ৪১ জন জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছিল। বিএনপি জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (১৯৭৮) ৪ লাখ রোহিঙ্গার আগমন ঘটে বাংলাদেশে। ৩ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলেও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে থেকে যায় এদেশে। বিএনপি সরকার তাদের বিভিন্নভাবে মদদ দেয়। তখন বাংলাদেশের ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পাড়ি জমায় সৌদি আরবে।
১৯৯১ সালে বিএনপি (জোট সরকার) ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয় নেয়ার সুযোগকে যথারীতি কাজে লাগায় আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠী। ওইসময় তালেবান খ্যাত হরকাত-উল জিহাদ আল ইসলামী (হুজির) এবং আরএসওর ক্যাডাররা ঘাঁটি তথা আস্তানা গেড়েছিল বিভিন্ন পাহাড়ে। উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী এই দুটি শিবির তালেবান তথা পুরনো রোহিঙ্গা ক্যাডারদের যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। শুধু দেশী নয়, বিদেশী জঙ্গীদের কানেকশনও রয়েছে এই দুটি শিবিরে। মৌলবাদী রাজনৈতিক একাধিক দলের শীর্ষ নেতারা ১৯৯২ সালে ওই তালেবান নেতাদের থাইংখালী পাহাড়ে ঘাঁটি করার মৌখিক অনুমতি দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ে ঘাঁটি করে সশস্ত্র অবস্থায় অবস্থান নেয়া আরএসওসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়। তালেবান হিসেবে পরিচিত হরকাত-উল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) ৪১ জন জঙ্গীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল। পরবর্তীতে আদালত তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুতুপালং শিবির সংলগ্ন লন্ডাখালী এলাকায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিল এই ৪১ জঙ্গী। কক্সবাজার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল আদালতে (ট্রাইব্যুনাল মামলা নং- ১০০/৯৬) সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ মে তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এবং ট্রাইব্যুনাল কোর্টের বিচারক এ রায় ঘোষণা করেছিলেন। মামলার রায়ে একজন মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাসহ মোট ৪১ জন জঙ্গীকে অস্ত্র আইনে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে আবারও জোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে ওইসময় ৪১ জন জঙ্গী জামিনে মুক্তি পায়। অনেকে পলাতক থাকলেও তাদের কার্যক্রম এখনও চলছে গোপনে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে সশস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গী গ্রুপ আরসা। তিন সপ্তাহ পর শুক্রবার (২২ অক্টোবর) হত্যা করা হলো প্রত্যাবাসনে জনমত গঠন ও আর্মড পুলিশকে সহযোগিতাকারী ৬ রোহিঙ্গাকে।
২০টি বাহিনী
পুলিশ বলছে, অপহরণকারীদের এই দলটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এরকম কতোগুলো গ্রুপ সক্রিয় তার কোনো হিসেব নেই। তবে পুলিশ, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক ও স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা করা যায় যে এধরনের কুড়িটির মতো গ্রুপ কক্সবাজারে সক্রিয় রয়েছে।স্থানীয়ভাবে এসব গ্রুপ ‘অপহরণ বাহিনী” নামে পরিচিত। টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করাই তাদের কাজ। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এসব গ্রুপের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে। তাদের মধ্যে গোলাগুলিতে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।স্থানীয়দের মধ্যে এসব গ্রুপের নেতাদের নামেই বাহিনীগুলোর পরিচয় গড়ে উঠেছে। যেমন: রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন বাহিনী ইত্যাদি। এসব বাহিনীর কয়েকশ করে সদস্য, স্থানীয় লোকজনের কাছে যারা ডাকাত হিসেবে পরিচিত।
দিনে সরকারি বাহিনি, রাতে সশস্ত্র বাহিনী
২০১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চার বছর পর ক্যাম্পগুলোতে এদের অপরাধমূলক তৎপরতা বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দিনের বেলায় থাকে সরকারি বাহিনী। রাতের বেলায় সশস্ত্র বাহিনী। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ার পর সেখানে আইন শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকে না। সন্ত্রাসীরা যেভাবে চায় সেভাবেই চলে।রাতের বেলায় এরা ক্যাম্পে নেমে এলেও সকাল হওয়ার আগেই তারা টেকনাফের পাহাড়ি জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানেই তারা বসবাস করে। অপহরণের পাশাপাশি এসব গ্রুপ ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক ও অস্ত্রের পাচার এবং ব্যবসা, চোরাচালান ও রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে যৌন ব্যবসার সাথে জড়িত। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, যিনি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, এক কথায় ক্যাম্পগুলোর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল না। পারিবারিক সংঘাত আছে, মাদক পাচারকারী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ক্যাম্পগুলোকে ব্যবহার করছে। অল্প জায়গায় প্রচুর সংখ্যক মানুষ বসবাস করার কারণে নানান ধরনের ঝগড়া বিবাদ সংঘাত লেগেই থাকে। তরুণ ছেলেপেলের লেখাপড়ার করার তেমন সুযোগ নেই, খেলাধুলা নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই।, একারণে তারা খুব সহজেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
কী চায় আল-ইয়াকিন
এ বাহিনীর কোনো সদস্যের সরাসরি কথা না হলেও ইউটিউবে তাদের বেশ কয়েকজন নেতা নিয়মিত ভিডিও প্রচার করেন। এসব ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে (পারিপার্শ্বিক অবস্থা) নির্জন পাহাড় ও অস্ত্র দেখা যায়। তবে সেগুলো বাংলাদেশে ধারণকৃত কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।তাদের একটি ভিডিওতে আল-ইয়াকিনের নেতারা দাবি করেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আরাকানের অংশ। তারা এতদিন মিয়ানমারের রাখাইনে ছিলেন। এখন তাদের আরেক রাজ্য কক্সবাজারে এসেছেন। তারা এখানেই থাকবেন, রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ে কক্সবাজারের নিয়ন্ত্রণ নেবেন। বিভিন্ন ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ের কথা বললেও ক্যাম্পের ভেতরে খোদ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত আল-ইয়াকিনের সন্ত্রাসীরা।
Posted ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta