কক্সবাংলা ডটকম(৩ মে) :: গত দুই বছর ধরে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর রেডিও-টিভিতে কি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই গানটা বেজেছে? উত্তর হলো- বেজেছে এবং দেখানো হয়েছে। আমরাও (হয়তো) গুন গুন করে গেয়েছি ‘ও মন রমজানের ঐ…’। কিন্তু ঈদের আনন্দ উদযাপন করা হয়নি, উদযাপন করতে পারিনি, উদযাপন করা সম্ভব ছিল না।
মহামারি করোনা দুই বছর পুরো পৃথিবীর ওপর যে কালো থাবা বিস্তার করে রেখেছিল তা সরিয়ে এবার প্রায় স্বাভাবিকভাবেই উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর।
মহামারির এই সময়ে কতজন স্বজনকে হারিয়েছি, কতজন ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি, তার কোনো হিসাব নেই। কত সন্তান তার বাবা-মাকে হারিয়েছে, কত বাবা-মা তার সন্তানকে হারিয়েছে, তারও কোনো হিসাব নেই। হিসাব নেই কতজন চাকরি বা আয়ের উৎস হারিয়ে শহর ত্যাগ করে গ্রামে গিয়েছেন। হিসাব নেই কত উদ্যোক্তা বা মালিক তার প্রতিষ্ঠানটিকে হারিয়েছেন।
দিনের আলোতেও সড়ক ছিল জনমানবশূন্য, ভুতুড়ে। দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই ছিল বন্ধ। এই সময়টায় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই পাল্টে গিয়েছিল। চারিদিকে ছিল স্বজন হারানোর শোক।
সব শোক, সব হারানো বেদনা বুকে নিয়েই আমরা ফিরেছি স্বাভাবিকতায়। জীবন হয়েছে স্বাভাবিক, লেখাপড়ায় এসেছে স্বাভাবিক গতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে এসেছে স্বাভাবিক গতি, পর্যটন ফিরেছে স্বাভাবিক অবস্থায়। সবমিলিয়ে এবারের ঈদুল ফিতরও আমরা উদযাপন করছি আগের সেই স্বাভাবিক নিয়মে।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই খুশি ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সবার মাঝে।ঈদ এই দেশে শুধু ধর্মীয় উৎসবই না, সামাজিক উৎসবও। এই উৎসব সর্বজনীন।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর আজ। এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের ঘরে ঘরে খুশির বার্তা নিয়ে এসেছে ঈদ। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দুই বছর একরকম ‘ঘরবন্দি’ অবস্থায় কেটেছে দেশবাসীর ঈদ। ঈদের নামাজ কিংবা ঘোরাঘুরি দূরে থাক, এক বাড়িতে থেকেও একসঙ্গে ঈদ উপযাপন করতে পারেননি অনেকেই। একটি ঘরেই কোয়ারেন্টিন ঈদ কাটিয়েছেন কেউ কেউ।
তবে এবার দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এবারই কোনো রকম বিধিনিষেধ ছাড়াই ঈদ উপযাপন করছে দেশবাসী। বিপনিবিতান থেকে শুরু করে ঘরমুখো মানুষের চাপ মনে করিয়ে দিচ্ছিল করোনাকালের আগের সময়কে।
ফের মুসল্লিদের পদচারণায় মুখোরিত ঈদগাহ
করোনার কারণে উন্মুক্ত স্থানে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ মসজিদে পড়েছিলেন। ঈদের নামাজ আদায় করার পর প্রায় সবাই কোলাকুলি বা হাত মেলানো থেকেও বিরত ছিলেন। তবে এবার ফের ফের মুসল্লিদের পদচারণায় মুখোরিত হচ্ছে ঈদগাহ। করোনার বিধিনিষেধ পুরোপুরি না উঠলেও কোলাকুলিও করতে দেখা গেছে অনেককে।
চিরচেনা রূপে ঘরমুখো মানুষ
করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদে ছিল বিধিনিষেধ। ঈদের আগে কয়েকদিনের জন্য বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হলেও ঘরমুখী মানুষ পড়েছিলেন ভোগান্তিতে। গণপরিবহনের স্বল্পতা থাকায় অনেকেই পায়ে হেঁটেই রওয়া দিয়েছিলেন গন্তব্যের দিকে। পরবর্তীতে দেশের পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে ছিল অনেকের মধ্যেই অনিশ্চয়তা। তবে এবার করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মহামারির আগের চিরচেনা রূপে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঘরমুখো হতে দেখা গেছে মানুষকে। ঈদ শেষে ফেরার ক্ষেত্রেও নেই কোনো অনিশ্চয়তা।
বিপণিবিতানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়
নতুন পোশাক ছাড়া উৎসব জমে না। কিন্তু করোনাকালে সেই চিরচেনা সূত্র গিয়েছিল বদলে। লকডাউনের কারণে বন্ধ থাকা বিপনিবিতান অল্প সময়ের জন্য নানা বিধিনিষেধ মেনে খুললেও সচেতন অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নতুন পোশাক কিনতে মার্কেটে যাননি। কেউ কেউ অনলাইন থেকে পোশাক কিনলেও নতুন পোশাক ছাড়াই ঈদ কাটিয়েছেন অনেকেই। তবে এবার করোনার বেশিরভাগ বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় বিপনিবিতানগুলোতে ছিল উপড়েপড়া ভিড়। দীর্ঘ দুই বছর পর ব্যবসায়ীদের চোখে-মুখেও দেখা গেছে খুশির ঝিলিক।
পার্লারগুলোও ফিরছে চিরচেনা রূপে
রূপ সচেতন অনেকেই ঈদের আগে নিজের ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজটা পার্লারেই সেরে নেন। তবে করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদের আগে পার্লারগুলো বন্ধ ছিল। এবার ঈদের আগে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় অনেকেই শেষ মুহূর্তে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে ভিড় করেছেন পার্লারে। ফেসিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউরসহ বিভিন্ন সেবা নিতে দেখা গেছে অনেককেই।
আগের রূপে পর্যটন কেন্দ্রগুলো
রোজকার জীবনের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ঈদের ছুটিতে পাড়ি দেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে। তবে গত দুই বছর করোনার কারণে মানুষ যেখানে বাড়িই যেতে পারেনি, যেখানে পর্যটন কেন্দ্রগুলো যে ফাঁকা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে এবার সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় পর্যটকের ভিড় সামলাতে আগাম প্রস্তুত নিয়ে রেখেছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। মে দিবস আর ঈদের ছুটি মিলিয়ে এবার বেশি ছুটি থাকায় বিপুল সংখ্যক পর্যটকের উপস্থিত আশা করছেন দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোর হোটেল-মোটেল মালিকরা।
দেশবাসীকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ঈদের শুভেচ্ছা
মুসলিম জাহানের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসী ও বিশ্বের সকল মুসলমানকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
ঈদ উপলক্ষে তারা পৃথক দুই বাণীতে বাংলাদেশ, মুসলিম উম্মাহ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিশ্বশান্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন।
ঈদকে মুসলিম উম্মাহর সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া তার বাণীতে রাষ্ট্রপতি সকলের প্রতি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উৎসব উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
“ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই যাতে ঈদের আনন্দ সমানভাবে উপভোগ করতে পারে, সেজন্য মানবতার মুক্তির দিশারি হিসেবে ইসলামের মর্মার্থ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক, বিশ্ব ভরে উঠুক শান্তি আর সৌহার্দ্যে- পবিত্র ঈদুল ফিতরে এ আমার প্রত্যাশা।”
বাণীতে তিনি আরো বলেন, “ঈদুল ফিতর মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর অপার খুশি আর আনন্দের বারতা নিয়ে আমাদের মাঝে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে, গ্রামগঞ্জে, সারাবাংলায়, সারাবিশ্বে। এ দিন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে শামিল হন এবং ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেন। ঈদ সবার মধ্যে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর ঐক্যের বন্ধন। ঈদুল ফিতরের শিক্ষা সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক, গড়ে উঠুক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- এ প্রত্যাশা করি। ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। এখানে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, কূপমন্ডুকতার কোনো স্থান নেই। মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা ও সাম্যসহ বিশ্বজনীন কল্যাণকে ইসলাম ধারণ করে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে দেশবাসী ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনা করেন।
“ঈদ শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে মানুষ সাম্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঈদ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। ঈদের আনন্দ আমাদের সবার।”
“ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক- এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক। বিশ্বের সকল মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হোক- আজকের দিনে আমি মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।”
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকলকে গণ-জমায়েত এড়িয়ে চলার অনুরোধ করেছেন।