বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৬৭ শতাংশই বহন করতে হয় ব্যক্তিকে। চিকিৎসা নিতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের হার এর চেয়ে বেশি কেবল পাঁচটি দেশে।
পরিবারের স্বাস্থ্য সেবাসংশ্লিষ্ট সব ধরনের প্রত্যক্ষ ব্যয়কে ব্যক্তিগত ব্যয় (আউট অব পকেট হেলথ এক্সপেন্ডিচার) হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা ও ওষুধ বাবদ ব্যয়, থেরাপিসংশ্লিষ্ট উপকরণ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবা।
২০১৪ সালের তথ্যের ভিত্তিতে ডব্লিউএইচও বলছে, রোগ-ব্যাধি নিরাময়ে ব্যক্তিগত ব্যয়ের হার সবচেয়ে বেশি ইয়েমেনে ৭৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। এরপর এর হার সবচেয়ে বেশি আফ্রিকার দেশ সুদানে ৭৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।
এছাড়া কম্বোডিয়ায় চিকিৎসায় ব্যক্তির পকেট থেকে যায় ৭৪ দশমিক ১৯, আজারবাইজানে ৭২ দশমিক শূন্য ৮ ও নাইজেরিয়ায় ৭১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে ব্যক্তিব্যয়ের হার ৬৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা নিতে ১০০ টাকা ব্যয় হলে ৬৬ টাকা ৯৮ পয়সাই বহন করতে হয় ব্যক্তিকে। প্রতি বছরই এ হার বাড়ছে।
একদিকে রোগ নিরাময়ে ব্যক্তিগত ব্যয়ের হার বাড়ছে, অন্যদিকে বদল হচ্ছে রোগের ধরনও। আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রোগের অভিমুখ এখন সংক্রামক থেকে অসংক্রামকের দিকে। ১৯৮৬ সালে মাত্র ৮ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে ঘটলেও এখন মারা যাচ্ছে ৬৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই ছিল অসংক্রামক রোগে ভুগে। আর ২০১৪ সালে এ হার ছিল ৫৯ শতাংশ।
দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল অসংক্রামক রোগের বিস্তৃতি বাড়ায় এর চিকিৎসা নিতে গিয়ে আর্থিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে সমাজের বিপুল জনগোষ্ঠী। সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্যমতে, চিকিৎসা নিতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের উচ্চহারের কারণে প্রতি বছর প্রায় অর্ধকোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।
এদেরই একজন বরিশালের ধনঞ্জয় রায়। স্ত্রী মনখুশি রায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে এখন প্রায় নিঃস্ব এক সময়ের এ সচ্ছল কৃষক। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে থেকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কোনো রকমে স্ত্রীর চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে মনখুশি রায়ের ১২টি কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। এখন চলছে রেডিওথেরাপি। নয় মাস ধরে স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে প্রায় নিঃস্ব ধনঞ্জয় রায়ের দুশ্চিন্তা এখন রেডিওথেরাপি শেষ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে।
ধনঞ্জয় রায় বলেন, তার পক্ষে স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ জোগাড় করা সম্ভব নয়। মনখুশি রায়কে ১২টি কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। এজন্য প্রতিবার খরচ হয়েছে ২০-২৫ হাজার টাকা। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে গবাদিপশু থেকে শুরু করে জায়গা-জমির সবটুকু বিক্রি ও বন্ধক দেয়া হয়েছে। এখন আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মনখুশি রায়ের চিকিৎসা চলছে।
অবস্থা ভিন্ন নয় কুড়িগ্রামের রৌমারীর নাজমা বেগমের পরিবারেরও। কিডনি সমস্যার কারণে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। প্রায় তিন বছর ধরে ডায়ালাইসিস চলছে। প্রতিবার ডায়ালাইসিসে খরচ হয় ২ হাজার ৩০০ টাকার মতো। কিন্তু অর্থাভাবে দিতে পারছেন মোটে একদিন, কখনোবা দুদিন। এক-দুদিনের ডায়ালাইসিসের খরচ জোগাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে নাজমা বেগমের স্কুলশিক্ষক স্বামীকে। এরই মধ্যে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। জায়গা-জমি বিক্রি করাও শেষ। আছে কেবল চাকরিটাই।
চিকিৎসা নিতে অস্বাভাবিক ব্যক্তিব্যয়ের কারণে তাদের মতো নিঃস্ব হচ্ছে আরো অনেকেই। ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্যমতে, স্বাস্থ্যব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে ৪০-৫০ লাখ মানুষ।
অসংক্রামক রোগের উচ্চব্যয় মানুষকে কেবল নিঃস্বই করছে না, অর্থনীতির ওপরও চাপ তৈরি করছে বলে জানান আইসিডিডিআর,বির অসংক্রামক রোগ কর্মসূচির প্রধান ড. আলিয়া নাহিদ।
তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগের কারণে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যর্থ হচ্ছে। এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। এসব রোগের চিকিৎসা করতে করতে মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। এ চাপ কমাতে সবার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ছোটবেলা থেকে সঠিক জীবনযাত্রার সঙ্গেও অভ্যস্ত হতে হবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এরই মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী, জীবনযাত্রার মান নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কথা। এ স্বাস্থ্যসেবা পেতে কাউকে যাতে আর্থিক দীনতায় পড়তে না হয়, তাও উল্লেখ করা হয়েছে ঘোষণায়। যদিও এ ঘোষণা বাস্তবায়ন হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। ফলে কমছে না ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যব্যয়ের উচ্চহার।
তবে সরকার বিষয়টিতে বিশেষ নজর দিচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, দেশব্যাপী সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলকভাবে চালু করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যারা সচ্ছল তাদের প্রিমিয়াম নিজেরা যাতে দেয়, সেটি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। আর অসচ্ছল ব্যক্তিদের প্রিমিয়াম সরকার দেবে।
এরই মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার তিনটি উপজেলায় সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির (এসএসকে) আওতায় হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসার জন্য হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালু করেছে। বছরে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা ৫০টি রোগের চিকিৎসা পাচ্ছেন।