কক্সবাংলা ডটকম(৫ মার্চ) :: এ দেশের কালযাত্রায় প্রতিটি সন্ধিক্ষণে আন্দোলন-সংগ্রামের লড়াকু ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে আছে। অনন্য সাধারণ প্রতিভাধর নেতৃত্বের কারণে অনেক আন্দোলন রূপ নিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে। রাজপথ জেগে উঠেছে উত্তাল জনস্রোতে। অসম নেতৃত্ব কখনো কখনো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো সম্মোহন তৈরি করেছে জনতার মাঝে।
একাত্তরে বিশ্বকাঁপানো মুক্তিযুদ্ধে গোটা দেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে। তার আগে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে মানুষ মৃত্যুকে তুচ্ছ করে রাজপথে নেমেছে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারককেও জনরোষের মুখে পালিয়ে যেতে হয়েছিলো। এসবই সম্ভব হয়েছিলো ক্যারিশম্যাটিক বা সম্মোহনী শক্তিধর নেতৃত্বের কারণে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন।
সরকারবিরোধী শক্তির রাজপথের আন্দোলনে আপামর জনগনের তেমন সাড়া দেখা যায় না। কারণ হিসাবে ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, গবেষকরা গণমানুষের সর্বজনীন দাবি, আকর্ষণীয় নেতৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা, সম্মেহনকারী বাগ্মিতার অভাবের কথা তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, হাল আমলে রাজনৈতিক দলগুলোতে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব না থাকায় তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে আর ’জনস্রোত’ তৈরি হয় না।
বিগত বছরগুলোতে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী শক্তির দাবি আদায়ের আন্দোলনগুলোতে জনগনের ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহন কমই দেখা গেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বড় দুটি আন্দোলন করেছে বিএনপি।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে টানা ৯৪ দিন হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে দলটি। তবে এই আন্দোলনে রাজপথে নেতা-কর্মীদের ঢল নামার বদলে জ্বালাও-পোড়াও-নাশকতা হয়েছে বেশি।
এতে নেমে মামলা-গ্রেফতার-হুলিয়ার শিকার হয়ে দলের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তারপর আর রাজপথে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা যে সব কর্মসূচি পালন করে আসছে তাতে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো নয়।
বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর সামপ্রতিক সময়ে যেসব বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে সেসবও দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে না। তার কারাবন্দিত্ব নিয়ে যাদের মধ্যে সহানুভুতি কাজ করছে, তারাও রাস্তায় নামছেন না।
অভিজ্ঞজনরা বলছেন, সরকারি দল এবং প্রশাসন নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়লেও প্রতিবাদের জন্য বিরোধী শক্তির নেতা-কর্মীরা নামছে না। এই দশার মধ্যে বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করছেন, জনস্রোত রাস্তায় নামাতে না পারলে বিরোধী শক্তি তাদের দাবিগুলো পূরণ করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে অভাবনীয় কিছুর প্রত্যাশা করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর কী।
এই প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে কথা বলেছেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপির জনসমর্থন আছে। কিন্তু আন্দোলনে জনজোয়ার সৃষ্টি করার মতো নেতৃত্ব নেই। তাদের সমস্যা এখন দুটি। প্রথমত নেতৃত্ব, দ্বিতীয়ত সাংগঠনিক দুর্বলতা। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াও করেছে। যা জনগন প্রত্যখ্যান করেছে। বর্তমানে বা আগামীতে এই ধরনের ‘জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন’ করার শক্তি-সামর্থ তাদের নেই।
তারা দাবি আদায় করার জন্য আন্দোলন করছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। কিন্তু জনজোয়ার বা জনস্রোত দেখা যাচ্ছে না। শেষ সময়ে আন্দোলনে নামতে চান তারা। তাতে বিপ্লব সৃষ্টির মতো জনস্রোত ঘটবে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই অভাবনীয় কিছুর প্রত্যাশা করতে পারে হয়তো।
আনোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সম্মোহনী নেতৃত্বের অধিকারী। জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত উপাধি ছিলো ’বঙ্গবন্ধু’। তার ক্যারিশমাটিক লিডারশিপ জনগনকে মোহিত করে রেখেছিলো। ছয় দফা আন্দোলনে অন্যসব নেতাকে ছাড়িয়ে জনগনের মধ্যে পৌঁছান তিনি। মানুষের জন্য তার দরদ ছিলো। আকর্ষণীয় বাগ্মিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা ছিলো। তার আহবানে একেবারে স্রোতের মতো মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তো রাজপথে। বঙ্গবন্ধুর পরে সেই রকম নেতৃত্বের আবহ আর পাচ্ছি না।
আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, বর্তমানে কোন নেতা-নেত্রীর আহবানে রাজপথে জনস্রোত নামছে না। তার অন্যতম কারণ হলো ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপের অভাব এবং জনগনের সর্বজনীন দাবিতে কোন কর্মসূচি নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তার ছয় দফা ছিলো ছিলো সাত কোটি মানুষের প্রাণের দাবি। মানুষের বাঁচা-মরার দাবি। তার আহবানে স্রোতের মতো মানুষ নেমে এসেছিলো। সেই নেতৃত্ব দুর্লভ।
তিনি বলেন, বিএনপির দাবিগুলো সর্বজনীন মনে হয় না। তাদের আন্দোলনে রাজপথে তেমন লোকজন নামছে না। জনস্রোত না নামলে সামান্য আন্দোলনে তাদের দাবি আদায় সম্ভব নয়। এই অবস্থায় অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশা করতে পারে বিএনপি।
তাছাড়া তাদের কর্মকাণ্ড যা দেখছি তাতে দাবি পূরণ করে ক্ষমতায় আসা দুরূহ। আবুল কাশেম বলেন, বিএনপির ওপর দমন-পীড়ন চলছে। খালেদা জিয়া জেলে। এতে বিএনপি এবং বেগম জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি কাজ করছে। তবে তারা এটা দিয়ে তো গণজোয়ার তৈরি করতে পারবে না। শেখ হাসিনা অনেক শক্তিশালী। তার নেতৃত্বও শক্তিশালী। তাকে নাড়ানোর মতো গণজাগরণ সৃষ্টি করা বিএনপি নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব নয়।
নেহাল করিম বলেন, সরকারবিরোধী পক্ষে এমন নেতৃত্ব নেই যে তার কথায় জনস্রোত নেমে পড়বে আর দাবি আদায় হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়বে না। তারা হয়তো বিএনপির সাথে আসন ভাগাভাগির প্রস্তাব দিতে পারে।
তিনি বলেন, পরাশক্তিগুলো এখানে এসে দেন-দরবার করছে। তবে কিছু হবে না। বছর শেষের দিকে বিএনপি মরণ কামড় দিতে পারে। তবে জনস্রোত-গণজোয়ার নামাতে না পারলে কিছু হবে না। যেটা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বিএনপি হয়তো প্রত্যাশা করছে অভাবনীয় কিছু ঘটবে। আমার মনে হয় সে রকম কিছুই হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব সমপ্রদায়ের কতটুকু মাথাব্যথা আছে বা আদৌ আছে কিনা সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাইরের দুনিয়া মনে নেবে না, চাপের মুখে সরকার দ্রুত একটি নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে বলে যারা মনে করেছিলেন তারা কিন্তু হতাশ হয়েছেন। সেই নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হলো সে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে দেশি-বিদেশি কারো কোনো সমস্যা হয়নি।