কক্সবাংলা ডটকম(১০ মে) :: দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে হ য ব র ল অবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্ত পরিবেশে বাইরে থাকা অবস্থায়ই দল পরিচালনায় অগোছালো অবস্থা দৃশ্যমান হচ্ছিলো। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির সাংগঠনিক অব্যবস্থাপনার বেহাল দশা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আর এ অবস্থা আরও মহামারি আকার ধারণ করে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর। বিগত নির্বাচনে বিএনপি ও বিএনপির অন্যতম শরিক রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
সেই নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি বিএনপিকে আরও অগোছালো করে দেয়। অবস্থাদৃষ্টে সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে, সংগঠন পরিচালনায় সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ভুগছে এ বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি। কে বা কারা বিএনপি চালাচ্ছে সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে উচ্চারিত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অবশ্য বিএনপির নেতৃত্ব প্রশ্নে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলের মধ্যে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। এ যৌথ নেতৃত্বে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরে আমরা যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তুলেছি। সেই যৌথ নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা আজকে জনগণের কাছে যেতে পেরেছি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি ঘোষণা দেয় দলের নির্বাচিতরা জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন না ও সংসদেও যাবেন না। এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে মনে হচ্ছিলো সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কারাবন্দি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রথম দফায় দলটি তাদের নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ থেকে বিরত রাখতেও সমর্থ হয়।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে শপথ নেয়া থেকে নির্বাচিতদের বিরত রাখতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। বারবার নির্বাচিত মোট ৬ সদস্যর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করলেও তারা শেষ পর্যন্ত দলের নাটাই ছিড়ে সংসদে প্রবেশ করেন। নির্বাচিত মোট ৬ সদস্যর মধ্যে একমাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
এরমধ্যে সবার আগে ঠাকুরগাঁও- ৩ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় ধানের শীষের জাহিদুর রহমান সবার আগে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ গ্রহণের অপরাধে বিএনপি তাকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ সহ সকল পদ থেকেই বহিষ্কার করে। কিন্তু জাহিদুরের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে বাকি ৪জন সদস্য শপথ গ্রহণের জন্য একজোট হন। তারা যে কোনো মূল্যে শপথের পক্ষে নিজেদের অবস্থান দলের শীর্ষমহলের কাছে জানিয়ে দেন।
একই সঙ্গে তারা ঘোষণা করেন, এতে যদি দল তাদের বহিষ্কারও করে তাতেও তারা কুণ্ঠিত নন। শপথের পক্ষে দলের নির্বাচিত ওই এমপিদের হুমকিতে বিএনপি শেষ মুহূর্তে তার সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়। এক পর্যায়ে দলটি ঘোষণা করে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে নির্বাচিতরা শপথ নিয়েছেন এবং সংসদে যোগ দিয়েছেন।
এদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশ উপেক্ষা করেও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই থেকে ‘বিএনপি আসলে কে চালায় বা চালাচ্ছেন’ প্রশ্নটি আরও জোরালো হতে থাকে। প্রশ্নটি শুধু সাধারণের নয়, প্রশ্নটি বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরও দেখা দিয়েছে। বিএনপি আসলে কার নির্দেশে চলছে? কে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপির? দলের স্থায়ী কমিটি, কারাবন্দি খালেদা জিয়া, নাকি লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান?
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, এ প্রশ্নটি শুধু তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের নয়, এ বিষয়ে দলের সিনিয়র অনেক নেতারাও অন্ধকারে আছেন। যদিও খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা ও পরামর্শে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দল পরিচালনা করবেন।
কিন্তু গত ২৯ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেক রহমানকে দলের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দলের মধ্যে একই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে মহাসচিব মুখপাত্র হিসেবে দল পরিচালনা করেছেন। তবে এখন লন্ডন থেকে তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে।
বিএনপি সূত্রে আরও জানা যায়, নয়াপল্টনে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান নেয়া দলের দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদও বিএনপিতে বিকল্প নেতৃত্বের বলয় গড়ে তুলেছেন। তিনি তার কিছু অনুসারী নিয়ে মহাসচিবের অনেক নির্দেশনাই সচেতনভাবে বা সচতুরতার সঙ্গে অমান্য করে চলছেন। মহাসচিবের নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়াই তিনি যখন ইচ্ছা তখন দলীয় কার্যালয়ে প্রায় প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে থাকেন।
এক্ষেত্রে মহাসচিব বা দলের সিনিয়র নেতারা ওই নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখা সত্বেও তিনি ব্রিফিং করে তার বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এছাড়া যেকোনো মুহূর্তে দলের যেকোনো নেতাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার ও আবার দলে ফেরানোর ঘটনাও রিজভীর নিয়মিত কর্মকাণ্ডের অংশ বলে দলের মধ্যে গুঞ্জন আছে। আর এসব বিষয়ে অর্থর লেন-দেনের বিষয় জড়িত বলে গুঞ্জন আছে।
এদিকে কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান গত ১৪ এপ্রিল হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সাক্ষাতে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিভিন্ন আইনি বিষয়ের পাশাপাশি দলের নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া বিষয়েও দলীয় প্রধানের সঙ্গে আলোচনা হয় তাদের।
এ সময় নির্বাচিতরা সংসদে যেতে চায় বলে দলীয় প্রধানকে জানালে তিনি (খালেদা জিয়া) জানতে চান কি কারণ ও উদ্দেশ্যে তারা সংসদে যেতে চায়? মহাসচিব উত্তরে জানান, তাদের যুক্তি হচ্ছে, সংসদে সরকারের বিভিন্ন অবব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে। প্রতি উত্তরে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, তাদের বাইরে থেকে কথা বলতে বলেন।
এরপরও গত ২৫ এপ্রিল দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেই সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান। এরপরও দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সময় সীমার শেষ দিনে গত ২৮ এপ্রিল সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত আরও চারজন। শুধু বাদ থাকেন মহাসচিব। তবে ওইদিনই দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই চার নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
জানা যায়, দলের ভাঙন ও বিদ্রোহ ঠেকাতে শেষ মুহূর্তে তারেক রহমান শপথের পক্ষে নিজের ইতিবাচক মতামত দিতে বাধ্য হন। যদিও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
বিএনপির গঠনতন্ত্রে দল পরিচালনার একক ক্ষমতা দলের চেয়ারপারসনকে দেয়া হয়েছে। তার অনুপস্থিতিতে এই ক্ষমতা ভোগ করেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি চিকিৎসার নামে গত ১১ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা ও পরামর্শে দল চলে। এ জন্য তার দেশে ফেরার দরকার নেই। তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই তিনি নির্দেশনা দিতে পারবেন।
এছাড়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট না হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যায়নি বিএনপি। আর ওই সময় সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এবারও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট এবং খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো দলটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানের নির্দেশে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে এখানে গণফোরাম সভাপতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনকে দোষারোপ করেছেন দলের তৃণমূল ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। তাদের ভাষ্য, সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে ঐক্যফ্রন্ট তৈরি করে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে গিয়েছেন কামাল হোসেন।
পুরনো মিত্র ২০ দলীয় জোটকে অমূল্যায়িত করে নতুন জোট ঐক্যফ্রন্টের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ায় বিশদলীয় জোট কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে দাবি করে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র বিজেপি গত ৭ মে বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। এরপর ২০ দলীয় জোটের আরেক শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরানও বিএনপি জোট ছাড়ার হুংকার দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব ও কাদের সিদ্দিকী সরকারের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। এ কারণে বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়তে হবে। বিএনপিকে ড. কামালদের ছাড়তে হবে। না হলে আমরা বিএনপি জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাব।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ১৫ মাস ধরে তিনি নাজিমউদ্দীন রোডে পরিত্যক্ত সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে একমাত্র কারাবন্দি হিসেবে রয়েছেন।
Posted ২:২৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১১ মে ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta