কক্সবাংলা ডটকম(১৬ জুলাই) :: নিউইয়র্কে নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ খুনের ঘটনায় জড়িত কাউকে পুলিশ শনাক্ত বা গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ থাকতে পারে। দু’জনের হত্যাকারীকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারলেও নিউইয়র্ক পুলিশ ফাহিমের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। বড় ধরনের কোনো ব্যবসায়িক লেনদেনের জেরে ফাহিম সালেহকে হত্যা করা হয়েছে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং হত্যাকারী গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাবে না।
হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নিয়োজিত এনওয়াইপিডির হোমিসাইড বিভাগের এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার জানান, ফাহিমের হত্যাকারীর মোটিভ আর্থিক প্রকৃতির বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, কোনও খারাপ বাণিজ্যিক চুক্তির ফলে এই হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকতে পারে।
সূত্রের বরাত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ফাহিমকে টার্গেট করা হত্যা হয়ে থাকতে পারে। তদন্তকারীরা নিহতের বাণিজ্যিক সবকিছু খতিয়ে দেখছে সম্ভাব্য মোটিভ ও সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করার জন্য।
এনবিসি নিউ ইয়র্ককে ফাহিমের এক বন্ধু বলেন, আমার মনে হয় এই ঘটনায় বিদেশিরা জড়িত, তারা হয়ত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পেশাদার খুনি ভাড়া করেছে। হতে পারে ওই খুনি এখন বিমানে রয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, তারা সম্ভাব্য সবকিছু খতিয়ে দেখছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, নজরদারি ক্যামেরার ফুটেছে যে ব্যক্তি ফাহিমকে অনুসরণ করেছে তার মুখ ঢাকা ছিল। সে একেবারে নিনজা পোশাক পরা ছিল। ফলে আমরা তার চেহারা দেখতে পারছি না।
পুলিশকে উদ্ধৃত করে যুক্তরাজ্যের সান ইউকে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি জানত কী করছে। আমাদের মনে হয় তার লক্ষ্য লাশের খণ্ডাংশগুলো কোথাও ফেলে দেওয়া এবং আবার অ্যাপার্টমেন্টে এসে সবকিছু আগের মতো রেখে ঠিক করা। যাতে মনে হয় এখানে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে এসব করার আগেই চলে যেতে হয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি বিস্টের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডটি আন্তর্জাতিক কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। নাইজেরিয়ার লাগোস স্টেট পুলিশ কমান্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, নাইজেরীয় কর্তৃপক্ষ কোনও তদন্ত করছে না। তবে কোনও কিছু যদি তাদের দেশকে ইঙ্গিত করে তাহলে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনওইয়াইপিডির এসব তদন্তকাজের সঙ্গে জড়িত একজনের মতে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে দুটি লক্ষ্য থাকে। একটি হচ্ছে, মাফিয়া স্টাইলে অন্যদের ভয়াবহতার বার্তা দেওয়া। অন্যটি হচ্ছে, ব্যক্তিকে একদম শেষ করে দেওয়া। শেষের যুক্তিটিই এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। হত্যাকারী ফাহিমের মরদেহ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভর্তি করে। এ ফাঁকে ধুয়ে মুছে রক্ত পরিষ্কার করে। ঘটনাস্থলে তেমন রক্ত পাওয়া যায়নি। কেউ আসছে বা দরজায় বেল দিচ্ছে, এমন ঘটনার পর হত্যাকারী সাত তলা অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। এ জন্য তাঁকে চাবি ব্যবহার করতে হয়েছে। ফলে এ ধরনের এক্সিট পরিকল্পনা আগে থেকেই নেওয়া ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইলেকট্রিক করাতে ও অন্যত্র আঙুলের ছাপ পেয়েছে পুলিশ। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামলেও নিউইয়র্ক নগরী সর্বত্র এখন সিসি ক্যামেরার আওতায়। এসব ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও চিত্র দেখে হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা গেছে। অনেকটা করোনাভাইরাসের কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মতো হত্যাকারীকে ধরে ফেলতে পারবে বলে নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে আভাস দেওয়া হয়েছে।
সালেহর বোনকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লিখেছে, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারে ফাহিম সালেহর বোন। মঙ্গলবার সারা দিন ফাহিম সালেহর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না হওয়ায় বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে সপ্তম তলায় কথা বলতে যান। সেখানে গিয়ে তার বোন ফাহিম সালেহর খণ্ড-বিখন্ড মরদেহ দেখতে পান।
পুলিশকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তা ক্যামেরায় দেখা গেছে কালো স্যুট এবং কালো মাস্ক পরা একজন ব্যক্তির সাথে একই লিফটে প্রবেশ করেন ফাহিম সালেহ। লিফট ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ালে দুজনেই সেখান থেকে বের হয়ে যান। এরপর ফাহিম সালেহ তার অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন। তখন সেই ব্যক্তি ফাহিম সালেহকে অনুসরণ করে। পুলিশ বলছে, এরপর দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার আগের দিন ঐ বহুতলা ভবনের সিসিটিভিতে ধারণকৃত মাথায় টুপি, হাতে গ্লোভস এবং মুখোশ (মাস্ক) পরিহিত এক ব্যক্তিকে ফাহিমের সাথে প্রবেশ করতে দেখা যায়। ফাহিমের পেশাদার ঘাতক সোমবার বিকেলে ইলেভেটর দিয়ে ফাহিমের সাথেই সপ্তম তলায় উঠে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, লোকটি কালো পোশাক পরিহিত ছিল। মাথায় টুপি, মাস্ক-সবকিছু ছিল কালো। হাতে ছিল বড় একটি স্যুটকেস। পুলিশের ধারনা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ফাহিমকে হয়তো মাথায় আঘাত করে দুর্বল করা হতে পারে। এরপরই বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে গলাকাটা হয়। পাশাপাশি দু’হাত ও দু’পা কাটা হয়। বুকের মধ্যেখানেও করাত চালিয়ে দু’ভাগ করা হয়। এরপর খণ্ড খণ্ড অংশ আলাদা পলিথিন ব্যাগে ভরা হয়। ফ্লোরের রক্ত মুছে ফেলা হয় কৌশলে। করাতেও ছিল না রক্তের দাগ। তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, ফাহিমকে হত্যার পর হয়তো টুকরো টুকরো লাশ ঐ স্যুটকেসে ভরে কোথাও নেয়া হতো।যাতে ফাহিম নিখোঁজ রহস্য উদঘাটনেও অনেক সময় পেড়িয়ে যায়।
তদন্ত কর্মকর্তা এবং এমন হত্যাকাণ্ডের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণকারীরা আরও মনে করছেন, খণ্ড খণ্ড লাশ স্যুটকেসে ভরার আগেই হয়তো ঐ এপার্টমেন্টে আসতে আগ্রহী কেউ নীচে থেকে কলিং বেল টিপেছিলেন। সে শব্দেই ঘাতক সবকিছু ফেলে পালিয়েছে।
এমন ভাবনার সারাংশ টেনে ফাহিমের অভিভাবকরা বলেছেন, ঘাতক কীভাবে ভবন থেকে পালালো-সেটিও জানতে হবে। কারণ, সে তো হাওয়া হয়ে যায়নি। যে পথে ঢুকেছিল-সেই পথেও বেড়িয়ে গেছে-সে দৃশ্য ফুটেজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন-এমন প্রশ্ন ক্ষুব্ধ প্রবাসীদের।
টেককাবাল নামে নাইজেরিয়ার একটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, সংকটে পড়ার আগে এক বছরেই গোকাডা ৫৩ লাখ ডলার আয় করে। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে গোকাডা পার্সেল ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে। বর্তমানে নাইজেরিয়ার রাজধানী লেগোসে তাদের ১০০০ মোটরসাইকেল রয়েছে। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইনের খবরে ফাহিম সালেহকে একজন মিলিয়নিয়ার প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে যে, নাইজেরিয়ার গোকোডোর পাশাপাশি পিকআপ নামে কলম্বিয়ার আরেকটি রাইডশেয়ারিং কোম্পানিরও তিনি অংশীদার। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গোকোডো বড় ধরণের বিপর্যয়ের কবলে পড়লে গত বছরের শেষদিকে ফাহিম কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়াতেও একই ধরণের ব্যবসায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।
কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস তাঁর স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। ২০১৭ সালে গোকাডা চালুর পর গত বছরের জুনে ৫৩ লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি সেবা আরও বাড়াতে চেয়েছিলেন। এ বছরের জানুয়ারিতে আরও তহবিল পায় তার প্রতিষ্ঠান। তবে সরকার এ সেবা বন্ধ করে দেয়। তার লিঙ্কডইন প্রোফাইলে দেখা যায়, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ করেন তিনি।
তবে মঙ্গলবারের ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। ২৫ কোটি ডলারের বিলাসবহুল বাড়িতে কড়া নিরাপত্তায় তাঁর বিভৎস্য খুনের ঘটনা সবাইকে ধাক্কা দিয়েছে। সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন। সালেহ নিজেও কোনো সময় বিপদ সম্পর্কে কোনো সূত্র দেননি। গত জুনে তিনি টুইট করেন, ২০২০ সাল ভালো অনুভব করছি। তিনি একটি গোকাডা বাইক ক্লাব প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন।
ফাহিম সালেহর জন্ম সৌদি আরবে। এরপর পরিবারের সঙ্গে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যান। পড়াশুনা করেছেন নিউ ইয়র্কে। সেখানেই বসবাস করতেন। মেধাবি ছাত্র ফাহিম নিউইয়র্কে একটি হাই স্কুলে পড়াবস্থায়ই উইজ টিন নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বেশ অর্থও আয় করতে সক্ষম হন। এরপর ম্যাসেচুসেটস স্টেটের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার ইনফরমেশন সিস্টেমে ব্যাচেলর করেন ফাহিম। উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন ফাহিম আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে কিংবা কোন কোম্পানীতে চাকরির চেষ্টা না করেই মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশে ছোটেন। ২০০৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে ফাহিম ঢাকায় হ্যাকহাউস নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা খুব একটা সফলতা পায়নি। ফের ফিরে যান আমেরিকায়। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় এসে প্রযুক্তি-ভিত্তিক কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হয়। এরমধ্যে পাঠাও উদ্যোগ সফল হয়েছিল। শুরুতে পণ্য পরিবহন সার্ভিস থাকলেও পরবর্তীতে রাইড শেয়ারিং সেবাও চালু করে পাঠাও।
উল্লেখ্য, ১৫ জুলাই ম্যানহাটনে নিজের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছেন ফাহিম সালেহ (৩৩)। নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অল্প বয়সে সারা বিশ্বের নজরে এসেছিলেন তিনি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাঁর এগিয়ে যাওয়া অনুসরণ করতেন। ম্যানহাটনের সোয়া দুই মিলিয়ন ডলারের অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন তিনি।
Posted ৯:০৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta