এম.জিয়াবুল হক,চকরিয়া(১৩ জুন) :: অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার তান্ডবে মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশাল আয়তনের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। বর্তমানে ভাঙ্গা অংশদিয়ে বন্যা ও জোয়ারের পানি অনায়সে ঢুকছে লোকালয়ে। এ অবস্থার কারনে দুইদিন ধরে ওই এলাকায় চলছে রীতিমত জোয়ার-ভাটা।
দুপুরে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ জাফর আলম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরউদ্দিন মুহাম্মদ শিবলী নোমান, কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো.ইমান আলী, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জোবায়ের হাসান, পাউবোর চকরিয়া শাখা কর্মকর্তা তারেক বিন সগীর, কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার ও বিএমচর ইউপি চেয়ারম্যান এসএম জাহাংগীর আলম।
জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া শাখা কর্মকর্তা (এসও) তারেক বিন সগীর পাহাড়ি ঢলে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে কোনাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম পয়েন্টে অন্তত ৫০ মিটার বেড়িবাঁধ পানির প্রবল ধাক্কায় ভেঙ্গে গেছে।
দুপুরে স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান সহ আমরা ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছি। তারেক সগীর বলেন, বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে এবং মাতামুহুরী নদীর ঢলের পানি কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ মেরামত কাজ শুরু করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কন্যারকুম পয়েন্টসহ চকরিয়া উপজেলার ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ গুলো দ্রৃত সময়ে মেরামত করতে বরাদ্দ নিশ্চিতের পাশাপাশি অফিস আদেশ ইস্যু করার জন্য গতকাল সন্ধ্যার দিকে কক্সবাজার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সবিবুর রহমান উবর্ধতন প্রশাসনে জরুরী বার্তা প্রেরণ করেছেন।
অপরদিকে চারদিন থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার কারনে চকরিয়া উপজেলার বন্য পরিস্থিতি অবনিত ঘটেছে। বর্তমানে উপজেলার আঠারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। গত রোববার থেকে শুরু ভারী বর্ষণের পাশাপাশি মাতামুহুরী নদীতে উজানের পাহাড়ি এলাকায় ঢল নামতে শুরু করলে পৌরসভাসহ চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নে অন্তত ৩০ হাজারের বেশী বসতঘর পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলার অভ্যন্তরীণ জিদ্দবাজার-মানিকপুর সড়ক, চিরিঙ্গা-বদরখালী সড়ক, কেবি জালাল উদ্দিন সড়ক ও বরইতলি-মগনামা সড়ক সহ একধিক আঞ্চলিক সড়কে জীবন ঝুঁকি নিয়ে অল্প সংখ্যক গণপরিবহণ চলছে।
মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢল নামলে প্রথমে আঘাত করে চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে। গত চারদিন ধরে দুইটি ইউনিয়নের হাজারো বসতঘর ৪-৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আজিমুল হক আজিম বলেন, রোববার সকাল থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার পরপর মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে শুরু করে। ওইসময় তাঁর ইউনিয়নের অধিকাংশ নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারনে এখনো ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। বসতঘরে পানি ঢুকে পড়ার কারনে দুর্গত পরিবার গুলোতে রান্না-বান্নার কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় অনেক পরিবার শুকনো খাবার ও পানি খেয়ে রোজা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত ওসমান বলেন, চারদিনের ভারী বর্ষণে তাঁর ইউনিয়নের বেশির ভাগ নীচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে আভ্যন্তরিক বেশ কটি সড়ক। ছিকলঘাট-কাকারা-মাঝেরফাড়ি সড়কের উপর দিয়ে মাতামুহুরী নদীর পানি লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বর্তমানে তাঁর ইউনিয়নের ৮০ ভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এতে জনসাধারণ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার, লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার ও কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মক্কী ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তাদের ইউনিয়নের বেশির ভাগ নীচু এলাকা এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। এখনো হাটু পানিতে নিমজ্জিত চকরিয়া সরকারি কলেজ, আমজাদিয়া মাদরাসা সহ হাজার হাজার বসতঘর।
দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, চকরিয়া উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের বির্স্তীণ জনপদ পানিতে ভাসছে। বানবাসি মানুষ বাড়ি-ঘর ছেঁেড় একটু উঁচু স্থানে অবস্থিত নিকট আত্মীয় এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটের সামনে পরিবার সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এখনো পানিতে তলিয়ে রয়েছে উপজেলার লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, ফাঁশিয়াখালী, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ইউনিয়নের নীচু এলাকা।
চকরিয়া পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র বশিরুল আইয়ুব বলেন, চারদিনের ভারী বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের বন্যার তান্ডবে পৌরসভার অধিকাংশ এলাকার মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি। চকরিয়া শহর ছাড়াও অবশিষ্ঠ প্রতিটি এলাকায় বসতঘরে আবার কারো ঘরের উঠানে পানি ঢুকেছে। চারদিন ধরে পানিতে ডুবে আছে পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডের মজিদিয়া মাদরাসা পাড়া, ভাঙ্গারমুখ, দিগরপান খালী, এক নম্বর ওয়ার্ডের চরপাড়া, ছাবেত পাড়া, কাজীর পাড়া, ৩নম্বর ওয়ার্ডের বাটাখালী সেতুর পাশের কয়েকটি গ্রামের অন্তত শতাধিক বসতঘর।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব জাফর আলম বলেন, চকরিয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। জনসাধারণ পানিবন্দি অবস্থায় কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছে। বন্যা পরিস্থিতির বিষয়টি ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয়ে জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, চকরিয়া উপজেলার ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ গুলো দ্রৃত সময়ে মেরামত করতে উদ্যোগ নেয়ার জন্য পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবগত করা হয়েছে। দুর্গত মানুষের জন্য সরকারী কোন ধরণের বরাদ্দ আসেনি। তবে বরাদ্দ আসতে বিলম্ব হলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করবো।
জানতে চাইলে চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় ভেঙ্গে যাওয়া কোনাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম পয়েন্টের ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ পরির্দশন করা হয়েছে। জনগনের দুর্ভোগ লাগবে অতি সহসা ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Posted ৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta