কক্সবাংলা ডটকম(৪ নভেম্বর) :: এক দশক ধরেই উচ্চপ্রবৃদ্ধি হচ্ছে দেশে। শিল্প ও কৃষিতে ভর করে এ প্রবৃদ্ধি ক্ষত বাড়াচ্ছে বনে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যও বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি বন উজাড় হয়েছে উচ্চপ্রবৃদ্ধির এই এক দশকেই। শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় বন উজাড়ের হার আবার আরো বেশি। শুধু গাজীপুরেই এক দশকে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৭৯ শতাংশ বনাঞ্চল।
রিমোট সেন্সিং তথ্যের ভিত্তিতে বনভূমির হিসাব করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। বনভূমির পরিমাণের পাশাপাশি বছরভিত্তিক বন উজাড়ের চিত্রও উঠে এসেছে এতে। মন্ত্রণালয়ের ওই তথ্যে বলা হয়েছে, ১৯৩০-৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বার্ষিক বন উজাড়ের হার ছিল দশমিক ৭৪ শতাংশ। ১৯৭৫-৮৫ সাল পর্যন্ত বন উজাড় হয় বার্ষিক দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে। ১৯৮৫-৯৫ সালে এ হার খানিকটা কমে দাঁড়ায় দশমিক ২৬ শতাংশ।
এরপর থেকে বন উজাড়ের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বন উজাড়ের নিট হার ছিল দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে বন উজাড় হয়েছে। এত বেশি হারে বন উজাড়ের ঘটনা এর আগে কোনো দশকেই ঘটেনি।
বনের এ ক্ষতের পেছনে শিল্পায়নকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। গাজীপুরের শালবন দখল করে ক্ষমতাধররা কারখানা গড়ে তুললেও তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ফলে কমছে এখানকার বনের পরিমাণ। তথ্যমতে, এক দশক আগেও গাজীপুরের মোট জমির প্রায় ১৪ শতাংশ ছিল বনাঞ্চল। এক দশকের ব্যবধানে বনাঞ্চল নেমে এসেছে মাত্র ৩ শতাংশে। অর্থাত্ এক দশকের ব্যবধানে বনের পাঁচ ভাগের চার ভাগই উজাড় হয়ে গেছে। গাজীপুরের এ বন থেকে হারিয়ে গেছে বনমোরগ, সজারু, খরগোশ, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণীও।
শিল্পায়নের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নয় সুন্দরবনও। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বনের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই গড়ে উঠেছে ১৮৬টি শিল্প-কারখানা। এর মধ্যে চালু রয়েছে দেড়শটির মতো। চালু শিল্প-কারখানার মধ্যে সিমেন্ট কারখানা রয়েছে ছয়টি ও এলপিজি বোতলজাত কারখানা আটটি। এছাড়া ওয়েল্ডিং ও লবণ-পানি শোধন কারখানা রয়েছে সাতটি করে, পাঁচটি করে রয়েছে বরফকল এবং কাঁকড়া চাষ ও হ্যাচারি।
তিনটি করে তেল পরিশোধন ও ইটভাটা এবং দুটি করে জাহাজ নির্মাণ ও ব্যাগ প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাইস মিল ৭৩টি। এর বাইরে ’স মিল রয়েছে ১৫টি। যদিও সুন্দরবনের আশপাশে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে।
সুন্দরবন ঘিরে বিদ্যমান এসব শিল্প-কারখানার পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগের এ বিদ্যুেকন্দ্র সুন্দরবনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এ নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।
শিল্পায়নের পাশাপাশি বন উজাড়ে ভূমিকা রাখছে উচ্চপ্রবৃদ্ধির আরেক চালক কৃষিও। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত এক দশকে অর্থাত্ ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উজাড় হওয়া বনভূমির প্রায় ৪০ শতাংশই কৃষিজমিতে রূপান্তর হয়েছে। যদিও ১৯৯৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ হার অনেকটা কম ছিল। ওই সময় কৃষিজমিতে রূপ নিয়েছিল উজাড় হওয়া মোট বনভূমির ২৭ শতাংশের মতো।
কৃষিনির্ভর জীবিকার কারণেই বিপুল পরিমাণ বনভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তর হয়েছে বলে জানান উপপ্রধান বন সংরক্ষক আব্দুল মাবুদ।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় এমনিতেই ভূমির স্বল্পতা রয়েছে। আবার বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা এখনো কৃষিনির্ভর। এ কারণেই এমনটা হচ্ছে। এভাবে বনভূমি কৃষিতে ব্যবহারের মাধ্যমে হয়তো কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে এভাবে বনভূমিকে কৃষিজমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আসলে বনায়নে বিনিয়োগস্বল্পতা এ পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। আর মানবসৃষ্ট বন উজাড় পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলছে।
তবে বনায়ন বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি বনায়নের লক্ষ্যে বন বিনিয়োগ পরিকল্পনার খসড়াও তৈরি করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। বৈশ্বিক ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট তহবিল থেকে বনায়নের কাজে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এ চেষ্টা চলছে। এর ধারাবাহিকতায় একটি বন বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা ফরেস্ট ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্র্যাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) পরিচালক মোতালেব হোসেন সরকার বলেন, বৈশ্বিক ২৫ শতাংশের মানদণ্ডে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার দৌড়ে আমরা হয়তো কিছুটা দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু আশার কথা হলো, গ্রিন বেল্টসহ সরকারের সাম্প্রতিক বেশকিছু উদ্যোগে বনের আয়তন ১৭ দশমিক ৫ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হারে বাড়বে। আমরা সরকারকে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছি। এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে দু-তিন বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে বনায়নের লক্ষ্যে।
বাংলাদেশের বনভূমি পাহাড়ি, সমতলের ও ম্যানগ্রোভ— এ তিন ভাগে বিভক্ত।
এর বাইরে রয়েছে উপকূলীয় বন, রক্ষিত বন, ভেস্টেড বন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বনাঞ্চলের পরিমাণ ২৬ লাখ হেক্টর। মোট আয়তন বিবেচনায় দেশের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ স্থানজুড়ে ছড়িয়ে আছে এ বনাঞ্চল। এর মধ্যে পাহাড়ি বনের পরিমাণ ৬ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর। উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় বনায়নের পরিমাণ যথাক্রমে ৬ লাখ ও ১ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর।
এছাড়া শালবনের পরিমাণ ১ দশমিক ২ লাখ হেক্টর। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় অশ্রেণীভুক্ত বন রয়েছে ৭ দশমিক ৩ লাখ এবং গ্রামীণ বন ২ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর। সব ক্ষেত্রেই বন উজাড়ের ঘটনা ঘটছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, বনায়ন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিনিয়োগ পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থায়নের নিশ্চয়তা পেলে বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
Posted ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৪ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta