তার পরনে ডাক্তারের পোশাক দেখে দূর থেকে তাকে চেনা যায়। আগন্তুক পেশেহেতের নিকট গিয়ে তার ডান হাত মেলে ধরলেন। হাতের তালুর উল্টো পিঠে বেশ বড় গোলাকার ফোঁড়া জন্ম নিয়েছে। টকটকে লাল রঙের ফোঁড়া দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, আগন্তুককে বৃশ্চিক (কাঁকড়া) কামড়েছে। পেশেহেত তার ঝোলা কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখলেন। তারপর রোগীর হাত ধরে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে লাগলেন। চিকিৎসার দেবী সেরকেতকে উৎসর্গ করে মন্ত্র জপার মাধ্যমেই তিনি বিষের প্রাথমিক চিকিৎসা সারবেন। মন্ত্রপাঠ শেষে শুরু হবে আসল চিকিৎসা।

তখন পেশেহেত ডাক্তারের বিশেষ ছুরির সাহায্যে ফোঁড়াটুকু কেটে ফেলবেন। তারপর বিভিন্ন ভেষজ মিশ্রণ দিয়ে জখম পরিষ্কার করে দেবেন। এভাবে আরেকজন মানুষের সেবা করলেন তিনি। তার মতো আরো শত শত চিকিৎসকের নিষ্ঠার মাধ্যমে গড়ে উঠছিলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। সভ্য পৃথিবীতে চিকিৎসা ব্যবস্থার শুরু হয় আফ্রিকার গৌরব প্রাচীন মিশরের মাটিতে। আমরা আধুনিক যুগে Medical Care বলতে যা বুঝি, তার গোড়াপত্তন হয়েছিলো আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সালে। তবে চিকিৎসা বলতে আমরা যা বুঝি, তখন সেটা এর থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল।

নারী চিকিৎসক পেশেহেত; Image Source: Twitter

প্রাচীন মিশরে রোগের কারণ হিসেবে মানুষ দেবতাদের অসন্তুষ্টিকে দায়ী করতো। আমাদের চোখের অগোচরে চলাফেরা করা অদৃশ্য আত্মারা বিভিন্ন কারণে আমাদের শরীরের স্বাভাবিক অবস্থাকে বিকল করে দিতো। যার কারণে মানুষ রোগে ভুগতো, মহামারিতে আক্রান্ত হতো। গ্রামের পর গ্রাম মহামারির প্রকোপে সাফ হয়ে যেতো। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রদূত মিশর সভ্যতার বুদ্ধিজীবীগণ এই মহামারির হাত থেকে বেঁচে থাকতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের গবেষণায় জন্ম নেয় মানব দেহের রহস্যময় ‘চ্যানেল’ তত্ত্ব।

ইংরেজি চ্যানেল শব্দের অর্থ খাল। কৃষিক্ষেত্রে কৃষকদের খাল খনন থেকে এই তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছিল বলে এরূপ নামকরণ করা হয়। ধারণা করা হতো, মানুষের হৃদপিণ্ডের মোট ৪৬টি চ্যানেল রয়েছে। যখন অশুভ দেবতা বেহেদু তার ক্ষমতাবলে হৃদপিণ্ডের চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেন, তখন মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মিশরীয়দের মতে, মানুষের জীবনের নিয়ন্ত্রক ছিলেন দেবতারা। থোথ নামক এক দেবতার আশীর্বাদে মানুষ গর্ভধারণ করে এবং বেস নামক আরেক দেবতার মাধ্যমে একজন নারী বাচ্চা প্রসব করে।

আপাতদৃষ্টিতে চ্যানেল তত্ত্ব অনেকটা ভুল মনে হলেও, সভ্যতার অগ্রসরতায় এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একদম প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ রোগের কারণ হিসেবে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক কারণকে দায়ী করলেও এই তত্ত্বের মাধ্যমে চিকিৎসকগণ রোগের সাথে মানবদেহের যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হন। তাই চ্যানেল তত্ত্বকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

চিত্রকর্মে মিশরীয় কবিরাজ; Image Source: MyViralBox

নতুন তত্ত্ব আবির্ভাবের সাথে তাল মিলিয়ে মিশরের চিকিৎসকের আসনে আসীন হন মিশরীয় কবিরাজগণ। এর পূর্বে চিকিৎসার কাজ করতেন মন্দিরের পুরোহিতগণ। তবে এ বিষয়ে আরেকটু পরে আলোকপাত করা হবে। একদিকে যেমন চিকিৎসকগণ মানবদেহের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছিলেন, অপরদিকে বিভিন্ন অঞ্চলে অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম হতে থাকে। মিশরের এক অঞ্চলে ডাক্তারগণ চিকিৎসার জন্য নীল নদের বৈদ্যুতিক মাছ ব্যবহার শুরু করেন। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, তৎকালীন মানুষরা মাছের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাকে জাদু হিসেবে দেখতো। তাই বৈদ্যুতিক মাছ চূর্ণ করে রোগীর ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বহু মানুষ এই ঔষধ সেবন করে আরোগ্য লাভ করতেন। হয়তো পুরো ব্যাপারটি মনস্তাত্ত্বিক। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারগণ উত্তম চিকিৎসা প্রদান করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন মিশরের ডাক্তারগণ স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য অপরিষ্কার খাদ্য এবং কাঁচা মাছ ভক্ষণ করতে নিষেধ করতেন। সর্বপ্রথম মিশরে হাড় ভাঙা, পা মচকানোর চিকিৎসা এবং জখম সেলাই করানোর প্রচলন শুরু হয়। মিশরের দন্ত চিকিৎসকগণ দাঁত তোলা এবং দাঁত বাঁধাইয়ের কাজ করতে পারতেন। মিশরের চিকিৎসকগণ দাঁতের মাজন এবং টুথপেস্ট আবিষ্কার করেছিলেন। দিনে দিনে মিশরের চিকিৎসকদের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভিনদেশি সম্রাট, রাজা, বাদশাহগণ চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মিশর যাত্রা শুরু করতেন।

প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বের দাঁত বাঁধাই; Image Source: Pinterest

চিকিৎসার জ্ঞান প্রসার এবং উন্নতমানের চিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যে মিশরজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। বুবাস্তিস এবং আবিদস অঞ্চলে এরূপ দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম শোনা যায়। পেশাজীবী ডাক্তারগণ House of Life-নামক শিক্ষাকেন্দ্রে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নারী-পুরুষ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের শুরুর দিকে মানবদেহ নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায়, যেকোনো রোগ প্রতিরোধের চেয়ে জখমের চিকিৎসা করা সহজতর ছিল। তাই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতো, পূর্ব এবং ইহ জনমের পাপের শাস্তিস্বরূপ দেবতারা রোগ প্রদান করতেন। কিন্তু ঝামেলা বাঁধতো যখন সাধু শ্রেণীর কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তো। তখন ধরা হতো, হয়তো কোনো অসুরের কোপানলে পড়েছেন সাধু মশাই!

রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার; Image Source: Smithsonian Magazine

মিশরের ইতিহাসে প্রথম চিকিৎসকের নাম ছিল ইমহোটেপ। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৭ সালে তিনি মিশরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পেশায় স্থপতি ইমহোটেপ মিশরের বিখ্যাত পিরামিড নির্মাণের নকশা প্রণয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। দার্শনিকদের ভাষায়, ইমহোটেপ সর্বপ্রথম ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ চিকিৎসাব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি দাবি করতেন, মানুষ প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়, এর পেছনে দেবতাদের শাস্তির ধারণা মিথ্যা।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ সালের দিকে মিশরের রাজসভার প্রধান চিকিৎসক হিসেবে মেরিতাহ নামক এক নারীকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে মেরিতাহ সর্বপ্রাচীন নারী চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃত হন। কিন্তু সম্প্রতি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে নিম্ন মিশর অঞ্চলে নাইথের মন্দিরে আরেকজন নারী চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে তার নাম জানা সম্ভব হয়নি। মেরিতাহের পর মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী চিকিৎসক হিসেবে আবির্ভূত হন পেশেহেত।

সমসাময়িক বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে নারীদের চিকিৎসা পেশায় প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে এথেন্সের এগনোডাইস চিকিৎসক হওয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপ থেকে মিশরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রাচীন মিশরে নারীদের চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদানের এরূপ দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

মিশরে চিকিৎসাক্ষেত্রে নারী-পুরুষদের সমান অধিকার ছিল; Image Source: The Book Palace

কিন্তু এত স্বাধীনতার পরও মিশরে যে কেউ ইচ্ছা করলেই ডাক্তার হতে পারতো না। আধুনিক যুগের ভর্তি পরীক্ষার মতো তাদেরকেও বাছাই করা হতো। তবে সেটা গোল্লা ভরাটের খাতার মতো পদ্ধতি ছিল না। একজন ডাক্তারকে পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও দেহ এবং আত্মিক দিক থেকে পবিত্র হতে হবে। সেজন্য চিকিৎসকদের মিশরে ‘ওয়াবাউ‘ অর্থাৎ আত্মিকভাবে শুদ্ধ হিসেবে উপাধি প্রদান করে হতো।

একজন চিকিৎসক যেকোনো অঙ্গ কিংবা রোগ নিয়ে পড়াশোনা করে বিশেষজ্ঞ হতে পারতেন। তবে আরেকদল ডাক্তার ছিলেন যারা ঔষধপত্রের বদলে জাদু-টোনার মাধ্যমে চিকিৎসা করতেন। চিকিৎসকগণ সকল রোগের চিকিৎসা করলেও গর্ভবতী নারীর চিকিৎসা এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার অংশটুকু ধাত্রী নারীগণ সম্পন্ন করতেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। নারী এবং পুরুষগণ সেবক-সেবিকা হিসেবে ডাক্তারদের সাহায্য করতেন। মিশর সাম্রাজ্যে ডাক্তার, ধাত্রী এবং সেবিকাদের সমানভাবে মর্যাদা প্রদান করা হতো।

মিশরীয় ধাত্রী মাতাদের সন্তান পরিচর্যার চিত্র; Image Source: Ancient History

প্রাচীন মিশরের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি বর্তমানে পৃথিবীত বিখ্যাত জাদুঘরসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ এবং যুদ্ধবিগ্রহের জের ধরে বহু মূল্যবান দলিল কালের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে গিয়েছে। পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে দ্য চেস্টার বিটি প্যাপিরাস নামক দলিলটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালে রচিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদগণের তথ্যানুযায়ী, প্যাপিরাসের অনুচ্ছেদগুলোয় মানবদেহের নিম্নাঙ্গের বহু রোগের বর্ণনা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি এখানে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে।

বার্লিন প্যাপিরাস নামক পাণ্ডুলিপিটি গর্ভকালীন বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, যেখানে গর্ভকালীন চিকিৎসা পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাণ্ডুলিপিটি আনুমানিক ১৫৭০ খ্রিস্টপূর্বে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। হৃদরোগ, উদরাময় এবং মানসিক রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যসমৃদ্ধ পাণ্ডুলিপির নাম ইবেরাস প্যাপিরাস। শল্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রাথমিক জ্ঞান লিপিবদ্ধ করা রয়েছে এডউইন স্মিথ প্যাপিরাসের গায়ে। এরূপ শত শত পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাচীন মিশরীয় পণ্ডিতদের জ্ঞানপিপাসু, গবেষণাবান্ধব মন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।

এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস; Image Source: Ancient Europe

যদিও মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির বেশিরভাগই ভুল ছিল, কিন্তু আধুনিক যুগের উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দীর্ঘ সফরে পেশেহেতের মতো ডাক্তারদের অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতি অগ্রদূত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালক করেছে। তখন মানুষ জীবাণু সম্পর্কে জানতো না। বড় বড় ব্যাধির কারণ সম্পর্কে জানার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং প্রযুক্তি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি।

সামান্য কিছু ভেষজ ঔষধ আর ধারালো ছুরিই ছিল তাদের প্রধান সম্বল। তাই আজ হাজার বছর পরেও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিকট প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে পরিগণিত হন। মিশরীয় সভ্যতা যে চিকিৎসা পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেছিল, তা শত বছর পর ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে প্রাচীন গ্রিসের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে যায়। হিপোক্রেটিস, গেলেন প্রমুখের হাতে তা দুর্বার গতি লাভ করে। এভাবে হাজারো নাম না জানা পণ্ডিত এবং চিকিৎসকগণের প্রচেষ্টায় পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় চিকিৎসা বিজ্ঞান।

ফিচার ইমেজ: The Book Palace