কক্সবাংলা ডটকম(২৫ জুলাই) :: বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগী নন-ভ্যাকসিনেটেড বা টিকাপ্রাপ্ত নন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই গ্রামের, যাদের বেশিরভাগই আবার বয়স্ক। তাই গ্রামাঞ্চলের বয়স্ক মানুষদের টিকার আওতায় আনলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বাস্তবতায় মৃত্যু কমাতে আগামী মাস থেকে গ্রামে গ্রামে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর এ তথ্য জানান।
ডা. এস এম আলমগীর বলেন, ভ্যাকসিনে মৃত্যু কমে সেটি প্রমাণিত। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে গ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। তাই গ্রামের অধিক সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে গ্রামে শিশুদের ইপিআই টিকা দেওয়ার মত ক্যাম্পেইন করে কোভিডের ভ্যাকসিন দেয়া হবে। দুই-একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে জানাবেন।
এ কর্মসূচির আওতায় গত ৭ আগস্ট থেকে পরবর্তী সাতদিনে ৬০ লাখ মানুষকে টিকাকরণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ভ্যাকসিন নিয়ে গত চার মাস কিছুটা সংকট থাকলেও এখন তা কেটে গেছে বলে মনে করছে সরকার। নিয়মিত টিকার ডোজ আসতে শুরু করেছে এবং পরিকল্পিতভাবেই টিকা দেওয়া হচ্ছে।
সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রোববার (২৫ জুলাই) এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিকল্প নেই। তাই মাসে এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আমরা এখন পর্যন্ত ২১ কোটি ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছি।
গ্রামের মানুষকে টিকার আওতায় আনতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা হবে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী বলেন, গ্রামের যারা সুরক্ষা অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না, তাদের অনলাইন নিবন্ধন ছাড়া এনআইডি দেখে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। প্রয়োজনে পরে সেসব নাম অনলাইন নিবন্ধন করে নেওয়া হবে।
দেশে গত ২৬ জানুয়ারি ভ্যাকসিনের জন্য নিবন্ধন শুরু হয়, সেসময় নিবন্ধনের বয়স ছিলো ৫৫ বছর। পরে তা কয়েক দফা কমিয়ে এখন ৩০- এ নামিয়ে আনা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এর আগে শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বিঘ্ন রাখতে এবং বেশির ভাগ নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে এখন থেকে পর্যায়ক্রমে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিককেই টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যেই সরকারের আইসিটি বিভাগের আওতাধীন জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের শিক্ষার্থী ও ফ্রন্টলাইনারদের পরিবারের সদস্যরা যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারে- সে ব্যাপারে একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
দেশে এখন পর্যন্ত ২ কোটি ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এসেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে মডার্না ভ্যাকসিনের ৫১.৯৩ লাখ ডোজ, ফাইজারের ৫০ হাজার এবং সিনোফার্মের ৩৯.২২ লাখ এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ২.৪৪ লাখ ডোজ রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বর্তমানে সরকারের হাতে এক কোটি ডোজের বেশি টিকা আছে। আগামী মাসের মধ্যেই আরো দুই কোটি ডোজ টিকা সরকারের হাতে চলে আসবে। এভাবে চীন থেকে তিন কোটি, রাশিয়া থেকে সাত কোটি, জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি ভ্যাকসিন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকাসহ আগামী বছরের শুরুর দিকেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। ঠিক সময়ে এসব ভ্যাকসিন পেলে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশে এখন সিটি করপোরেশন এলাকায় মর্ডানার টিকা ও সিটি করপোরেশনের বাইরে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে সম্মিলিত ভাবে টিকা কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। তাহলেই আমরা কোভিড-১৯ মহামারিকে অতিক্রম করতে পারবো। জাপান থেকে আসা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ শিগগিরই দেওয়া শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে গত ২৫ এপ্রিল ডোজ সংকটের কারণে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে সরকার। এরপর আবার ১ জুলাই থেকে প্রবাসী শ্রমিক, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাধ্যমে আবার গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখন দিনে গড়ে ৫০ হাজার মানুষ মর্ডানা, ফাইজার ও সিনোফার্মের ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। ২৭ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন এক কোটি ২০ লাখ ৭২ হাজার মানুষ।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে টিকা সংকট কেটে গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল এক পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে ২১ কোটি টিকা আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় নাগাদ আসবে। যে সমস্ত টিকা বাংলাদেশে আসছে তার মধ্যে রয়েছে চীনের সিনোফার্মের টিকা, অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা, ফাইজারের টিকা, মর্ডানার টিকা, জনসন এন্ড জনসনের টিকা এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা। এই টিকাগুলোর একেকটি একেক রকম। কিছু কিছু টিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, কিছু কিছু টিকা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
তাহলে প্রশ্ন উঠলো, কোন টিকা কে পাবে? ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফাইজারের টিকা অভিবাসীদের, প্রবাসী বাঙ্গালীদের দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী অভিবাসন প্রত্যাশী কিছু মানুষ ফাইজারের টিকা দিয়েছেন।
আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ফাইজারের টিকা ঢাকার বাইরে যাওয়া সম্ভব না। কারণ, মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ করতে হয় যেটি ঢাকার বাইরে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। কাজেই ফাইজারের টিকা ভবিষ্যতে এলেও যে সেটি ঢাকার বাইরে যাওয়া যাবে না সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। মর্ডানার টিকাও একইরকম। এখনো সরকার মর্ডানার টিকাগুলোই দেওয়া শুরু করছে। মর্ডানার টিকাগুলো ঢাকাতেই দিচ্ছে। ঢাকার বাইরের চীনের সিনোফার্মের টিকা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত হলেও ইউরোপ আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে এই টিকা অনুমোদিত নয়। ফলে এই টিকা নিয়েও একজন নাগরিকের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। তাছাড়া সিনোফার্মের টিকার কার্যকারিতা ৮০ শতাংশের নিচে।
এরকম অবস্থায় এ টিকা ব্যাপকভাবে দিয়েও কতটুকু লাভ হবে সে নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। অবশ্য এর মধ্যে জনসনের টিকা এসেছে। জনসনের টিকা ১ ডোজ টিকা। কিন্তু এরও কার্যকারিতা কম। তবে এই টিকা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং স্বীকৃত। আর স্পুটনিক-ভি টিকাকে অনেক কার্যকর করা বলা হয় কিন্তু স্পুটনিক-ভি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এখন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। তবে বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত টিকাগুলোর মধ্যে হচ্ছে স্পুটনিক-ভি টিকা।
বিভিন্ন রকমের টিকা ব্যবস্থাপনা এবং কাকে কোন টিকা দেওয়া হবে সেটি এখনই নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা এবং তিনি টিকা নিয়ে একটি সুস্থ কর্মপরিকল্পনা এখন থেকে তৈরি করতে হবে। কারণ এর আগে দেখা গেছে যে, সেরাম ইন্সটিটিউটের টিকা যখন বাংলাদেশে এলো তখন সেই টিকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হয়নি। যার ফলে প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। সেই ১৮ লক্ষ মানুষ এখনও দ্বিতীয় ডোজের টিকা পায়নি।
আশার কথা হলো যে, জাপান থেকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকা এসেছে সেই টিকা দিয়ে হয়তো কিছু মানুষের প্রয়োজন মেটানো যাবে। বাকি প্রয়োজন মিটানোর জন্য আমাদের কোথাও অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ভারত ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে, তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে তারপর তারা বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশগুলোকে টিকা রপ্তানি করবে। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, খুব সহসা সেরাম ইন্সটিটিউটের টিকা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
টিকার জন্য আমাদের মূলত নির্ভর করতে হচ্ছে চীনা টিকা, জনসন এন্ড জনসনের টিকা এবং রাশিয়ার টিকা। এই টিকাগুলো কোথায় কিভাবে কাকে দেয়া হবে তার একটি সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা দরকার। এখন টিকা নিয়ে নিবন্ধন চলছে। কিন্তু গ্রামের হতদরিদ্র মানুষেরা নিবন্ধনের আওতায় আসছে না। এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ যে নিবন্ধন করেছেন তা শহরকেন্দ্রিক এবং নিবন্ধনের জন্য তার তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষেরা এই তথ্য প্রযুক্তির আওতায় এসে নিবন্ধিত হচ্ছেন না।
তাছাড়া তাদের নিবন্ধনের আগ্রহ কম। এজন্যই বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচীর মত করোনার টিকাদানেরও একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার যে কর্মসূচির আওতায় সকলেই টিকা দিতে পারবে। না হলে বাংলাদেশেও টিকা বৈষম্য সৃষ্টি হবে। নাগরিক শিক্ষিত মানুষজন টিকা নেবে কিন্তু গ্রামের মানুষজন টিকার প্রবেশগম্যতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সে বিষয়টি এখনই নজর দেয়া দরকার।