কক্সবাংলা রিপোট(২৩ নভেম্বর) :: মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। গত এক বছরে ওই চুক্তির আওতায় কোনো ফল মেলেনি। বাংলাদেশের জোরালো প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেনাফের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিলেও ফেরার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারেনি। রাখাইনের পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় একজন রোহিঙ্গাও ফিরতে আগ্রহী নয়। এ অবস্থায় কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে সে বিষয়ে কোনো ধারণা করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে পরিবেশ সৃষ্টি না করেই মিয়ানমার জোর গলায় বলছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত। গত ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি হাউ দো সোয়ান বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ফিরতে চায় তাদের জন্য মিয়ানমারের দরজা খোলা।
বাংলাদেশ গত ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করেও পারেনি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জোর করে যেমন ফেরত পাঠাবে না তেমনি জোর করেও এখানে রাখবে না।
গত বছরের ২৩ নভেম্বর নেপিডোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সই হওয়া ‘রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের ফেরার ব্যবস্থা’ শীর্ষক চুক্তিতে প্রথম পর্যায়ে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আসবে পরে। অপরদিকে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান হলো ফিরে যাওয়া বা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গারাই নেবে।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে গত বছরের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সোয়া সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আদৌ কাঁধ থেকে নামানো যাবে কি না তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপরন্তু মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা এখনো এ দেশে আশ্রয়ের খোঁজে আসছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর বাংলাদেশ এখন জাপানের প্রস্তাব অনুযায়ী রোহিঙ্গা ‘মাঝিদের’ (নেতা) রাখাইন রাজ্যে পাঠিয়ে পরিস্থিতি দেখানোর চিন্তাভাবনা করছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, জাপানের ওই প্রস্তাবের ব্যাপারে মিয়ানমারের মনোভাব স্পষ্ট নয়। জাপানেরই উচিত তাদের ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের বিচার নিয়ে সরব থাকলেও চীন এর ঘোর বিরোধী। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) কৌঁসুলি রোহিঙ্গাদের গণবাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসার ঘটনার প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে। আনুষ্ঠানিক তদন্তের মতো প্রেক্ষাপট আছে কি না তা তিনি যাচাই করছেন।
অন্যদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ গঠিত সত্যানুসন্ধানী দল মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের সুপারিশ করার পর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণে কাঠামো সৃষ্টির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ভবিষ্যতে মিয়ানমারের বিচারের জন্য ওই কাঠামো কাজ করবে।
জানা গেছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে ৮১টি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এখনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। বরং পরিচয় যাচাইসাপেক্ষে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরলে তাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে দেশটি। তবে রোহিঙ্গারা এতে খুব একটা আশ্বস্ত হয়নি। আর এ কারণে প্রথম দফায় প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, সুরক্ষা ও অধিকার ছাড়া ফিরতে রাজি হয়নি।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন বিন আবদুল্লাহ গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিশ্বাসযোগ্য প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা থাকা জরুরি। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষা, মৌলিক স্বাধীনতা ও টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে নাগরিকত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়াসহ আসিয়ান সদস্যরা মিয়ানমারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ভারত ও চীন দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর পক্ষে। কারণ প্রত্যাবাসন শুরু না হলে এ সংকট আরো বাড়তে পারে। বিশেষ করে, অধিকারবঞ্চিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী, অপরাধী চক্র ব্যবহার করতে পারে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যে তহবিল গড়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল তা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। আগামী বছরের চাহিদা মেটাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহায়তায় নতুন করে তহবিল গড়তে হবে মানবিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে। কত দিন এভাবে সাহায্য দেওয়া যাবে তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে দুশ্চিন্তা রয়েছে।
Posted ১:৩১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৪ নভেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta