বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজার শহরে সন্ত্রাসীদের স্থান আর হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাব ও পুলিশ সমানতালে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের আস্তানা। শহরের ভয়ঙ্কর কিলার ও তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আশরাফ আলী ওরফে আশু আলী র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। শনিবার ভোরে শহরের সাহিত্যিকা পল্লী বড়বিল মাঠে সন্ত্রাসী আশু আলীর লাশ দেখতে পান স্থানীয়রা। নিহত আশু আলী বিজিবি ক্যাম্প ফরেস্ট অফিসপাড়ার জাফর আলমের পুত্র।
সাহিত্যিকা পল্লী ও সমিতি বাজারের মাঝামাঝি আশু আলী বাহিনীর অভয়ারণ্য। তার বাহিনীর প্রধান আমির খান ২০১৯ সালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। পরবর্তীতে সেকেন্ড ইন কমান্ড আশরাফ আলী ওরফে আশু আলীও একই পথের পথিক হলো। এ খবরে স্থানীয়দের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। ২০১৭ সালে কক্সবাজার শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। দক্ষিণ সাহিত্যিকা পল্লী এলাকার শরাফত আলীর পুত্র আবদুল কাদের বাধা দিতে গেলে তার একটি হাত সন্ত্রাসীর ধারালো অস্ত্রের কোপে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এসব ঘটনার হোতা ছিল আশরাফ আলী ওরফে আশু আলী। আর পঙ্গুত্ববরণ করতে হয় আবদুল কাদেরকে।
পরের বছর ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারিতে বিজিবি ক্যাম্প ফরেস্ট অফিসের পেছনে কথা-কাটাকাটির জের ধরে আশরাফ আলী, আমির খান ও সরওয়াররা স্থানীয় মৃত আবদুল মোনাফের পুত্র বাদশার পা কেটে দেয়। ২০১৯ সালের দিকে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় শহরের শীর্ষ অপরাধী আমির খান। ২০২০ সালের জুলাইয়ের দিকে শহরের সাবমেরিন কেবল এলাকায় বোনের বাসা থেকে বাবুর্চি হেলালকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে আশু আলী। হেলাল উদ্দিন বিজিবি ক্যাম্প এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের পুত্র। এরপর একই সালের সেপ্টেম্বরে রাজমিস্ত্রি শফিউল্লাহকে কুপিয়ে হত্যা করে আশু আলী ও সাদ্দাম গ্যাং। শফিউল্লাহ বিজিবি ক্যাম্প এলাকার হাবিবুর রহমানের পুত্র।
২০২০ সালের ২২ নবেম্বর কক্সবাজার বাস টার্মিনাস্থল বিএডিসির খামার-সংলগ্ন সড়কে আশু আলীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন আনোয়ার হোছাইন। ঘটনার পরপরই আশু আলীর অন্যতম সহযোগী মৃত আবুল কালামের পুত্র সালমানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু অধরা থেকে যায় ভয়ঙ্কর আশু আলী।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় মৃত মোঃ ইয়াছিনের পুত্র রুবেলকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে আশু আলী ও তার সক্রিয় সদস্যরা। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি কক্সবাজার বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় দিনদুপুরে জান্নাতুল ফেরদৌস কেমি নামে এক কলেজ ছাত্রীকে ছুরিকাঘাতে আহত করে তার মোবাইল ফোন ছিনতাই করে সটকে পড়ে আশু আলী চক্রের সদস্যরা। ২০২১ সালের জানুয়ারির দিকে বিজিবি ক্যাম্পের দক্ষিণ সাহিত্যিকা পল্লী সমাজ কমিটির ধর্ম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সাবুকে গুলি করে হত্যা করে আশু আলী।
আশু আলীর উত্থান ॥ কক্সবাজার শহরের পশ্চিম চৌধুরী পাড়ার ফরেস্ট অফিসের পেছনে জাফর আলমের পুত্র আশরাফ আলী ওরফে আশু আলী। বর্তমান বয়স প্রায় ২৪/২৫ বছর। ১৬ বছর বয়সে আমির খান (বন্দুকযুদ্ধে নিহত) গ্রæপের সক্রিয় সদস্য হিসেবে চুরি-ছিনতাই শুরু করে সে। আমির খানের ছিল প্রায় ১২ জনের একটি ছিনতাইকারী গ্রæপ। ছিনতাইয়ের পাশাপাশি একাধিক হত্যাকাণ্ডের হোতাও তারা। আমির খানের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করত আশু আলী। শহরের বেশির ভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত তাদের হাতে। গত তিন বছরে আশু আলীর হাতে খুন হয় প্রায় পাঁচজন। ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে শতাধিক। আহত হয়েছে হিসাবের বাইরে।
এ ছাড়া ডাকাতি, অপহরণ ও চাঁদা আদায় রয়েছে অহরহ। বর্তমানে আশু আলীর গ্রæপে রয়েছে ৭ থেকে ৮ জন সন্ত্রাসী। আশু আলীর সঙ্গে সাদ্দাম বাহিনীর প্রধান সাদ্দামের সঙ্গে রয়েছে গভীর সমন্বয়। সাদ্দাম হোসেন (২৮) শহরের রুমালিয়ারছড়া সমিতি বাজার এলাকার মৃত সালেহ আহমদের পুত্র। সাদ্দামের নামেও তিনটি হত্যা মামলাসহ ডজনখানেক মামলা রয়েছে। তার গ্রুপেও রয়েছে ৮-১০ জন সক্রিয় ক্যাডার। এছাড়া এলাকার রকি বাহিনীর আছে বিস্তর প্রভাব।
তাদের আস্তানা ॥ শহরের বিশাল একটি পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকা হলো রুমালিয়ারছড়ার সমিতি বাজার, সিকদার বাজার, কক্সবাজার জেল কারাগারের পেছনের এলাকা, পল্লানিয়া কাটা, আমতলী পাহাড়ী এলাকা, সাতিহিত্যা পল্লীর ভেতরে, বিজিবি ক্যাম্পের পশ্চিমে ও আলীর জাহান গরুর হালদা এলাকা। এসব পাহাড়ী এলাকায় আশু আলী ও সাদ্দাম গ্রæপের আস্তানা। দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া সমিতি বাজারে মামুনের একটি দোকান রয়েছে। মামুনের ওই দোকান থেকে আশু আলী ও সাদ্দাম বাহিনীর জন্য নিয়মিত খাবার সরবরাহ দেন তাদের আস্তানায়। এতে সহযোগিতা করে সমিতি বাজার এলাকার আবদুল মাবুদের পুত্র তারেক। এমনকি অস্ত্রও সরবরাহ দেয় বলে জনশ্রæতি রয়েছে। ওই পাহাড়ী এলাকার বিশেষ করে জেল কারাগারের পেছনের কয়েকজন ব্যক্তি তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করছে।
আশু আলী ও সাদ্দাম বাহিনীর কাছে সবাই অসহায়। তাদের হাতে জিম্মি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় তাদের। কারও বাড়িতে মেহমান এলে ছিনতাইয়ের শিকার হয়। ঘর নির্মাণ করতে বা জায়গা ক্রয়-বিক্রয় করলে তাদের দিতে হয় নিয়মিত চাঁদা। এর বিরুদ্ধে কথা বলায় নিহত হয়েছে অনেকজন। আহত হয়ে অনেকেই এখন পঙ্গু। ভয়ে কেউ কথা বলে না। থানায় মামলা ও অভিযোগ রয়েছে ডজনের ওপর। শত শত ভুক্তভোগী অভিযোগ বা ভয়ে মামলাও করতে পারেনি। রাতের বেলায় তারা এলাকায় বিচরণ করে আর দিনের বেলায় ঘুমায়। একেক দিন একেক ঘরে তারা ঘুমায়। পাহারা দেয় মহিলারা।
পুলিশ সুপার মোঃ হাসানুজ্জামান বলেন, তাদের গ্রেফতার করতে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছিল, কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় সহজেই পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এলাকার চিহ্নিত কয়েক ব্যক্তি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। সন্ত্রাসী যেই হোক অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান এসপি হাসানুজ্জামান।
এদিকে কক্সবাজার শহরের ক্রাইমজোন হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া এলাকা, সমিতি বাজার, গরুর হালদা, সিকদার বাজার ও জেল কারাগারের পেছনের এলাকা আশু আলী ও সাদ্দাম বাহিনীর রাজত্ব। এসব এলাকায় নিয়মিত হত্যা, ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চলে আসছে। এসব প্রতিরোধ করতে সবার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত দেড় বছর আগে দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া এলাকায় শহর পুলিশ-ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আশরাফ আলী ওরফে আশু আলীর বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাই, অস্ত্র, ডাকাতি প্রস্তুতিসহ প্রায় ১২টি মামলা রয়েছে এবং সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ প্রায় ৯টি মামলা রয়েছে।
মহেশখালীর কালারমারছড়ার উত্তর নলবিলার দরগাহঘোনায় একটি বসতবাড়ির আঙ্গিনার মাটি খুঁড়ে ২টি দেশীয় অস্ত্র ও ২টি কার্তুজ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
শুক্রবার গভীর রাতে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) জাহেদুল ইসলামের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শনিবার ভোরে রুহুল আমিন নামের একজনকে আটক করা হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে আসা একরামকে স্থানীয় আব্দুল মোনাফের পুত্র কবিরের নেতৃত্বে হত্যা করে মাতারবাড়ির কোহেলিয়া নদীতে ফেলে দেয়। পরের দিন সকালে কবিরকে জনগণের সহয়তায় গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে হত্যার কথা স্বীকার করে। স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই রাতভর অভিযান চালিয়ে তার বাড়ির আঙ্গিনার মাটির নিচ থেকে ২টি এলজি বন্দুক ও ২টি গুলি উদ্ধার করা হয়।
Posted ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৮ জুলাই ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta