কক্সবাংলা ডটকম(৯ নভেম্বর) :: প্রবাসীদের পরিবার ও স্বজনদের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ পৌঁছে দিতে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিকাশ, রকেট, এম ক্যাশ, ইউ ক্যাশসহ অন্যান্য মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ দ্রুত প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়ামে ‘ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক কর্মশালায় বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধূরীর সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী। এতে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. শাহ মো. আহসান হাবিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল।
বিআইবিএমের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমলেও তা বাংলাদেশে অনেক বেশি কমে গেছে। বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই এজন্য দায়ী।
এছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমার পেছনে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকের শাখার দূরত্ব, অর্থ পেতে সময়ক্ষেপণ, ব্যাংকারদের সদাচরণের অভাব, নানা ধরনের জবাবদিহিতা, বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্রের প্রয়োজনীয়তা, সাপ্তাহিক ছুটি, অবৈধ অভিবাসীসহ বেশ কয়েকটি কারণকেও দায়ী করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
বিশ্বের শীর্ষ ১০ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশের তালিকার দশম স্থানে বাংলাদেশের নাম রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে চলতি বছর বিশ্বের গড় ব্যয় ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। যদিও এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর গড় ব্যয় ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে।জি২০ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রেমিট্যান্স পাঠাতে গড়ে সবচেয়ে বেশি ১৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় জাপান থেকে রেমিট্যান্স পাঠাতে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকে রেমিট্যান্স পাঠাতে গড়ে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ, কানাডা থেকে ৭ দশমিক ৮৪, যুক্তরাজ্য থেকে ৭ দশমিক ৮৬, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫ দশমিক ৭৬ এবং সৌদি আরব থেকে ৫ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব। গবেষণায় দেখা যায়, সৌদি আরব থেকে নেপালে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়। অথচ বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যয় হয় ৩ দশমিক ১ শতাংশ অর্থ। ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের সবচেয়ে বেশি গড়ে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়।
অনুষ্ঠানে ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, কয়েক বছর ধরেই রেমিট্যান্সপ্রবাহে শ্লথ প্রবৃদ্ধি। তবে গত মাসে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এটিকে ধরে রাখার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ অবৈধভাবে দেশে আসছে। হুন্ডি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন উপায়ে এটিকে কমিয়ে আনতে হবে। সেজন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়নে অবৈধ চ্যানেলে লেনদেন বন্ধ করতে হবে বলেও জানান ডেপুটি গভর্নর।
বিআইবিএমের গবেষণায় বলা হয়, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে প্রবাসীরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ব্যাংকগুলোর শাখার দূরত্ব। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে নানা ধরনের ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়। এছাড়া গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যাংকারদের আচরণের কারণেও সাধারণ মানুষ রেমিট্যান্সের টাকা আনতে ব্যাংকে যেতে চান না। সাপ্তাহিক ছুটিসহ কর্মদিবসের বাইরে রেমিট্যান্সের অর্থ হাতে না পাওয়াও গ্রাহকদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুত্সাহিত করছে।
অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিং বা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো প্রেরক ও প্রাপক দুপক্ষের জন্যই সুবিধাজনক। এ ব্যবস্থায় দিনে-রাতে কিংবা ছুটির দিনও যেকোনো মুহূর্তে বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকেই রেমিট্যান্সের অর্থ পরিবারের কাছে প্রবাসীরা পাঠাতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে মোবাইল নম্বর ভুল হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। অন্য মোবাইল নম্বরে টাকা চলে গেলে সেটি উদ্ধার করাও অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। শুধু ‘বিশ্বাস’কে পুঁজি করে মানুষ হুন্ডিতে টাকা পাঠায়। এক্ষেত্রে প্রাপককে টাকা না দিলে তা আদায়ের কোনো আইনগত ডকুমেন্ট থাকে না।
বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াছিন আলি বলেন, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার কারণে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেল কাজে লাগাতে হবে। গত পাঁচ বছর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পরিসর অনেক বেড়েছে। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে এটিকে কাজে লাগানো হয়নি।
এ কারণে দ্রুত মোবাইল ব্যাংকিংকে রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে না পারলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরো কমে যেতে পারে। অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে যেসব সুবিধা প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া হয়, সেসব সুবিধা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেয়া উচিত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক এবং পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে খরচ বেশি। এ খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া ব্যাংকারদেরকে গ্রাহকদের সঙ্গে আরো ভালো আচরণ করতে হবে। কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে।
এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, এমএফএসকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। তা না হলে হুন্ডি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে এমএফএসকে তদারকি করতে হবে।
Posted ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta