চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে আগের বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় ৯ শতাংশের বেশি।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৮টি ব্যাংকের নিট মুনাফাই গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে। তালিকাভুক্ত ১১টি ব্যাংকের বাড়লেও সার্বিক নিট মুনাফা প্রবৃদ্ধিতে তা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
২০১৭ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর সার্বিক নিট মুনাফা ৪ হাজার ৭২১ কোটি টাকা হলেও চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।
তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিট মুনাফা সবচেয়ে বেশি কমেছে এক্সিম ব্যাংকের, ৯০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০১৭ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটি ১৭৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা নিট মুনাফা করলেও চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের নিট মুনাফাও চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ৮০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটি কর-পরবর্তী প্রায় ৬১ কোটি টাকা মুনাফা পেলেও চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকায়।
মুনাফা কমার বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মামুন-উর রশিদ বলেন, বছরের শুরু থেকেই প্রাপ্য আর প্রদেয় সুদের একটি ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়ে গেছি আমরা। এর মধ্যেও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। তবে মুনাফায় কিছু ছাড় দিতে হয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের কোর ব্যাংকিংয়ের পারফরম্যান্স নিয়ে আমি কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট। কিন্তু এ বছর শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট সাবসিডিয়ারিগুলোর আয় ও মুনাফা দুটোই অনেক কমে গেছে।
এ বিষয়টিও কনসলিডেটেড ফিগারকে প্রভাবিত করেছে। তবে আগামী দিনগুলোয় ব্যাংকের মুনাফা নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী। প্রতিকূল পরিস্থিতি নিশ্চয়ই সাময়িক।
নিট মুনাফা কমেছে ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডেরও। ২০১৮ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছে ৫৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৯৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ৬৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
৬১ দশমিক ১২ শতাংশ নিট মুনাফা কমেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের। গত বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ব্যাংকটি ১৯৯ কোটি টাকা নিট মুনাফা করলেও এ বছর তা ৭৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ট্রাস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ৯৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে। যদিও গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ১৭৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংকটির নিট মুনাফা কমেছে ৪৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।
এর বাইরে এবি ব্যাংকের নিট মুনাফা প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে ৩০ কোটি ৯০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ধারাবাহিকতায় নিট মুনাফা পায়নি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ব্যাংকটির নিট মুনাফা ৪০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ৪০ লাখ টাকায়।
এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের নিট মুনাফা ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯ কোটি ২৭ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ কমে ১৮ কোটি ৯৬ লাখ এবং ইউসিবির ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইস্টার্ন ব্যাংকের নিট মুনাফাও চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ কমেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমে দাঁড়িয়েছে ২১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকায়।
এছাড়া প্রাইম ব্যাংকের নিট মুনাফা ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমে ১৩০ কোটি ৪২ লাখ, সিটি ব্যাংকের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমে ২২৪ কোটি ৯৬ লাখ, উত্তরা ব্যাংকের ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে ১০৪ কোটি ৫০ লাখ, ঢাকা ব্যাংকের ৫ শতাংশ কমে ১০২ কোটি ৬৬ লাখ, এসআইবিএলের ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ কমে ৬৯ কোটি ৪৭ লাখ ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ২ দশমিক ৬২ শতাংশ কমে ২২০ কোটি ২৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফাও সামান্য কমে ৩৯৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা হয়েছে।
অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা কমে যাওয়ার বিষয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের কারণেই অধিকাংশ ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে। তাছাড়া আমানতের প্রবৃদ্ধিও গত বছরের মতো ছিল না এ বছর। ব্যাংকিং খাতের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাওয়ার কারণে স্প্রেড কমে গেছে, যা মুনাফার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
এর মধ্যেও তালিকাভুক্ত যেসব ব্যাংকের নিট মুনাফা বেড়েছে, সেগুলোর একটি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ব্যাংকটির নিট মুনাফায় ১৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছে ১১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
সব সেগমেন্টেই ভালো ব্যবসা হওয়ায় নিট মুনাফা বেড়েছে বলে জানান ব্যাংকটির এমডি আনিস এ খান। তিনি বলেন, পাশাপাশি এ সময়ে আমরা খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সঞ্চিতিও সংরক্ষণ করেছি।
পূবালী ব্যাংকের নিট মুনাফা ৭৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেড়ে ২৬৮ কোটি ৬২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। মুনাফা প্রবৃদ্ধিতে ব্যাংকটি দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ হালিম চৌধুরী বলেন, গত বছর আমরা বড় অংকের সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছিলাম, যার সুফল এবার পেয়েছি। এ বছরও আমরা অতিরিক্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে রেখেছি, যাতে করে পরে কাজে লাগানো যায়।
গত বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে নিট মুনাফায় প্রায় ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে যমুনা ব্যাংকের। এ বছর ব্যাংকটি ১৬৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে।
যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল আলম বলেন, বছরজুড়েই আমানত সংগ্রহ নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। আবার ঋণ বিতরণেও খুব সতর্ক থাকতে হয়েছে। এসব প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই আমরা ব্যালান্স শিট বড় করেছি। ঋণ-আমানত দুটোতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করেছি, যাতে নতুন করে কোনো ঋণ অনিয়মিত না হয়।
করপোরেট ঋণে আমরা খুব ভালো প্রস্তাবগুলোয় সাড়া দিয়েছি, এসএমইতে আমাদের এক্সপোজার বেড়েছে। সব মিলিয়ে প্রথম তিন প্রান্তিকে পরিচালন মুনাফায় সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি ছিল। নিট মুনাফা পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হার আরো বেড়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার এ বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে নিট মুনাফা হয়েছে ২০১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৪১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ৪১ দশমিক ৯৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ব্যাংকটি মুনাফা বাড়ার তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। এনসিসি ব্যাংকের নিট মুনাফা ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়ে এ বছর ১৫৪ কোটি ২০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এ বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মুনাফা ৩০ শতাংশ বেড়ে ২৬৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়ে ২৩৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে এনবিএলের। ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়ে ৩৪৪ কোটি ১৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৩৩৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
এদিকে, বরাবরের মতোই লোকসানের বৃত্তে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এ বছর ব্যাংকটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা।