কক্সবাংলা ডটকম(১৬ নভেম্বর) :: সাম্প্রতিক শেয়ার কারসাজির ঘটনা নিয়ে কথা উঠলে বহুল আলোচিত সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরোর নাম আসে সবার আগে। অনিয়ম-দুর্নীতির ঘেরাটোপে ২০২০ সালের জুনে যে শেয়ারবাজার ধুঁকছিল, তা পরের মাসেই হিরোর কারসাজিতে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। তখন হিরোর নতুন সঙ্গী হলেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তদন্তে এঁদের দু’জনের নাম বারবার আসছে। ব্রোকারেজসহ একাধিক ব্যবসার অংশীদার তাঁরা দু’জন। পেশায় দীর্ঘদিন দুই জগতের বাসিন্দা এ দু’জনকে এক গাঁটে বাঁধলেন কে বা কারা?
দুই বছর ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে সমকাল। তাতে জানা গেছে, এ দু’জনের সংযোগ ঘটানোর নেপথ্যে আছেন জাভেদ আজিজ মতিন, যাঁর নাম আন্তর্জাতিক প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে। দীর্ঘ ৪০ বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী এই ব্যক্তি বাংলাদেশে ফিরেছেন ঠিক দু’বছর আগে। দেশের টানে নয়, পালিয়ে এসেছেন।
স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাভেদের পালিয়ে আসার কারণ, সেখানে শেয়ারবাজারে নিজ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে ধরা পড়া। হাজার কোটি টাকার জরিমানার দণ্ড ঝুলছে তাঁর ঘাড়ে। আরও একটি কারণ আছে। এক অস্ট্রেলীয় নাগরিকের মালিকানাধীন হংকংয়ের একটি কোম্পানি থেকে প্রতারণা করে ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়েছিলেন জাভেদ ২০২০ সালে। সে টাকাই ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাচার হয়ে আসে বাংলাদেশে এবং শেয়ার কারসাজিতে লগ্নি হয়।
শেয়ারবাজারসহ অন্যান্য খাতে অর্থলগ্নিতে অংশীদার হন জাভেদের ছেলের বয়সী হিরো ও সাকিব। দেশের এই বিশিষ্ট দু’জনকে সামনে রেখে জাভেদ মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খুলে বাগিয়ে নিয়েছেন স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউস লাইসেন্স; গড়েছেন ই-কমার্স সাইট মোনার্ক মার্ট, মুন্সীগঞ্জে মোনার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের মতো কিছু ব্যবসা। পরিকল্পনা করছেন আরও অনেক কিছুর।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পলাতক জাভেদ এখন বাংলাদেশে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। মোনার্ক নামে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকে সাকিব-হিরোর কোম্পানি বলে জানেন। মোনার্ক নামটি জাভেদেরই দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে আসার আগে তিনি দেশে মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশন নামে একটি অনিবন্ধিত কোম্পানি খুলেছিলেন। ওই কোম্পানির মাধ্যমেই হংকংয়ের একটি কোম্পানি থেকে প্রতারণা করে অর্থ এনে বাংলাদেশ ও ইউরোপের একটি দেশে পাচার করেছেন বলে তথ্য মিলেছে। এর অনেক প্রমাণ সমকালের কাছে রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হিরো-সাকিবের গাঁট বাঁধার প্রধান অনুঘটক জাভেদ মতিন হলেও তিনজনকে একত্র করার নেপথ্যে আছেন আরেকজন কুশীলব। তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা। জাভেদের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ২০ বছরের বন্ধুত্ব। বন্ধুকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার মিশনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা রয়েছে প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তার।
লাভবান হয়েছেন কোটি টাকার অঙ্কে এবং অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের মতো গুরুতর অপরাধেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। প্রাপ্ত দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অর্থ পাচার করে জাভেদের বাংলাদেশে ফেরার সঙ্গে ২০২০ সালের করোনাকালে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর গভীর যোগসূত্র আছে। প্রতারক জাভেদ মতিন বাংলাদেশে পা না রাখলে সরকারি কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরো আদৌ হিরো হয়ে উঠতেন কিনা, তা নিয়েও আছে সন্দেহ।
যেভাবে অনুসন্ধান :
২০২০ সালের অক্টোবরে বীমা খাতের শেয়ারদর হুহু করে বাড়ার নেপথ্যে হিরোর ভূমিকার কিছু তথ্য আসে সমকালের কাছে। হিরোর কারসাজির খবর সংগ্রহে গেলে সাকিবের সংশ্নিষ্টতা পাওয়া যায়। এই দু’জন কীভাবে একত্র হলেন- সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে জাভেদ এ মতিনের সন্ধান পাওয়া যায়। একই সঙ্গে প্রাথমিক এ তথ্যও আসে, এই তিনজনকে এক করতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। পরের বছরাধিককালে শেয়ার কারসাজি থেকে শুরু করে সংশ্নিষ্টদের মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অনেক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে সমকাল। তবে অনুমিত হয়, এগুলো আংশিক এবং অনেক কিছু অজানা রয়েছে।
কে এই জাভেদ :
যুক্তরাষ্ট্রে নানা নথি এবং বাংলাদেশে নেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রে পুরো নাম জাভেদ এ মতিন। নামের ইংরেজি বানান কিছুটা ব্যতিক্রম- Javeed Azizz Matin। আদি নিবাস কুমিল্লায়। এখন বয়স ৬৩ বছর। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ভাগ্যবদলের আশায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ভাগ্য ফেরায় স্থায়ী আবাস গড়েন ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত এলাকা ডায়মন্ড বারে।
১৯৯৯ সালে জাভেদ একটি পাবলিক সেল কোম্পানি কেনেন। আগের নাম বদলে নতুন নামকরণ করেন ভেলটেক্স করপোরেশন। নিজে চেয়ারম্যান ও সিইও হন। ২০০১ সালের ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে ছোট কোম্পানির শেয়ারবাজার ইউএস ওটিসিতে (ওভার দ্য কাউন্টার) কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত করেন। এ কোম্পানির ব্যবসা ছিল মূলত তৈরি পোশাক আমদানি করে বিক্রি করা। কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকেও তৈরি পোশাক আমদানি করত।
৪০ বছর পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন জাভেদ। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার একাধিক মামলা থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে আসতে পারেন তিনি। ২০২০ সালের নভেম্বরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় পাসপোর্টও (নম্বর-৬৫৪২১৩৫৮৬) নিয়েছিলেন। পালিয়ে আসার আগে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে উবার চালকের কমিশনের টাকা ঢোকার তথ্য মিলেছে।
জাভেদকে সহায়তাকারী বন্ধু পরিচয় দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা জানান, জাভেদ বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর তিন থেকে চার কোটি ডলারের পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র জাভেদ ওই কর্মকর্তার তিন বছরের সিনিয়র। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নয়, ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখা-সাক্ষাৎ সূত্রে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ার কারসাজি :
জাভেদ মতিন ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ওটিসি শেয়ারবাজারে নিজের কোম্পানি ভেলটেক্স করপোরেশনের শেয়ার কারসাজির দায়ে অভিযুক্ত। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালতে ২০১২ সালে ১০ কোটি ২৮ লাখ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় হাজার কোটি টাকার বেশি জরিমানা হয়।
ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহু ফাইন্যান্সে অনুসন্ধানে দেখা যায়, তালিকাভুক্তির পরের বছর ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট ভেলটেক্সের শেয়ার ১০ সেন্টে কেনাবেচা হয়। কিন্তু এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর এ শেয়ারটিরই দর সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ ডলার থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ ডলারে ওঠে। ২০০৩ সালের ২৭ অক্টোবর শেয়ারটির দর আবার ২১ সেন্টে নামে। দরের এই অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে জাভেদ মতিনের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা, তার তথ্য মেলেনি।
তবে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে কারসাজির ঘটনায় করা অভিযোগপত্র ও জরিমানার আদেশ সূত্রে জানা যায়, ফের শেয়ারটির দর বাড়াতে একের পর এক কোম্পানির মুনাফা ও সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য প্রচার করেন জাভেদ। তিনি কানাডায় ভেলটেক্স কানাডা ও ভেলটেক্স এক্সপোরার নামে দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন এবং বাংলাদেশের কুমিল্লায় ভেলভেট টেক্সটাইল মিল নামে একটি পোশাক কারখানা স্থাপন ও ঢাকার অদূরে টঙ্গীর কেসিএ গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি কোম্পানি অধিগ্রহণের ঘোষণা দেন।
এসব ঘোষণায় ভেলটেক্সের শেয়ারদর ৩০ সেন্ট থেকে সাড়ে ৩ ডলার ছাড়ায়। এসব প্রচারের অংশ হিসেবে জাভেদের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার ইউটিউবে এখনও আছে। কারসাজির আলামত পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউএস এসইসি তদন্ত করে প্রমাণ পায়, জাভেদের প্রচার করা ওই সব মুনাফা, সম্পদ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের সব তথ্যই ছিল ভুয়া ও প্রতারণামূলক।
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউএস এসইসি এ ঘটনায় জাভেদের বিরুদ্ধে সব ধরনের শেয়ার ইস্যু ও লেনদেনে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি দেশটির ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট আদালতে মামলা করে। ওই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জাভেদ নিজের অপর শতভাগ মালিকানাধীন অনিবন্ধিত কোম্পানি উইলশায়ার ইকুইটির নামে ভেলটেক্সের প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ শেয়ার ইস্যু করেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন ভেলটেক্সের তৎকালীন হিসাবরক্ষক পাকিস্তানপ্রবাসী মাজহার-উল হক। শেয়ার ইস্যুর পরপরই মাজহারকে দিয়ে শেয়ার বিক্রি করিয়ে মোট ৬৫ লাখ ডলার পান তিনি।
কিন্তু ইউএস এসইসির এ মামলা করার আগেই ভেলটেক্সের এক শেয়ারহোল্ডারের করা অন্য মামলায় নিজ কোম্পানি থেকে অপসারিত হন জাভেদ। এর পর ভেলটেক্স করপোরেশনই প্রতারণার ঘটনায় জাভেদের বিরুদ্ধে ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট আদালতে ২০১০ সালে মামলা করে। এ মামলায় আদালত জাভেদকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ কোটি ডলার জরিমানা করেন। জরিমানা আংশিক পরিশোধও করেননি জাভেদ। এ জন্য তিন মাস অন্তর আদালতের আদেশে জরিমানার অঙ্ক বেড়েই চলেছে। তবে জাভেদ তো হাওয়া!
হংকংয়ের ব্যবসায়ীর অর্থ আত্মসাৎ :
যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ার কারসাজির পথ বন্ধ হওয়ার পর জাভেদ নতুন কোনো জালিয়াতির পথ খুঁজছিলেন। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশন নামে একটি অনিবন্ধিত কোম্পানি খোলেন। এ কোম্পানি হংকংয়ের স্বনামধন্য বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ইস্টার্ন ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এজেন্ট পরিচয় দিয়ে হংকংভিত্তিক কোম্পানি মিং গ্লোবাল লিমিটেডের কাছ থেকে বিনিয়োগ চেয়ে যোগাযোগ করে। এ কাজে জাভেদের বান্ধবী ফিলিপাইনের নাগরিক মারিয়া ভেরোনিকা সহায়তা করেন। মিং গ্লোবাল লিমিটেড তাদের প্রস্তাবে বিশ্বাস রেখে মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক অব আমেরিকা ও ইউএস ব্যাংকে ১ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৮০৩ ডলার পাঠায়। ওই অর্থই বাংলাদেশসহ অন্যত্র পাচার করেছেন জাভেদ। এ প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মিং গ্লোবাল যুক্তরাষ্ট্রে একটি মামলা করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছে। এ-সংক্রান্ত নথি সমকালের হাতে আছে।
পাচারের অর্থ বাংলাদেশে :
হংকংয়ের মিং গ্লোবাল থেকে আনা প্রতারণার অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে ঢোকার পরই তা অন্যত্র সরানোর ফন্দি আঁটেন জাভেদ। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এবং এ অর্থ ভোগ করা কঠিন হবে ভেবে ওই অর্থ বাংলাদেশসহ অন্যত্র পাচার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের আদেশে জাভেদের মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট হাতে পেয়েছিল মিং গ্লোবাল। সেসব স্টেটমেন্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, জাভেদ মতিন তাঁর মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (ইউএস ব্যাংকের ১৫৭৫-১৭৮৪-৫৪৮১ নম্বর এবং ব্যাংক অব আমেরিকার ৩২৫১-২৮৮৫-৮০৯৭ নম্বর) থেকে বাংলাদেশের এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তার কাছে এবং তাঁর কোম্পানি জিন বাংলা ফেব্রিক্স ও ইস্টার্ন ব্যাংকের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউস ইবিএল সিকিউরিটিজে মোট ৯ লাখ ১৪ হাজার ৮৬৫ ডলার পাঠান। বাংলাদেশে এ টাকা এসেছে ২০২০ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা দিয়েছেন জাভেদ।
প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে জাভেদের মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের ব্যাংক অব আমেরিকার অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২০ সালের ১৯ জুন ৬০ লাখ টাকা বা তার সমপরিমাণ ৭৩ হাজার ৩৫৯ ডলার ওই শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী কর্মকর্তার সাউথইস্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠানোর নির্দেশনা দেন জাভেদ। একই বছরের ২৯ জুন আরও ৩২ লাখ টাকা বা ৩৯ হাজার ৩৭৪ ডলার, ১ জুলাই ৩৫ লাখ টাকা বা ৪৩ হাজার ৩৯ ডলার পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
আবার একই বছর শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তার একই ব্যাংক হিসাবে ৭ জুলাই ২৫ লাখ ও ৮ জুলাই ১ কোটি টাকা পাঠানোর নির্দেশ দেন। এভাবে ওই কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯২৪ ডলার পাঠিয়েছেন জাভেদ। টাকা পাঠানোর কারণ হিসেবে জাভেদ তাঁর পারিবারিক সদস্য হিসেবে আর্থিক সহায়তার কথা উল্লেখ করেন। তবে মিং গ্লোবাল ২০২১ সালের জুন মাসে দুদকে অর্থ পাচারের অভিযোগ করার পর একই বছরের আগস্টে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই কর্মকর্তা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে টাকা ফেরতের নাটক তৈরি করেন। তিনি ঢাকার বিচারক শাম্মী আখতারের তৃতীয় যুগ্ম জজ আদালতে একটি ইন্টারপ্লিডার স্যুটে (প্রকৃত দাবিদার নিরূপণের মোকদ্দমা) দাবি করেন, জাভেদের কাছ সাভারের একটি ভবনের দুটি ফ্লোর ভাড়ার চুক্তির অগ্রিম হিসেবে ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা নিয়েছেন।
এ ছাড়া ওই কর্মকর্তার পুরোনো গার্মেন্ট কোম্পানি জিন বাংলা ফেব্রিক্সের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২০২০ সালের ১৩ জুলাই ২৫ লাখ টাকা এবং ৪ জুলাই ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার পণ্য ক্রয় বাবদ মোট ২ লাখ ২ হাজার ৫৮১ ডলার ৯১ সেন্ট পাঠানোর নির্দেশ দেন জাভেদ। এর পর ১৭ জুলাই ২ লাখ ১৬ হাজার ডলার ও ২০ জুলাই ১ লাখ ৪৫ হাজার ডলারসহ মোট ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮১ ডলার ৯১ সেন্ট পরিশোধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে টাকা পাঠানোর কারণ হিসেবে স্টক লট ক্রয় বলে উল্লেখ করেন জাভেদ।
জিন বাংলা ফেব্রিক্স কোম্পানির ব্যবসা কার্যক্রম ২০১৬ সাল থেকে বন্ধ- সমকালের এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে এই তথ্য জানান জাভেদকে সহায়তাকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা। তাঁর দাবি, জিন বাংলা ফেব্রিক্স একসময় তাঁরই মালিকানাধীন ছিল এবং এখন কোম্পানিটি তাঁর চাচা আরিফুল ইসলামের। জাভেদের পাঠানো টাকা তিনি নেননি বলেও দাবি করেন।
অনুসন্ধানে মিলেছে জিন বাংলা ফেব্রিক্সের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের যে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন জাভেদ, সেটি ওই কর্মকর্তাই খুলেছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং এ ব্যাংকের স্টেটমেন্টে তাঁর নাম, বাসার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর রয়েছে। সংশ্নিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে, এ অ্যাকাউন্টের টাকা তাঁর চেক স্বাক্ষরে ওঠানো হয়েছে এবং তাঁর আবেদনেই অ্যাকাউন্টটি গত বছর বন্ধ করা হয়েছে। এর প্রমাণ সমকালের কাছে আছে জানালে ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি কেবল চাচাকে সহায়তা করেছেন।
এর বাইরে ব্যাংক অব আমেরিকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে একবারে ৬০ লাখ টাকা বা ৭৩ হাজার ৩৫৯ ডলার ১৪ সেন্ট পাঠানোর জন্য নির্দেশনা ছিল ২০২০ সালের ১৯ জুন। এ টাকা পাঠানোর কারণ হিসেবে ‘সেবা ক্রয়’ উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কী সেবা ক্রয় করেছিল, তার উল্লেখ নেই। প্রকৃতপক্ষে শেয়ারে লগ্নির জন্যই এ টাকা পাঠান জাভেদ।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা :
কারসাজি করে অর্থ আয়ের প্রমাণ মেলায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালত জাভেদসহ সংশ্নিষ্টদের ১০ কোটি ডলার জরিমানা করলেও বাংলাদেশে কারসাজি করে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন জাভেদ। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে ব্রোকারেজ লাইসেন্স দিয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
তথ্য আছে, এই লাইসেন্স দেওয়ার আগেই দেশের শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে অর্থ পাচার রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থবিষয়ক তদন্ত সংস্থা বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান আবু হেনা মো. রাজি হাসান ই-মেইলে জাভেদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা এবং সে দেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক বড় অঙ্কের জরিমানার তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন। ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত কেউ পরিচালক পদে থাকলে ব্রোকারেজ হাউসের লাইসেন্স দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও জাভেদ লাইসেন্স পেয়েছেন।
গত দুই বছরে স্টক এক্সচেঞ্জের তদন্তে শেয়ার কারসাজির ঘটনায় হিরো ও সাকিবের সঙ্গে জাভেদের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ক্যান্ডেলস্টোনের নাম এসেছে। গত ২৯ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সময়কালে শিল্পোন্নয়নের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে রিয়েলাইজড ও আনরিয়েলাইজড (বিক্রীত ও অবিক্রীত শেয়ারের মুনাফা) মিলে ৩৯ কোটি টাকা মুনাফা করার দায়ে গত ৩০ অক্টোবর আবুল খায়ের হিরো গংকে মাত্র দেড় কোটি টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। এ চক্রে ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্ট পার্টনার লিমিটেড গ্রোথ এসিসি নামে একটি ফান্ডের নামও এসেছে, যার মালিকানায় আছেন জাভেদ মতিন। এর বাইরে আরও কয়েকটি কারসাজির ঘটনায় জাভেদের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে প্রতিটি ঘটনায় শুধু হিরো বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামমাত্র জরিমানা করছে বিএসইসি।
কোম্পানি গঠনে প্রতারণা :
বাংলাদেশে মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে কোম্পানি গঠনে যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি) নথিতে নিজের ঠিকানা হিসেবে বাড়ি নম্বর-২, সড়ক-২ এবং বারিধারা, গুলশান ঠিকানা উল্লেখ করেছেন। আদতে ওই ঠিকানা একটি হোটেলের।
কথা বলবেন না জাভেদ :
জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার বিষয়ে জাভেদ এ মতিনের ভাষ্য জানতে তাঁর ব্রোকারেজ হাউস মোনার্ক হোল্ডিংসের মতিঝিলের সিটি সেন্টারে গত জুলাই থেকে কয়েক দফায় এ প্রতিবেদক গিয়েছিলেন। মোনার্ক হোল্ডিংসের সিইও আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে জাভেদ মতিনের সাক্ষাৎ চাওয়া হলে দিতে অস্বীকৃতি জানান জাভেদ। কয়েক দফার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে গত ১৫ অক্টোবর জাভেদ মতিনের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি ধরেন। কিন্তু প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে অন্য একজনকে ফোন ধরিয়ে দেন। ওই ব্যক্তি নিজেকে জাভেদ মতিনের ‘কাজিন’ পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘জাভেদ ভাই এখন নেই। আমরা কুমিল্লার বার্ডের একটি অনুষ্ঠানে। তিনি (জাভেদ) এলে জানাব।’ জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি তাঁর নাম শহিদুল হক বলে জানান। এরপর কয়েক দিন ফোন করা হলেও কেউ ধরেননি।
সূত্র : দৈনিক সমকাল
Posted ১১:১১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta