কক্সবাংলা ডটকম(৩ আগস্ট ) :: সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কম সময়ে বেশি সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে আগামী ৭ আগস্ট থেকে বিশেষ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ৬ দিনে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।
ক্যাম্পেইন শেষ হলেও চলমান টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় প্রতি মাসে এক কোটি মানুষকে কোভিড প্রতিষেধক দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ হিসাবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় আসবে।
মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে হবে:
ওয়াশিংটন ভিত্তিক দাতাগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, আগামী ৬ মাসের মধ্যে ৪০ শতাংশ নাগরিককে টিকা দিতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহজ হবে। এ হিসাবে প্রতিদিন টিকা দিতে হবে ছয় লাখ নাগরিককে, যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এবারের বিশেষ টিকাকরণের কার্যক্রম শুরু করছে সরকার। যা আরও কয়েক ধাপে করতে হবে।
তবে শুরুতে টিকাদানে এশিয়ার অনেক দেশের চাইতে এগিয়েই ছিল বাংলাদেশ। গতবছরে প্রণীত টিকাকরণের মহাপরিকল্পনায় সরকার ২০২১ সাল থেকে শুরু করে দুই বছরে তিন ধাপে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ বা ১৩ কোটি ৮২ লাখ নাগরিককে টিকাদানের লক্ষ্য নেয়। তবে ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা সরবরাহের অচলাবস্থা এ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নির্ধারিতে সময়ের চেয়ে পিছিয়ে দেয়।
সরকারের পরিকল্পনায় টিকাকরণে মোট ৬,৮১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৪,৩১৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল শুধু টিকা কেনার জন্যই। দেশের সবচেয়ে বড় এ টিকাদান কর্মসূচিতে প্রথম বছরে প্রায় সাত কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য ছিল।
এছাড়া, মডার্না ও ফাইজারের তৈরি তাপ সংবেদনশীল টিকা পরিবহন ও সংরক্ষণের কথা মাথায় রেখে মহাপরিকল্পনায় উপযুক্ত হিমচক্র ব্যবস্থার প্রয়োজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
এরপর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাকে অনুমোদন দেওয়া হলে, সরকারের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়ে পড়ে; টিকাটি ২-৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো সাধারণ তাপাঙ্কে সংরক্ষণ ও পরিবহনের সুবিধা থাকায় এ সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে ভারত হঠাৎ করেই টিকা ডোজ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে হোঁচট খায় বাংলাদেশের টিকাকরণ কর্মসূচি। পরে চীনা কোম্পানি সিনোফার্মের টিকার মাধ্যমে আবারও টিকাদান শুরু হয়।
অবশ্য, ধীরে ধীরে মডার্নার টিকাকে পরবর্তীতে গণটিকাকরণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়, একইসাথে সীমিত পরিমাণে ফাইজার টিকাও দেওয়া হচ্ছে।
এ বাস্তবতায় আগামী ৭ আগস্ট থেকে শুরু হতে চলা বিশেষ কর্মসূচি জাতীয় মহাপরিকল্পনাতে প্রাণ সঞ্চার করবে; কারণ এর মাধ্যমে প্রতিমাসে এক কোটি নাগরিককে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এভাবে আগামী বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি নাগাদ মোট ৭ কোটি মানুষকে টিকা দিতে চাইছে সরকার।
সবকিছু নির্ভর করছে ভ্যাকসিন সরবরাহের ওপর:
এব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, ছয়দিনের ক্যাম্পেইন শেষে স্বাভাবিক টিকা কার্যক্রম চলবে। আগামী মাসে আবার ক্যাম্পেইন করে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া হবে।
“ভ্যাকসিন পাওয়া সাপেক্ষে আবারো ক্যাম্পেইন করার পরিকল্পনা রয়েছে। ক্যাম্পেইন ছাড়াও প্রতি মাসে এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ভ্যাকসিন পাওয়ার ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে। তবে ঠিক সময়ে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে আমরা আশাবাদী,” যোগ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে এখন সিনোফার্মের ৫৫.৭৬ লাখ ডোজ, মর্ডানার ৪৭.৩৫ লাখ, ফাইজারের ৫০ হাজার ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৩ লাখ ডোজ টিকা রয়েছে। ক্যাম্পেইনের আওতায় শহরে মর্ডানা ও গ্রামে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দেয়া হবে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আগস্টের মধ্যে দেশে দুই কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসবে। আগামী বছরের শুরুর মধ্যেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। এর মাধ্যমে দেশের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে সক্ষম হবে সরকার।
দেশের এক কোটি ৩৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮১১ জন মানুষ করোনার টিকার আওতায় এসেছে । এদের মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৯১ লাখ ৮ হাজার ১৪৪ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৭ জন।
তবে গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত আইএমএফের হিসাব অনুসারে চলতি বছরের শেষ নাগাদ মোট জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে হলে বাংলাদেশকে প্রতিদিন ৬ লাখ ৮ হাজার ৭৯৬ জনকে টিকা দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা রয়েছে, ক্যাম্পেইনের আওতায় সারাদেশের গ্রামাঞ্চল, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মিলিয়ে ১৫,২৮৭টি ওয়ার্ডে ৬ দিনে এক কোটি ৩৪ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে বেলা তিনটা পর্যন্ত টিকাদান চলবে, টিকা পেতে অগ্রাধিকার পাবেন নারী ও বয়োবৃদ্ধ নাগরিকগণ।
বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হিমচক্র; ২-৮ ডিগ্রী তাপমাত্রায় রাখতে হয় এমন তিন কোটি ডোজ টিকা সংরক্ষণ করতে পারবে।
এছাড়া, মাইনাস ১৫-২৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় দেড় কোটি ডোজ এবং মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখতে হয় এমন ৩৫ লাখ ডোজ টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাকরণ পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সেখানে আরও বলা হয়, শিশুদের সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচির গুদামসহ বেক্সিমকো ও ইনসেপ্টা ফার্মা এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) হিমাগার ব্যবহার করবে সরকার।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসির) এর চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী এয়ারপোর্টে অবস্থিত বিএডিসির বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজের দুটি চেম্বার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হয়েছে। এর একটিতে গতকাল (রোববার) থেকে টিকা সংরক্ষণ শুরু হয়েছে।”
ড. অমিতাভ সরকার বলেন, এয়ারপোর্টের কোল্ড স্টোরেজে মাইনাস ২৫ ডিগ্রী পর্যন্ত তাপমাত্রা সংরক্ষণ করা যায়। এটি করোনা ভ্যাক্সিন সংরক্ষণের জন্য উপযোগী। তবে সরাদেশে ভ্যাক্সিন সংরক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিএডিসির কোল্ড স্টোরেজ ব্যবহারের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিএডিসি’র স্থাপনা ব্যবহারের বিষয়ে তাঁকে এখনও কিছু জানায়নি বলেও উল্লেখ করেন অমিতাভ সরকার।
পর্যাপ্ত জনবল যোগাড় করাও একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে:
শিশুদের টিকাকরণের ইপিআই কর্মসূচির হেলথ অ্যাসিসটেন্টরাই ছয় দিনের বিশেষ কার্যক্রমের সময় কোভিড-১৯ টিকা দেবেন।
এব্যাপারে বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিসটেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রবিউল ইসলাম খোকন বলেন, ক্যাম্পেইনে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ চলছে। দেশে এখন ১৫ হাজার হেলথ অ্যাসিসটেন্ট আছে, তারাই ভ্যাকসিন দেবেন। আর হেলথ অ্যাসিসটেন্টদের সহযোগীতা করবে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা।
দেশে হেলথ অ্যাসিসটেন্টের ৫০ শতাংশ পদ খালি থাকায় কোভিড ভ্যাকসিনেশনে জনবল সংকট একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
এব্যাপারে ডা. এ বি এম মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, “বৃষ্টির কারণে দুর্গম ও দুর্গত এলাকাতে মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আসেবে কিনা- তা নিয়ে আমাদের শঙ্কা রয়েছে। তবে আমরা টার্গেট করছি স্কুলগুলোতে বেশি সেন্টার করার যাতে বৃষ্টিতেও ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমে সমস্যা না হয়।”
গ্রামীণ কেন্দ্রগুলোতে প্রস্তুতির তোড়জোর:
বিশেষ টিকা কর্মসূচি শুরু করতে এরইমধ্যে তোড়জোর শুরু হয়েছে গ্রামীণ জনপদে। কর্মসূচির জন্য ভ্যাকসিন এরইমধ্যে উপজেলায় পৌঁছে গেছে। ক্যাম্পেইনে টিকাদানে যারা যুক্ত থাকবেন তাদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।
অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন না করলেও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে ক্যাম্পেইনে ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে। ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে উপজেলার জনপ্রতিনিধি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে মিটিং করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
Posted ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৩ আগস্ট ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta