কক্সবাংলা ডটকম(৩০ মার্চ) :: বিতর্কের দরকার আছেÑ সত্যের সন্ধানে অটল থেকে বিতর্ক। সে ধরনের বিতর্কে দুই পক্ষেরই চেষ্টা থাকে সত্যের দিকে যাত্রারÑ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার। সে ধরনের বিতর্কে কোনো পক্ষেরই পরাজয় বা ব্যর্থতা নেইÑ তাতে উভয় পক্ষেরই চেষ্টা দ্বারা সত্যের পথে অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়। সত্যসন্ধ বিতর্ক আজ খুব দরকার। কিন্তু গত তিন দশক ধরে যেসব বিতর্ক চালানো হয়েছে সেগুলোকে বলা যায় একরকম মানসিক কুস্তিখেলা। হীনস্বার্থান্বেষীরা পক্ষ ও প্রতিপক্ষে বিভক্ত হয়ে একে অন্যকে পরাজিত করার জন্য যে বিতর্ক চালায়, তা সাহিত্যের গতিকে বিপথগামী করে আধুনিকতাবাদের আগে গিয়েছে রেনেসাঁস।
রেনেসাঁস যদিও পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জীবনেই আছে, তবু রেনেসাঁস বললেই লোকে কেবল ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও তার প্রভাবে পৃথিবীর অন্যান্য ভূভাগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৃষ্ট বৌদ্ধিক জাগরণকে বুঝে থাকেন। সে জন্য রেনেসাঁসের আকৃতি ও প্রকৃতিকে বোঝার প্রয়োজনে প্রথমে ইউরোপের রেনেসাঁসের দিকেই দৃষ্টি দিতে হয়। ইতিহাসের আধুনিক যুগ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করেছি। রেনেসাঁসের বিবরণ সংক্ষেপে দেওয়া দুঃসাধ্য। এখানে আমি ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের একটি লেখা থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করছি। মার্কস-এঙ্গেলস ছিলেন রেনেসাঁসের সন্তান। রেনেসাঁসকে তারা তাদের জীবনোপলব্ধি অনুযায়ী একটি যৌক্তিক পরিণতিতে উত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন।
এঙ্গেলস লিখেছেন (১৮৭৫ সালে লিখিত) :আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞানেরও সূচনা সেই মহান যুগটি থেকে যে যুগটিকে আমরা জার্মানরা নাম দিয়েছি আমাদের তৎকালীন জাতীয় বিপর্যয়ের নামে রিফর্মেশন, ফরাসিরা যাকে বলে রেনেসাঁস এবং ইতালীয়রা বলে সিন্্কুয়েসেন্টুÑ যদিও এই নামগুলোর কোনোটি দিয়েই এ যুগের তাৎপর্য পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় না।…. বাইজানটিয়ামের পতনের ভেতর দিয়েও যেসব পা-ুলিপি বেঁচে গিয়েছিল, রোমের ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে সেসব প্রাচীন মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, তাদের মধ্য দিয়ে প্রাচীন গ্রিসের এক নতুন জগৎ আত্মপ্রকাশ করল বিস্মিত পশ্চিমের কাছে।
এ জগতের উজ্জ্বল রূপের সামনে অদৃশ্য হলো মধ্যযুগের প্রেত। ইতালিতে শিল্পকলার অভাবনীয় প্রস্ফুটন ঘটল, মনে হলো যেন এ সেই প্রাচীন যুগের চিরায়ত শিল্পেরই প্রতিফলন, শিল্পকলার তেমন উন্নতি আর কোথাও কোনোদিন হয়নি। ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানিতে নতুন, প্রথম আধুনিক সাহিত্যের উদ্ভব হলো। তার অল্প কিছুকাল পরই এল ইংরেজি ও স্পেনীয় সাহিত্যের চিরায়ত যুগ। পুরাতন পৃথিবীর সীমা ভেঙে গেল।
তখনই পৃথিবী সত্য করে আবিষ্কৃত হলো এবং পরবর্তী কুটিরশিল্প থেকে বৃহৎ কারখানা শিল্পে উত্তরণের ও বিশ্ববাণিজ্যের ভিত্তি রচিত হলো আর তা থেকেই সূত্রপাত হলো আধুনিক বৃহদায়তন শিল্পের। গির্জার আধ্যাত্মিক একনায়কত্ব তখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, জার্মান জাতিগুলোর অধিকাংশই গির্জার এই একনায়কত্বকে প্রত্যক্ষভাবে বর্জন করে প্রটেস্ট্যান্ট মত গ্রহণ করল। আর লাতিন জাতিগুলোর মধ্যে আরবদের থেকে প্রাপ্ত ও নবআবিষ্কৃত গ্রিক দর্শনের দ্বারা লালিত স্বাধীন চিন্তার এক স্ফূর্তিদীপ্ত প্রেরণা ক্রমেই বেশি করে শিকড় গেড়ে বসতে লাগল এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর বস্তুবাদের রাস্তা তৈরি করে দিল।
তৎকালীন ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ আর চিন্তাধারার বিকাশ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন বর্ণনা করে এঙ্গেলস অত্যন্ত আবেগদীপ্ত ভাষায় লিখেছেন : এ হলো মনুষ্যজাতির অভিজ্ঞাত সর্ববৃহৎ প্রগতিশীল বিপ্লব। এই সময়টার প্রয়োজন ছিল মহাকায়দের, সৃষ্টিও করল মহাকায়দেরÑমননক্ষমতা, আবেগ ও চরিত্রবলের দিক দিয়ে মহাকায়, সর্বাঙ্গীনতা ও বিদ্যাবত্তার দিক দিয়ে মহাকায়। এই যে মানুষেরা যাদের সৃষ্টি অবলম্বন করে বুর্জোয়া শ্রেণির আধুকি শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের একেবারেই বুর্জোয়াসুলভ সীমাবদ্ধতা ছিল না। কালের দুঃসাহসিক চরিত্রই তাদের ব্যক্তিত্বকে কমবেশি রঞ্জিত করে তুলেছিল।
এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে এমন প্রায় কেউই ছিলেন না যিনি বহু ভ্রমণ করেননি, যার চার-পাঁচটা ভাষায় দখল ছিল না, যিনি একাধিক ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখাননি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি শুধু একজন বিরাট চিত্রশিল্পিই ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বিরাট গণিতবিদ, যন্ত্রবিদ ও ইনজিনিয়ার; পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা অনেক মূল্যবান আবিষ্কারের জন্য তার কাছে ঋণী।
আলব্রেখত দ্যুরার ছিলেন চিত্রশিল্পী, ক্ষোদক, ভাস্কর, স্থপতি, অধিকন্তু দুর্গ নির্মাণের যে পদ্ধতির তিনি উদ্ভাবক তার বহু ধারণাই অনেকদিন পর আবার গ্রহণ করেন মঁতালাঁবেরÑ গ্রহণ করে দুর্গ নির্মাণের আধুনিকতর জার্মান বিজ্ঞান। মেকিয়াভেলি ছিলেন রাজনীতিক, ঐতিহাসিক, কবি এবং সেই সঙ্গে আধুনিককালের প্রথম উল্লেখযোগ্য সামরিক গ্রন্থ-প্রণেতা। লুথার যে শুধু গির্জার আভগিয়াস আস্তাবল পরিষ্কার করেছিলেন তাই নয়, জার্মান ভাষাকেও আবর্জনামুক্ত করেছিলেন। আধুনিক জার্মান গদ্য তারই সৃষ্টি এবং যে উদাত্ত স্তোত্রটি ষোড়শ শতাব্দীর মার্সাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার কথা ও সুরও তিনি রচনা করেছিলেন।
তখনকার দিনের নায়কেরা শ্রমবিভাজনের দাস হয়ে পড়েননি, যে শ্রমবিভাগের একপেশেমিসহ নানা খর্বকর প্রতিক্রিয়া আমরা প্রায়শ দেখতে পাই তাদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। কিন্তু তাদের যা সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তা হলো, তাদের প্রায় সবাই সমসাময়িক জীবনস্রোতের গভীরে ব্যবহারিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তাদের জীবন ও কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন। পক্ষ অবলম্বন করেছেন তারা, লড়াইয়ে যোগ দিয়েছেন, কেউ বক্তৃতা ও লেখা দ্বারা, কেউ তরবারি হাতে, অনেকেই উভয়ত। সে জন্যই তাদের চরিত্রের পরিপূর্ণতা ও শক্তিমত্ততা, যা তাদের পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলেছে।
পুঁথিসর্বস্ব মানুষÑ এটা দেখা গেছে ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রেইÑ হয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির মানুষ, না হয় সাবধানী কূপম-ূক যারা কোনো রকম বিপদের ঝুঁকিই নিতে চান না।… যে মহান ইতালীয়দের থেকে আধুনিক দর্শনের শুরু, তাদেরই পাশাপাশি ইনকুইজিশনের দাহমঞ্চের জন্য শহীদ আর কারাগারের জন্য সত্যসাধক জোগাতে হয়েছে প্রকৃতিবিজ্ঞানকে। আর এটা বৈশিষ্ট্যসূচক যে প্রকৃতি নিয়ে স্বাধীন অনুসন্ধানকে নিপীড়ন করার ব্যাপারে প্রটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিকদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
সের্ভেত যখন রক্ত চলাচলের ধারা প্রায় আবিষ্কার করে ফেলেছেন তখন কালভাঁ তাকে পুড়িয়ে মারলেন। তাকে দুই ঘণ্টা ধরে জীবন্ত ভাজেন কালভাঁ। আর ইনকুইজিশন জিওনার্দো ব্রুনোকে সরাসরি পুড়িয়ে মারাটাকেই যথেষ্ট মনে করেছিল।এঙ্গেলস এমনিভাবে ইউরোপের আধুনিক যুগের কয়েকশ বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে মানুষের সৃষ্টিশীলতার, আবিষ্কার-উদ্ভাবনের ও মহত্ত্বের যে স্পিরিট বিধৃত, তাই রেনেসাঁস।
রেনেসাঁস একটা মনোভঙ্গি, মানসবৈশিষ্ট্য, মনের অবস্থা, মাইন্ডসেট, আবেগ-অনুভূতি-উপলব্ধি ও অনুসন্ধিৎসার ধরন। রেনেসাঁস হলো এমন এক বিচারপ্রবণতা যা মানুষের উন্নত মানসিক জীবন ও উন্নত আর্থিক জীবন দুটোতেই পরিপূর্ণ গুরুত্ব দেয়। রেনেসাঁস হলো এমন এক ধরনের অনুসন্ধিৎসা জিজ্ঞাসা ও সাধনা যা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর বা জাতির জীবনে বিশেষ বিশেষ কালে দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, চিন্তক, শিল্পী, সাহিত্যিক প্রমুখের জীবনে দেখা যায়। রেনেসাঁস হলো বৌদ্ধিক জাগরণ, চিন্তাগত জাগরণÑ মহৎ সব মানবীয় অনুভূতির, বৃত্তি-প্রবৃত্তির, বোধ-বুদ্ধির ও চেতনার জাগরণ।
রেনেসাঁসে আছে আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সৃষ্টি, আর ন্যায়-কল্যাণ ও সুন্দরের প্রতি অন্তহীন অনুরাগ। রেনেসাঁস হল সত্যসন্ধ, ন্যায়কামী, সৌন্দর্যপিপাসু মনের দুর্দমনীয় মহৎ সব প্রয়াস। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে রেনেসাঁসের প্রকাশ; তবে এতেই শেষ নয়Ñ এটা আরম্ভ মাত্র। রেনেসাঁসের প্রকাশ নতুন নতুন সৃষ্টি ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মধ্য দিয়েÑ শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রচিন্তা, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদির সৃষ্টিশীল প্রগতিশীল চর্চার মধ্য দিয়ে।
রেনেসাঁস এক ন্যায়-প্রতিষ্ঠাকামী ধনাত্মক বিকাশশীল বলিষ্ঠ চেতনা। বিকাশমান বাস্তবতার মধ্যে অনুভূতি-উপলব্ধি, চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণ যদি বিকাশহীন হয়ে পড়ে, আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও সৃষ্টির তাগিদ অবসিত হয় নৈতিক পতনশীলতা দেখা দেয়, তা হলে রেনেসাঁসের অবসান ঘটে।রেনেসাঁস কেবল একবার ইউরোপে দেখা দিয়েছিল, তা নয়। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই রেনেসাঁসের সন্ধান পাওয়া যায়।
‘স্বর্ণযুগ’ ও ‘অন্ধকার যুগ’ প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই আছে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও রেনেসাঁস দেখা দিয়েছিল যা পরবর্তীকালে ‘ইউরোপের রেনেসাঁসে’ প্রেরণাদায়ক শক্তিরূপে কাজ করেছিল। গ্রিক ও রোমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আরবদের মধ্যে রক্ষা পেয়েছিল এবং তাদের ইসলাম প্রচার ও পরবর্তী জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা রেনেসাঁসেরই এক অভিব্যক্তি।ইউরোপের যেসব ঘটনাকে রেনেসাঁস বলে অভিতি করা হয় তারা প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার জাতিসমূহের বা জনগোষ্ঠীসমূহের জীবনে।
উনিশ শতকের বাংলায়ও দেখা দিয়েছিল এমনি এক রেনেসাঁস বা চিন্তার জাগরণ যার ধারা বহমান থাকে বিশ শতকের অর্ধেকেরও বেশি সময়। বাংলাভাষার দেশে সেকালের ভাবুক ও কর্মীদের চিন্তাধারা অনুধাবন করলে রেনেসাঁসের উত্তাপ অনুভব করা যায়। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-কালে সেই চেতনা মরুভূমির মুখোমুখি নদীর দশা লাভ করেছে।
১৯৬০-এর ও ৭০ দশকে পশ্চিম বাংলায়, পূর্ব পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে কোনো কোনো মার্কসবাদী গোষ্ঠী উনিশ শতকের বাংলার জাগরণের বিরুদ্ধে প্রচার-আন্দোলনে ভীষণভাবে তৎপর থাকেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের গুণের দিকগুলোর দিকে না তাকিয়ে কেবল ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধানে তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত রাখেন।
বাংলাদেশে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্লোবালিজমের এবং মর্ডানিজম ও পোস্টমর্ডানিজমের সৃষ্টিসম্ভাবনাহীন রুগ্ন চেতনার ব্যাপক বিস্তার দেখা যাচ্ছে।বাংলাদেশের গবেষকরা যেসব কাজ করছেন সেগুলোতে কি সুস্থ স্বাভাবিক মনমননের সৃষ্টিশক্তির ও মহত্ত্বের কোনো পরিচয় আছে?ইউরোপের রেনেসাঁসের লক্ষণসমূহ দেখা দিতে আরম্ভ করেছিল তেরো শতকের ইতালিতে।
প্রভাবের পারস্পরিকতার মধ্যে একে একে ইউরোপের জাতিসমূহের ভেতর থেকে রেনেসাঁসের আলোকরশ্মি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে থাকে। ইউরোপে নানা বিপত্তি অতিক্রম করে গোটা উনিশ শতক পর্যন্ত বহমান থাকে রেনেসাঁসের ধারা। বিশ শতকে প্রবল হয় আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ। তবে বিশ শতকের সৃষ্টিশীল প্রগতিশীল সব দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরাও রেনেসাঁসের স্পিরিটকেই অন্তরে লালন করে সৃষ্টির ধারায় এগিয়েছেন।
আলবার্ট সুইজার, ওসওয়াল্ড স্পেংলার, উইলিয়াম জেমস, জন ডিউই, ফ্রয়েড, রবীন্দ্রনাথ, রাসেল, আইনস্টাইন, সাঁর্ত প্রমুখ মনীষী বিশ শতকেও রেনেসাঁসের উত্তরাধিকার বহন করে, অন্তরে রেনেসাঁসের স্পিরিটকে লালন করে, রেনেসাঁসের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে, রেনেসাঁসের আলোকরশ্মিকে পাথেয় করে পথ চলেছিলেন। আঠারো ও উনিশ শতকের জার্মান, ফরাসি ও ব্রিটিশ মনীষীরা রেনেসাঁসেরই ধারক-বাহক ও সম্প্রসারক ছিলেন।
মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুঙ রেনেসাঁসের ভাবপ্রবাহকেই তাদের বিবেচনা অনুযায়ী যৌক্তিক পরিণতির দিকে অগ্রসর করতে চেয়েছিলেন। চিন্তার দিক দিয়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, প্রগতিবাদ, কল্যাণবাদ, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদÑ এসব রেনেসাঁসেরই নানামুখী অভিব্যক্তি।
উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ হল রেনেসাঁসের বিকারÑ বিকৃত বিকাশ।রেনেসাঁসের মনীষীদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই, ভুল-ভ্রান্তি নেইÑ এ কথা একটুও ঠিক নয়। রেনেসাঁসের ধারায় আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্লেষণ, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি আছে। প্রতিভাবান ব্যক্তিরাও ভ্রান্ত কিংবা বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। সে জন্য বৌদ্ধিক পরিশোধনের ও নৈতিক অনুশীলনের দরকার হয়।
উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও বর্তমান বিশ্বায়নবাদের অভিজ্ঞতা থেকেও রেনেসাঁসের সাধকেরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। রেনেসাঁসকে আধুনিকতাবাদী ও উত্তরাধুনিকতাবাদীদের প্রচার-প্রচারণাকে অতিক্রম করে জানতে চেষ্টা করলে, রেনেসাঁস থেকে আজও মহত্তম সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করা সম্ভব। ‘অপরীক্ষিত জীবনযাপনযোগ্য নয়’, ‘আত্মা নং বিদ্ধি’, ‘কহড়ি ঃযুংবষভ’, ‘ষরাব ধহফ ষবঃ ড়ঃযবৎং ষরাব’ ‘ষড়াব ধহফ নব ষড়াবফ’Ñএসব রেনেসাঁসদীপ্ত মানুষেরই অন্তরের কথা।
কিন্তু এই অন্তর্মুখিতার সঙ্গে রেনেসাঁস সাধকেরা বহির্মুখী চর্চাও করেনÑ অন্তর্জগতের সঙ্গে বহিজগৎকেও জানতে প্রয়াসপর থাকেন। কেবল জানা নয়, জানার সঙ্গে করাÑ অর্থাৎ জ্ঞানকে উন্নত জীবনের জন্য কাজে লাগানো এবং জীবনপদ্ধতি, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনÑ এটাও রেনেসাঁসেরই অন্তর্গত। রেনেসাঁসের শিল্প-সাহিত্যের মধ্যেও মানবীয় গুণাবলি বিকাশের ও প্রগতিশীল জীবনের প্রেরণা থাকে।বাংলার মনীষায় ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাবÑ পরাধীনতার মধ্যেওÑ অতুলনীয় সুুফল ফলিয়েছে।
রামমোহন, ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, ত্রিবেদী, প্রফুল্লচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচরন্দ্র, রোকেয়া, সিরাজী, এস ওয়াজেদ আলি, লুতফর রহমান, আবুল হুসেন, ওদুদ, বরকতুল্লাহ, নজরুল মোতাহের হোসেন, মোতাহার হোসেন প্রমুখ মনীষী রেনেসাঁসেরই সন্তান। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, জয়নুল, কামরুল সুলতান জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে রেনেসাঁসের স্পিরিটকেই অন্তরে লালন করেছিলেন। তাদের সৃষ্টি ঐতিহ্যবাহী অথচ স্বকীয়তায় ভাস্করÑ নতুন।ইউরোপে এবং বাংলায় বৌদ্ধিক জাগরণের ধারায় দেখা দিয়েছিল গণজাগরণ। ফরাসি বিপ্লবের চেতনা রেনেসাঁসের চেতনারই সম্প্রসারণ।
এ দেশে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন, জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ সাধন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল রেনেসাঁসের স্পিরিট। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্য ও তার অনুসারীদের সাধনার মধ্য দিয়েও বাংলায় রেনেসাঁস দেখা দিয়েছিল। সীতাকুট, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, বিক্রমপুর, ময়নামতি, লালমাই, চান্দিনা ও শ্রীচটলে বৌদ্ধযুগের যেসব বিহার, সঙ্খরাম ও চৈত্যের অবশেষ বর্তমান এবং হিউয়েন সাঙ প্রমুখ সেকালের চিনা ভিক্ষু ও পরিব্রাজকদের লিখিত যেসব বিবরণ আজও টিকে আছে, সেগুলো বলে দেয়, শীলভদ্র-দীপঙ্করের কালেও বাংলায় চিৎপ্রকর্ষ বা রেনেসাঁস দেখা দিয়েছিল।
আজকের দিনেও বাংলাদেশে, এশিয়ায় ও ইউরোপ-আমেরিকায়, অনেকে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে, রেনেসাঁসের চেতনাকে অন্তরে লালন করেনÑ রেনেসাঁসের স্পিরিট নিয়ে চলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আধুনিকতাবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ ও বিশ্বায়নবাদের ছকবাঁধা চিন্তা ও কর্মের প্রবল তোড়ে তারা ভেসে যান, মাথা তুলতে পারেন না। বিশ শতকের বাংলা ভাষার ভাবুকদের মধ্যে শিবনারায়ণ রায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন রেনেসাঁসের স্পিরিট দ্বারা। এ বিষয়ে তার লেখা অন্তত চারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আছে। যদুনাথ সরকার, অন্নদাশঙ্কর রায়, নীহাররঞ্জন রায়, সুশোভন সরকার, আবু সয়ীদ আইয়ুব, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখের অবলম্বন ছিল রেনেসাঁসের স্পিরিট।সৃষ্টির ও প্রগতির জন্য দরকার সংশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। কেবল প্রতিবাদী ভূমিকা অবলম্বন করে চলা ঠিক নয়।
বাংলাদেশে যারা প্রতিবাদী ও নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে উগ্রতার সঙ্গে মত প্রকাশ করেন, কেবল প্রতিবাদে মত্ত থাকেন, চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে আসলেই কি তাদের কোনো দান আছে? চলতে হবে হয় ঃযবংরং না হয় ংুহঃযবংরং অবলম্বন করে, ধহঃরঃযবংরং অবলম্বন করে নয়।বাংলাদেশে চিন্তার ক্ষেত্রেÑ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন বিরাজ করছে এক অদ্ভুত রকমের স্থবিরতা; প্রগতিশীল কোনো কিছুকেই দানা বাঁধানো যাচ্ছে নাÑ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগোনো যাচ্ছে না। প্রগতির মুখোশপরা অপক্রিয়াশীলেরা প্রগতিশীল যে কোনো প্রবণতাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিচ্ছে। অপশক্তি ভয়ঙ্কর রকম জটিল, কুটিল ও প্রবল।
এ অবস্থায় উসকানিমূলক লেখা, অপ্রয়োজনীয় এমনকি ক্ষতিকর আক্রমণাত্মক লেখা, বিতর্কের বিষয় নয় এমন সব বিষয়কে বিতর্কের বিষয় বানিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে জনজীবনের চাহিদার সঙ্গে প্রতারণা করা, প্রতিবাদীর ছদ্মাবরণ নিয়ে হইচই বাঁধিয়ে অনুচিত স্বার্থ হাসিল করে নেওয়া ইত্যাদি খুব চলছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এগুলোকেই সহায়তা দিচ্ছে। প্রগতিশীল প্রবণতা ও প্রচেষ্টা সহায়তা পাচ্ছে না। ভালো অর্থে সমালোচনা নেই, চিন্তা ও অনুভূতির পরিশোধন নেই। এরই মধ্যে বুদ্ধিজীবী মহলে সার্বিক কর্তৃত্ব দখল করে আছেন এনজিওপতিরা ও সুশীল সুজনেরা। সৃষ্টিবৈরী এই বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সুস্থ চিন্তার, নতুন সৃষ্টির ও প্রগতির অনুকূল বাস্তবতা তৈরি করতে হবে।আগে বলেছি এবং আবার বলছি, বিতর্কের দরকার আছেÑ সত্যের সন্ধানে অটল থেকে বিতর্ক। সে ধরনের বিতর্কে দুই পক্ষেরই চেষ্টা থাকে সত্যের দিকে যাত্রারÑ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার।
সে ধরনের বিতর্কে কোনো পক্ষেরই পরাজয় বা ব্যর্থতা নেইÑ তাতে উভয় পক্ষেরই চেষ্টা দ্বারা সত্যের পথে অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়। সত্যসন্ধ বিতর্ক আজ খুব দরকার। কিন্তু গত তিন দশক ধরে যেসব বিতর্ক চালানো হয়েছে সেগুলোকে বলা যায় একরকম মানসিক কুস্তিখেলা। হীনস্বার্থান্বেষীরা পক্ষ ও প্রতিপক্ষে বিভক্ত হয়ে একে অন্যকে পরাজিত করার জন্য যে বিতর্ক চালায়, তা সাহিত্যের গতিকে বিপথগামী করে। সমালোচনা সম্পর্কেও একই কথা। বৌদ্ধিক জাগরণ ও পরিশোধনের জন্য সমালোচনা অপরিহার্য। দরকার সত্যসন্ধ গঠনমূলক সমালোচনা।
বার্টান্ড রাসেলের একটি কথা খুব মনে পড়ে। রাসেল লিখেছেন, ‘আদর্শপরায়ণতার নামে যা চলছে তার অধিকাংশই হয় ছন্দ ঘৃণা না হয় ছদ্ম ক্ষমতানুরাগ। বিপুল জনসাধারণকে যখন আপনারা কোনো মহৎ অনুপ্রেরণার নামে আন্দোলিত হতে দেখেন, তখন আপনাদের কর্তব্য একটু গভীরে দৃষ্টি দিয়ে নিজ নিজ অন্তরকে জিজ্ঞেস করা : এই অনুপ্রেরণার পেছনে ক্রিয়াশীল প্রকৃত কারণটা কী? মহত্ত্বের এতই আকর্ষণ যে, তার মুখোশ দেখলেই জনগণ তার প্রতি ধাবিত হয়।’ মুখোশ দেখেই যাতে আমরা প্রতারিত না হই সে জন্য আমাদের পরিপূর্ণ সতর্কতা দরকার, সর্বোপরি দরকার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃষ্টির পথে নব নব অভিযান।
শেষ পর্যন্ত তরুণ সমাজের ওপরই উন্নততর নতুন ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। মানবজীবনের বিরাট-বিপুল-অন্তহীন সম্ভাবনার উপলব্ধি নিয়ে তরুণ সমাজ যদি জেগে ওঠেÑ সৃষ্টির ও প্রগতির লক্ষে তৎপর হয়, তা হলে অপশক্তি যত প্রবলই হোক, টিকতে পারবে না। বাংলাদেশে নতুন সৃষ্টির প্রয়োজনে সত্যসন্ধ মন নিয়ে উত্তরাধুনিকতাবাদ, আধুনিকতাবাদ ও রেনেসাঁসের স্বরূপ জানা আজ একান্ত দরকার। তবে মনে রাখতে হবেÑ সৃষ্টির পথ তৈরি থাকে না, তৈরি করে নিতে হয়। বদ্ধ বিশ্বাস নয়, চাই স্বাধীন চিন্তাশীলতা।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : চিন্তাবিদঅবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ২:১১ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ৩০ মার্চ ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta