কক্সবাংলা ডটকম :: মহামারী সৃষ্ট স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতেই দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি নিত্যনতুন রেকর্ড তৈরি করছে। ডিসেম্বরে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৩ শতাংশেরও বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে আমদানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫৪ শতাংশ। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি প্রবৃদ্ধি সরকারের চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি করেছে।
নভেম্বর পর্যন্ত কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৬১৮ কোটি ডলার। যদিও আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৩৫৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল চলতি হিসাবে। আমদানি প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। এ অবস্থায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের বিদ্যমান সংকট ভয়াবহ মাত্রায় গিয়ে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রেকর্ড আমদানির চাপ সামলাতে প্রায় প্রতিদিনই বাজারে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে রিজার্ভ থেকে ২৫০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তার পরও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ১০ জানুয়ারী ডলারের দাম ৮৬ টাকা ১০ পয়সা পর্যন্ত উঠেছে। যদিও ঘোষিত দরের চেয়েও অন্তত ২ টাকা বেশি দরে ব্যাংকগুলো ডলার লেনদেন করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) প্রতি ডলারের দাম ৯২ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। গতকালও কার্ব মার্কেটে ৯১ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই চলতি হিসাবে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটি শঙ্কার। বছর শেষে যদি এ ঘাটতি ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডলারের দাম পর্যায়ক্রমে বাজারের চাহিদার ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, চাহিদার সঙ্গে জোগানের সমন্বয় না হওয়ার কারণেই দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারে ডলারের দামে বড় ধরনের তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে। দুই বাজারের মধ্যে ডলারের দামের ব্যবধান না কমালে হুন্ডি তত্পরতা বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, এরই মধ্যে চলতি হিসাবে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটি বছর শেষে ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। এ ঘাটতি কোত্থেকে পরিপূরণ হবে, সেটি স্পষ্ট নয়। রিজার্ভে থাকা ডলার দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত দুর্বল হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কমে যাবে। সে পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয়, এজন্য এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানি কমানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ডলারের বিপরীতে কৃত্রিমভাবে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখে কোনো লাভ নেই। বরং ধীরে ধীরে চাহিদা ও জোগানের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দিতে হবে। এতে টাকার অবমূল্যায়ন হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য কল্যাণ হবে। ব্যাংকের চেয়ে খুচরা বাজারে ডলারের দাম অনেক বেশি হলে অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২১) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ২৩ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ কম। একই সময়ে দেশ থেকে ২ হাজার ৪৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাবদ গত ছয় মাসে দেশে ৩ হাজার ৪৯২ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে। যদিও জুলাই-নভেম্বর ২০২১ সময়েই পাঁচ মাসে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হওয়ায় নভেম্বর শেষে সরকারের চলতি হিসাবে ঘটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১৮ কোটি ডলার। ২০২০ সালের একই সময়ে উল্টো ৩৫৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল চলতি হিসাব। চলতি হিসাবের বড় ঘাটতি রাষ্ট্রের ব্যালেন্স অব পেমেন্টকেও (বিওপি) নেতিবাচক ধারায় নামিয়ে এনেছে। গত বছরের অক্টোবর শেষে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৩৪ কোটি ডলার। বছর শেষে এ ঘাটতি অনেক বড় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২৫০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রির চাহিদাও বাড়ছে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার কিনেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি না করলে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো। এতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যেত।
দেশের আমদানি ব্যয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার থেকে কিনে নেয়া ডলারে গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তরতর করে বেড়েছে। যদিও গত ছয় মাসে রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। ৫ জুনায়ারি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত বছর রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, যেসব ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় ভালো, তারা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। এ ব্যাংকগুলোকে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না। কিন্তু যে ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় ভালো নেই, তাদের অবস্থা খারাপ। তবে ডলারের বাজার এখনো একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়নি। চাইলে কোনো না কোনোভাবে বাজারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে।
Posted ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারি ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta