কক্সবাংলা ডটকম(৪ আগস্ট ) :: বিতর্কিত মডেল পিয়াসা মাহবুব গ্রেফতার হওয়ার পর এবার র্যাবের হাতে ধরা পড়েছে তার অন্যতম সহযোগী মিশু হাসান ও তার এক সহযোগী জিসান। উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ফেরারি ব্র্যান্ডের গাড়ি। যার মালিক তিনি।
মিশু শুধু বিদেশে থেকে আমদানি নিষিদ্ধ দামি ব্রান্ডের গাড়িই দেশে আনতেন না, তার ডেইরি ফার্মের জন্য গরু আমদানির নামে আনতেন স্বর্ণ ও হীরার চালান, যা বিশেষ কৌশলে গরুর পেটে ঢুকিয়ে আনা হতো।
সূত্র জানায়, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মিশু সিন্ডিকেটের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে, যা আজ-কালের মধ্যে অনেকটা খোলাসা হতে পারে। ধরা পড়তে পারে জনৈক নজরুলসহ আরও বেশ কয়েকজন গডফাদার। এছাড়া গ্রেফতার তালিকায় শোবিজ জগতের অনেকের নামও রয়েছে।
ফেরারি, ল্যাম্বারগিনি, পোরশে, মাজদা। অভিজাত এবং বিলাসবহুল এসব গাড়ির দাম আকাশছোঁয়া। চাইলেও যে কেউ এসব গাড়ির মালিক হতেও পারে না। কারণ এসব গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। কিন্তু ডিবির হাতে গ্রেফতার বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা চোরাইপথে এসব গাড়ি আনতেন ঢাকায়। ক্রেতার অভাব হয়নি। কারণ উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাকে গাড়ি বিক্রিতে বেগ পেতে হয়নি।
তবে পিয়াসার চোরাচালান চক্রের প্রধান সহযোগী মিশু হাসান নামের এক যুবক। চোরাচালানের সুবাদে তিনিও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। রাজধানীর উপকণ্ঠে সান ডেইরি নামের একটি গরুর ফার্মের আড়ালে তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও অস্ত্রের কারবারে জড়িত। মিশু এক সময় রাজধানীতে পেশাদার ছিনতাইকারী হিসাবে পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিলেন।
সূত্র জানায়, পিয়াসা ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর মিশু হাসানকেও আটক করা হয়েছে। বুধবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।
গরুর পেটে ইয়াবা ও হিরা : পিয়াসা-মিশু চক্রের হাতে কত টাকা আছে তার অনুমান করাও দুষ্কর। কারণ ডেইরি সান নামের ফার্মে বিদেশি গরু লালন পালনের আড়ালে তাদের চোরাচালান কৌশলের কাছে হার মানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি। বিদেশ থেকে আমদানির সময় গরুর পেটে করে আনা হয় হীরা ও স্বর্ণের চালান। গত ৫ বছরে এভাবে হাজার কোটি টাকার চালান দেশে আনা হয়।
সূত্র বলছে, শুধু হীরার এবং স্বর্ণের চালান নয়, গরুর পেটে করে ইয়াবার চালানও আনা হয়। এজন্য মাঝে মাঝে টেকনাফ থেকেও গরুর চালান আনা হতো। এভাবে চোরাচালানের টাকায় রাতারাতি বিত্তশালী বনে যান মিশু। তার অভিজাত এবং শৌখিন জীবনযাপন অনেক মধ্যপ্রাচ্যের যুবরাজদের মতো। তিনি হাতে পিজিয়েট ব্রান্ডের ঘড়ি পরেন। হিরাখচিত পিজিয়েট ঘড়ির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য কোটি টাকা। মিশুর ব্যবহৃত জুতার ডিজাইন করা হয় দুবাই এবং সিঙ্গাপুরে। তিনি আগে মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই করতেন। ছিনতাইয়ের অভিযোগে একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হন। জেলে ছিলেন ৩ মাস। পরে পরিবারের এক সদস্যের গয়না বেচে মিশুকে জেল থেকে ছাড়ানো হয়।
সূত্র বলছে, মিশু এক সময় নিজেকে প্রয়াত সংসদ সদস্য হাজি মকবুলের ছেলে মাসুদের বন্ধু বলে পরিচয় দিতেন। ফলে মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের লোকজন তার ওপর গুলি চালায়। হেলালের অনুগত কিলার হিসাবে পরিচিত লাল্লুর গুলিতে আহত হন মিশু। এখনো তার শরীরে গুলির দাগ রয়েছে।
সূত্র বলছে, মিশুর মাধ্যমে ইয়াবা, হিরা এবং সোনার চালান আনা হলেও বিক্রির মূল কাজটা করেন পিয়াসা নিজেই। এ জন্য তিনি ডার্ক ওয়েব এবং ফেসবুক চ্যাটিং গ্রুপ ব্যবহার করতেন। মিশুর মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্রের চালানও আনা হয়। পিয়াসার ইয়াবার মূল ক্রেতা ছিলেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পড়ুয়া ধনী পরিবারের সন্তানরা।
আটক ফেরারি : সোমবার প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে রাজধানীর গুলশান থেকে ফেরারি ব্রান্ডের একটি অভিজাত প্রাইভেট উদ্ধার করা হয়েছে। এফ-৪৩০ সিরিয়ালের ৬ হাজার সিসির গাড়িটি গুলশানের ১১১ নম্বর রোডে অবস্থিত অটো মিউজিয়ামে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল। এ ধরনের উচ্চ সিসির গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। এ কারণে বৈধভাবে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই। তবে এ ধরনের গাড়ি রাজধানীর রাস্তায় চলছে ভূরি ভূরি। সবগুলোর নম্বর প্লেট ভুয়া। মঙ্গলবার অটো মিউজিয়াম থেকে উদ্ধারকৃত গাড়িটিতেও একটি নম্বর প্লেট লাগানো ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে নম্বরটি জাল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি উদ্ধার অভিযানের সময় লাল রঙের চকচকে ফেরারি গাড়িটির আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্র চাওয়া হলে তা দেখাতে ব্যর্থ হন শোরুম কর্তৃপক্ষ। এক পর্যায়ে গাড়িটি জব্দ করে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অটো মিউজিয়ামের ম্যানেজার বাবু বলেন, গাড়িটি বিক্রির জন্য এখানে একজন রেখে যান। এর বেশি কিছু আমরা জানি না। অটো মিউজিয়ামের মালিকের নাম হাবিবুল্লাহ ডন। তিনি গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার দু’বার সভাপতি ছিলেন। শোরুম থেকে চোরাই গাড়ি উদ্ধারের ঘটনায় হাবিবুল্লাহ ডনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
এদিকে সূত্র জানায়, ফেরারি উদ্ধারের পর ল্যাম্বারগিনি ব্রান্ডের আরেকটি গাড়ি উদ্ধারে অভিযান চলছে। ৬ সিলিন্ডারের ল্যাম্বারগিনি বিশ্বের মূল্যবান ব্যক্তিগত গাড়ির মধ্যে অন্যতম। অভিজাত এসব গাড়ির দরজা ঈগলের ডানার মতো। দুপাশ দিয়ে খোলার বদলে খোলে আড়াআড়িভাবে। দরজা খোলা অবস্থায় পার্কিং করা হলে ল্যাম্বারগিনি অনেকটা উড়ন্ত ঈগলের মতো দেখায়।
অভিনব কৌশলে পিয়াসা-মিশু চক্র চোরাই ল্যাম্বারগিনি বিক্রি করে আসছেন। এজন্য গোপন চ্যাটিং গ্রুপ খুলে প্রথমে গাড়ির লোগো পোস্ট করা হয়। এরপর দেওয়া হয় একটি দরজার ছবি। এরপর রংসহ গাড়ির অন্য অংশগুলো। এভাবে গাড়ি সম্পর্কে ক্রেতার আকর্ষণ চরমে পৌঁছলে গাড়ির সম্পূর্ণ ছবি পাঠানো হয়।
প্রতিটি পার্টিতে ১৫-২০ জন অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিদেশেও প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করা হয়। একইভাবে বড়লোক প্রবাসীদের জন্যেও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টি আয়োজন করা হয়। তারা ক্লাইন্টদের গোপন ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকা বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীতে পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে নিয়মিত বসানো হতো মাদকের আসর। এসব পার্টিতে অংশ নিতেন পিয়াসা-মৌদের মতো অর্ধশত ‘মডেল’। এরা পার্টিতে অংশ নেয়া অভিজাত শ্রেনির লোকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি ও ভিডিও তুলে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে তিন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব মডেলের নাম-পরিচয় জেনেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এই ‘মডেল’ ও টিভি কর্মীদেরকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করতো শরফুল হাসান বা মিশু হাসান। দেশের বাইরে দুবাই বা ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসীদের জন্য এরা বিদেশে গিয়ে পার্টির ব্যবস্থা করত।
রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ শরফুল হাসান বা মিশু হাসান ও তার এক সহযোগী জিসানকে আটকের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
বুধবার বিকেল পৌনে ৬টায় সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এতথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায়। র্যাব এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর অভিযানে মঙ্গলবার রাতে বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মিশু হাসান ও তার জিসানকে আটক করা হয়।
এ সময় জব্দ করা হয় ১টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬ রাউন্ড গোলাবারুদ, ইয়াবা ১৩ হাজার ৩০০ পিস, একটি বিলাসবহুল ফেরারি মডেলের গাড়ি, শিশার সরঞ্জামাদি, ২টি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও এটিএম কার্ড, পাসপোর্ট এবং ভারতীয় জালমুদ্রা ৪৯ হাজার ৫০০ রুপি।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, আটকরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এই চক্রের সদস্য প্রায় ১০-১২ জন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকা বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে থাকে। পার্টিতে তারা অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে। অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য।
প্রতিটি পার্টিতে ১৫-২০ জন অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিদেশেও প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করা হয়। একইভাবে বড়লোক প্রবাসীদের জন্যেও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টি আয়োজন করা হয়। তারা ক্লায়েন্টদের গোপন ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
পার্টি আয়োজনের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টের চাহিদা/পছন্দে গুরুত্ব দেয়া হতো। এই অবৈধ আয় থেকে অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় (গাড়ির ব্যবসা, আমদানি ও গরুর ফার্ম) বিনিয়োগ করেছে মিশু হাসান ও জিসান। এই ব্যবসায় তাদের গ্রুপের সদস্যদের অবৈধ আয়েরও বিনিয়োগ রয়েছে।
র্যাব জানায়, আটক শরফুল হাসান বা মিশু হাসান বাংলাদেশে নামিদামি ব্রান্ডের বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবসা করে থাকে। সে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও ছলচাতুরির আশ্রয় নিত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। সে নিজেও দামি ব্রান্ডের গাড়ি ব্যবহার করত। তার ব্যক্তিগত ২টি রেঞ্চ রোভার, অ্যাকুয়া, ভক্স ওয়াগন ও ফেরারিসহ ৫টি গাড়ি রয়েছে। সে অত্যন্ত সুকৌশলে গাড়ির ট্যাক্স জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আটক জিসানের এলাকায় একটি গরুর ফার্ম রয়েছে। শরফুল হাসান ইতিপূর্বে বিভিন্ন মামলায় তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত অপরাধীদের যোগাযোগ রয়েছে।
‘উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকদের টার্গেট করে আসর বসানো হতো। এই চক্রের ক্লাইয়েন্টের তালিকায় পিয়াসা-মৌসহ দেশি-বিদেশি ৫০ ক্লায়েন্টের নাম পেয়েছি। যাদেরকে বিদেশেও প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করে পাঠানো হতো। একইভাবে উচ্চবিত্তের প্রবাসীদের জন্যেও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টি আয়োজন করে পিয়াসা-মৌদের মতো কথিত মডেলদের পাঠানো হতো।’
আটকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে, মাদক আইনে, ভারতীয় জালমুদ্রার রাখা ও অননুমোদিত গাড়ি আমদানি ও ব্যবহারে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ আলাদা আলাদা মামলা প্রক্রিয়াধীন।
Posted ৩:৩১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta