নাজিম উদ্দিন,পেকুয়া :: পেকুয়ায় সাগর থেকে তোলা হচ্ছে লোনা বালি। ক্ষমতাসীনদল আ’লীগ থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও বিএনপি থেকে নির্বাচিত ধানের শীষ প্রতীকের স্থানীয় চেয়ারম্যানের নাম ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের উপকূলবর্তী মগনামা ইউনিয়নের জেটিঘাটের নিকটে বালি উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। গত দু’সপ্তাহ আগে থেকে বালি উত্তোলন শুরু হয়েছে। তবে প্রশাসনের নাকের ডগায় ওই বেআইনী কাজ অব্যাহত থাকলেও নেই জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা। এতে করে জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকাও জনগনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা জেটিঘাটের উত্তরে উপকুলীয় বনবিভাগ মগনামা বনবিট কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনেই পাইপগুলি সঞ্চালন করা হয়েছে। সাগরে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসানো হয়েছে। কুতুবদিয়ার উপজেলা সীমানার সমুদ্র অংশ থেকে বালিগুলি তুলে লোকালয়ে স্তুপ করা হচ্ছে। বালি উত্তোলনের জন্য কোন আদেশ নেই।
সমুদ্র সংরক্ষণ আইনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্গন করে একশ্রেনীর বালিখেকো সিন্ডিকেট সাগর থেকে বালি উত্তোলন কাজ চলমান রাখে। গত এক সপ্তাহ আগে পেকুয়ার ইউএনও’র নির্দেশে সহকারী কমিশন ভূমি মীকি মারমা কুতুবদিয়া চ্যানেলের নিকটে গিয়ে বালি উত্তোলন কাজে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় কিছু যন্ত্রপাতি জব্দ করে। এমনকি তিন জন শ্রমিককেও আটক করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মোচলেকা নিয়ে ওই তিন শ্রমিককে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে এসিল্যান্ড ওই স্থান ত্যাগ করার মুহুর্তেই ফের বালি উত্তোলন কয়েক ঘন্টার মধ্যে শুরু করে। সিন্ডিকেটের ৩/৪ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি সেখানে গিয়ে এসিল্যান্ডকে তার অনুপস্থিতিতে গালমন্দও করেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এরপর দ্বিতীয় দফায় উপকুলীয় বনবিভাগও অভিযান পরিচালনা করে। উপকুলীয় বনবিভাগের মগনামা বনবিট কর্মকর্তা হোসনে মোবারক কিছু পাইপও জব্দ করে।
তবে প্রচন্ড ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌং ওয়াসিমের ৩ জন অনুগত ব্যক্তি বিট কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। অভিযান পরিচালনা করায় তারা বিট কর্মকর্তাকে হুমকি ধমকি দিয়ে জব্দকৃত পাইপগুলি নিয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় তারা ফের বালু উত্তোলন শুরু করে। গত ১৫ দিন ধরে সাগর থেকে বালি উত্তোলন চলমান রয়েছে। সুত্র জানান, সাগর থেকে বালি উত্তোলন হচ্ছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। তারা উত্তোলিত বালি সড়ক উন্নয়ন কাজ ও বিভিন্ন ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করে পকেট ভরবেন কোটি কোটি টাকা। বালিগুলি লবণাক্ত।
কুতুবদিয়া চ্যানেল বঙ্গোপসাগরের প্রচন্ড খর¯্রােতা নদীর মোহনা। ওই নদীর পানিতে লবণের মাত্রাও বেশী।ওই নদীর পানি থেকে কুতুবদিয়া-পেকুয়া-মহেশখালীসহ উপকুলে লবণ চাষ করা হয়। লবণাক্ত বালিগুলি এখন স্তুপ করা হচ্ছে মগনামা ইউনিয়নের জেটিঘাটের পূর্ব পাশের্^ প্রধান সড়কের নিকটে। বিসমিল্লাহ সড়ক নামক মগনামা ইউনিয়নের ফতেহআলী মা’র পাড়ার পয়েন্টে পাহাড়সম এখন লোনা বালির স্তুপ। শুরু হয়েছে বালি বিকিকিনির উৎসবও। ওই মজুদ অংশ থেকে বালিগুলি পরিবহন করতে ট্রাক, পিকআপ ও শক্তিশালী ডাম্পার গাড়ী বালি মহালে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ দিকে সাগর থেকে বালিগুলি মোকামে নিয়ে আসা হচ্ছে। এর বর্জ্য ও কাঁদা মিশ্রিত পানি নি:সরণ করা হচ্ছে লোকালয়ের চলাচল খালে।
ফাঁড়িখাল নামক একটি খাল মগনামা জেটিঘাট থেকে ব্যাঙওয়াল ঘোনায় গিয়ে মিশেছে। এ খালটি মগনামার পানি চলাচলের প্রধান মোকাম। বর্তমানে সাগরের লোনা বালির স্তুপ খালে গিয়ে পড়ছে। এতে করে খালটি প্রায় ১ কিলোমিটার ভরা খালে রুপান্তর হচ্ছে। থেমে গেছে পানি নিষ্কাশন। জোয়ার ভাটা থেমে যাওয়ায় গত ১ সপ্তাহ ধরে ব্যাঙওয়াল খালের পানির প্রবাহও নিচের দিকে নেমে গেছে। লবণ মাঠে পানি ও সেঁচের প্রতিবন্ধকতাও তৈরী হয়েছে। কৃত্রিম ভরাটের ফলে খালের ভিতরের অংশটি এখন মরাখালে পরিনত হয়েছে। বালিখেকো সিন্ডিকেট সাগরের চরে সৃজিত বনাঞ্চল সাবাড় করে প্যারাবনের ভিতর দিয়ে ড্রেজার ও ২০ ইঞ্চি প্রশস্ত পাইপগুলি সঞ্চালন করে। বেড়িবাঁধ কেটে লোকালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রায় ১ কিলোমিটার গিয়ে বিসমিল্লাহ সড়কে পাইপ শেষ হয়। সেখানেই বালি মজুদ রাখা হচ্ছে। বানৌজা শেখ হাসিনা সড়কও রাতে কেটে ফেলানো হয়েছে।
এর তলদেশ দিয়ে পাইপ অপরপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এ দিকে বালি উত্তোলন নিয়ে মগনামায় তুমুল হট্টগোল ও বাকবিতন্ডা দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ২ জন নেতা বাদী হয়ে পেকুয়ার ইউএনও ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ পৌছানো হয়েছে। স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌং ওয়াসিমকে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত করে এ সব অভিযোগ সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর বরাবরেও পৌছানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে একটি দরখাস্তের আবেদনকারী ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি রুকন উদ্দিন জানান, বিধি লঙ্গন করে রাষ্ট্রের আইন না মেনে কিছু বিএনপির শীর্ষ সন্ত্রাসী সাগর থেকে বালি তোলছে। এখন সাগরের জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। কুতুবদিয়া চ্যানেলটি মৎস্যের অভায়রণ্য। এখানে মা মাছ ডিম ছাড়তে আসে। বালি তোলার ফলে সাগরের বৈশিষ্ট্য অস্বাভাবিক হচ্ছে।
অপর দরখাস্তকারী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মমতাজুল ইসলাম বলেন, আমরা বলতে চাই ওয়াসিম চেয়ারম্যানের খুঁটির জোর কোথায়। তার কাছে সবকিছু এখন মামুলি ব্যাপার। উপকুলীয় বনবিভাগ মগনামার বনবিট কর্মকর্তা হোসনে মোবারক বলেন, এখন আমাদের কথা এরা শুনতে চাননা। এমপি সাহেব ও চেয়ারম্যান সাহেবের ক্ষমতার দাপট দেখায় তারা। পেকুয়ার ইউএনও মোতাছেম বিল্যাহ জানান, আমরা দু’বার অভিযান পরিচালনা করেছি। বেড়িবাঁধ কেটেছে পাউবোর। রাস্তা কেটেছে সড়ক বিভাগের। ওনাদের কি করনীয়। বেআইনী কাজ কাউকে করতে দেয়া হবেনা। এ সব বন্ধ করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ বলেন, বেআইনী কাজ কাউকে করতে দেয়া হবেনা। জড়িতরা যতই শক্তিশালী হউক অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ জানান, আমরা অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করবো।
Posted ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৬ মার্চ ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta