কক্সবাংলা ডটকম(১৮ জুলাই) :: বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা শেয়ার রাইডিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ(৩৩) নিউইয়র্ক নগরের ম্যানহাটনে নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ১৪ জুলাই বিকেলে খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শুরুতে এই হত্যাকাণ্ডকে চরম পেশাদার কোনো খুনির কাজ বলে ধারণা করা হলেও ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ফাহিম সালেহর সাবেক ব্যক্তিগত নির্বাহী মাত্র ২১ বছরের টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে পুলিশ ১৭ জুলাই শুক্রবার সকালে গ্রেপ্তার করে।
যেভাবে ফাহিমকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল, গা শিউরে উঠে সেই কাহিনি শুনলে। ফাহিমকে হত্যা করার জন্য খুনি টাইরিস ডেভন হাসপিল (২১) টেজার গান (Taser gun) ব্যবহার করেছে।
এই টেজার হল একধরনের বিশেষ অস্ত্র। যেটা পুলিশ আর্মিরা এক্সট্রিম লেভেলের অপরাধীদের ধরাশায়ী করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। লেজার রশ্নি দিয়ে টার্গেট নিশ্চিত করা হয়। তারপর পিস্তলের স্টাইলে ইলেক্ট্রিক শক ছুঁড়ে মারা। টেজারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একধরনের সূক্ষ্ম মারাত্মক জিনিস। যা পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে শরীরে আঘাত করে শরীরকে কিছু সময়ের জন্য সম্পূর্ণ নিথর ও অসাড় করে দেয়। শরীরের ভেতরে প্রতিটি পয়েন্টে কন্ট্রাক্ট করে টেজার। ফাহিমকেও তাই করেছে টাইরিস হাসপিল।
টেজার দিয়ে আক্রমণ করে ফাহিমকে নিথর করে ফেলে খুনি। ফাহিমের শরীর সম্পূর্ণ ইমমোবালাইজ (Immobilize) হয়ে যাওয়ার পর তার ঘাড়ে গলায় পেটে উপুর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। খুন করে সোমবার দুপুরে। ফাহিমের ফ্ল্যাটে পুরো একদিন তার লাশ পড়ে থাকে।
পরদিন মঙ্গলবার টাইরিস আবার যায় ফাহিমের ফ্ল্যাটে। এরমধ্যে লাশ কেটে টুকরো টুকরো করার সব ব্যবস্থা সেরে নিয়েছে। Home Depot থেকে করাত কিনেছে। ঘর স্যানিটাইজ করার জিনিসপত্র কিনেছে। ফাহিমের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে প্রথমেই শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। তারপর একে একে হাত পা খন্ড বিখন্ড করেছে। সেগুলো প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে।
মেঝেতে জমে থাকা রক্ত পরিস্কার করেছে। ঘরের মেঝে পরিস্কার করার জন্য এই খুনি পোর্টেবল ভ্যাকুম ক্লিনার ব্যবহার করেছে। সব রক্ত রুমের এক কর্নারে জমিয়ে রাখে। হয়ত তার খুনির প্ল্যান ছিল সবশেষে রুমের কোনা পরিস্কার করবে। কিন্তু তার আগেই ফাহিমের কাজিন ডোর বেল বাজায়।
এতে টাইরিস তার কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। সে ইমার্জেন্সি এক্সিট ব্যবহার করে পালিয়ে যায়। খুন করার আগে টাইরিস নিঞ্জা মাস্ক, স্যুট টাই এবং হ্যাট পরে নিয়েছিল। ফাহিমের অটোপসি রিপোর্টে বলা হয় তার বুকে গভীরভাবে ছুরি ঢুকিয়ে ঘোরানো হয়েছিল। যাতে করে ফাহিমের বাঁচার নুন্যতম চান্স না থাকে।
ফাহিমের ফ্ল্যাটের এক প্রতিবেশী লিসা হেনকক (৫৩) যিনি পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। লিসা বলেছেন, “আমারই নেক্সট ডোর প্রতিবেশি ছেলেকে এভাবে ব্রুটালি মার্ডার (Brutally Murder) করা হল — অথচ বুঝতেই পারলাম ছেলেটাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ফাহিম যখন মার্ডার হচ্ছিল ঘড়ির হিসেবে আমি তখন বাসায় অবস্থান করছিলাম।
কিন্তু বুঝতেও পারলাম আমার প্রতিবেশি নির্মমভাবে খুন হচ্ছে…….. দিস ইজ হরিবল!! ফাহিম কত দয়ালু মনের ছিলো পরিচয় পাওয়া যায় খুনি টাইরিস হাসপিল ফাহিমের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে এক মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায়। এতবড় অংকের টাকা চুরি করার পরেও ফাহিম টাইরিসকে পুলিশে না দিয়ে টাকা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বলে দেয়।
যদিও সবাই মনে করছে ফাহিমের উচিত ছিলো তখনি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা। রিপোর্ট করলে বেঁচে যেত বাংলার সোনার ছেলে ফাহিম। কিন্তু ফাহিমের উদারতাই ঘাতক টাইরিসের মনে খুনের পরিকল্পনা এনে দেয়। এই ছেলের চেহারা দেখলে ইনোসেন্ট লাগে। কিন্তু ইনোসেন্ট চেহারার আড়ালে সে দুর্ধর্ষ খুনি ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝা যায়না। ফাহিম হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন সরকার হাই প্রোফাইল কেস হিসেবে নিয়েছে।
এনওয়াইপিডির চিফ অব ডিটেকটিভ রডনি হ্যারিসন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “টাইরিস ফেভন হাসপিল একজন উদীয়মান তরুণ। সে খুন করেছে আরেক উদীয়মান তরুণকে। যাকে স্মরণকালের সেরা নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড বলা যেতে পারে। খুন করার পর খুনি কিছু আলামত রেখে গেছে। যার ফলে আমরা তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম করেছি।
ফাহিমকে যেখানে হত্যা করা হয় সেখানে বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে anti-felon identification cards পেয়েছি আমরা এই কার্ড টেজারে ব্যবহার করা হয়। এসব অতি ক্ষুদ্র কাগজে সিরিয়াল নাম্বার লেখা থাকে। ফাহিম একজন ইয়ং মিলিওনিয়ার। আমেরিকায় তার ইনভেস্টমেন্ট আছে। এভাবে তাকে মেরে ফেলা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।”
তাকে গ্রেফতার করে যখন গোয়েন্দা কাস্টোডিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তখন উপস্থিত মিডিয়াকর্মীরা অনর্গল বাক্যবাণ ছুঁড়ছিলো তার উদ্দেশ্যে — হেই টাইরিস, তুমি এমন মর্মান্তিক হত্যাকান্ড কিভাবে ঘটাতে পারলে? তোমার বসকে কেটে খন্ড খন্ড করার সময় তোমার কি একবারও মনে হয়নি সে তোমাকে ১০০ মিলিয়ন ডলার চুরির জন্য তোমার বিরুদ্ধে পুলিশ রিপোর্ট করেনি!!
একবারও কি মনে হয়নি.?” মিডিয়াকর্মীদের ক্ষোভ এভাবে প্রকাশ পাচ্ছিলো। আমেরিকার প্রত্যেকটি নিউজ পেপার ফাহিম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কন্টিনিয়াসলি খবর ছেপেছে। এদিকে প্রবাসীরা মার্কিন পুলিশ প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে খুনিকে গ্রেফতার করেছে বলে। তাদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে খুনি টাইরিসের যোগ্য শাস্তি।
উল্লেখ্য, ফাহিম সালেহর জন্ম সৌদি আরবে। এরপর পরিবারের সঙ্গে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যান। পড়াশুনা করেছেন নিউ ইয়র্কে। সেখানেই বসবাস করতেন। মেধাবি ছাত্র ফাহিম নিউইয়র্কে একটি হাই স্কুলে পড়াবস্থায়ই উইজ টিন নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বেশ অর্থও আয় করতে সক্ষম হন। এরপর ম্যাসেচুসেটস স্টেটের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার ইনফরমেশন সিস্টেমে ব্যাচেলর করেন ফাহিম। উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন ফাহিম আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে কিংবা কোন কোম্পানীতে চাকরির চেষ্টা না করেই মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশে ছোটেন। ২০০৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে ফাহিম ঢাকায় হ্যাকহাউস নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা খুব একটা সফলতা পায়নি। ফের ফিরে যান আমেরিকায়। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় এসে প্রযুক্তি-ভিত্তিক কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হয়। এরমধ্যে পাঠাও উদ্যোগ সফল হয়েছিল। শুরুতে পণ্য পরিবহন সার্ভিস থাকলেও পরবর্তীতে রাইড শেয়ারিং সেবাও চালু করে পাঠাও।
১৫ জুলাই ম্যানহাটনে নিজের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছেন ফাহিম সালেহ (৩৩)। নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অল্প বয়সে সারা বিশ্বের নজরে এসেছিলেন তিনি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাঁর এগিয়ে যাওয়া অনুসরণ করতেন। ম্যানহাটনের সোয়া দুই মিলিয়ন ডলারের অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন তিনি।
Posted ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৯ জুলাই ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta