কক্সবাংলা ডটকম(২২ নভেম্বর) :: বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সানুহার এমআর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে। এরপর তা আর নবায়ন করা হয়নি। নিয়মিত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটিও নেই বিদ্যালয়টির। বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে আয়-ব্যয় পরিচালনা করা হয় না। ব্যাংকের মাধ্যমে করা হয় না আর্থিক লেনদেনও, যা আর্থিক বিধিবিধানের পরিপন্থী।
চলতি বছরের এপ্রিলে বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে গিয়ে এসব অনিয়ম খুঁজে পান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তারা। আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ মেলে উপজেলাটির ডব্লিউবি ইউনিয়ন মডেল (পাইলট) ইনস্টিটিউশন পরিদর্শনেও।
রুটিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নিয়মিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিদর্শন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, পরিদর্শনে উঠে আসা বিভিন্ন অনিয়ম বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রথমে সতর্ক করা হয়। একই অনিয়ম আবারো খুঁজে পেলে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানে বড় কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে স্বীকৃতি বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও নজির আছে।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্কুল, কলেজ ও সব ধরনের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়া বিদ্যালয়গুলোর তালিকায় রয়েছে নরসিংদীর আলীজান জেএম একাডেমি। ২০১৭ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরণ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পায় তদন্ত কমিটি। অনিয়ম ধরা পড়ে প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক কার্যক্রমেও।
গত জুনে মেহেরপুর সদর উপজেলার এআরবি কলেজে বেশকিছু আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পান নিরীক্ষা কমিটির সদস্যরা। পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলেজটির জাল সনদে নিয়োগ দিয়ে এক শিক্ষিকাকে ১২ লাখের বেশি টাকা প্রদান করা হয়েছে। বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে আয়-ব্যয় পরিচালনা করা হয় না, আর্থিক লেনদেনও ব্যাংকের মাধ্যমে করা হয় না। চালু করা হয়নি শিক্ষকদের ভবিষ্য তহবিল। এমনকি এর আগের পরিদর্শনে দেয়া সুপারিশগুলোও এখনো বাস্তবায়ন করেনি বিদ্যালয়টি।
নতুন করে প্রতিষ্ঠিত নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে পরিদর্শক দল। অনিয়মের তালিকায় রয়েছে নড়াইলের সদর উপজেলার দেবভোগ নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক মুস্তাহিদ আল আমিন দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে বেতন নিচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে পরিদর্শন প্রতিবেদনে। বিধিসম্মত উপায়ে নিয়োগ সম্পন্ন না হওয়ায় এ শিক্ষককে দেয়া সাড়ে ৩ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া বিদ্যালয়টিতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি থাকলেও তা নিয়মিত নয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিল চালু নেই। আর্থিক লেনদেনও ব্যাংকের মাধ্যমে করে না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় না করার বিষয়টি স্বীকার করেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক বকুল বিশ্বাস। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কম হওয়ায় ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হতো না। পরিদর্শক দল আসার পর থেকে এখন ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। আর একজন সহকারী শিক্ষকের সনদে কিছু ভুল-ভ্রান্তি ছিল। তা সংশোধন করে ডিআইএতে পাঠানো হয়েছে।
শিক্ষার্থী সংখ্যার তুলনায় অতিরিক্ত বই নিয়ে তা বিক্রি করে দেয়ার তথ্যও উঠে এসেছে ডিআইএর পরিদর্শনে। রাজধানীর গোড়ান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে এ ঘটনার প্রমাণ পান পরিদর্শকরা। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়টির প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪২৫।
কিন্তু ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন মিলন ৩ হাজার ৫৬৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষা অফিসে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য একটি চাহিদাপত্র পাঠান। তার ভিত্তিতে ৩ হাজার ৫৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যের পাঠ্যবই সংগ্রহ করেন তিনি। পরে ৪২৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে সরকারি বই সরবরাহ শেষে বাকি ৩ হাজার ১৩৫ সেট বই রাজধানীর ১৩টি বেসরকারি স্কুলের কাছে বিক্রি করে দেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক এ ধরনের অনিয়মকে খুবই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা নৈতিকতা শেখার ক্ষেত্রে অনুসরণ করবে তাদের শিক্ষকদের। অথচ বর্তমানে শিক্ষকরাই বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
বিশেষ করে কিছু প্রতিষ্ঠানপ্রধান বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মে জড়াচ্ছেন। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়; এটা এক ধরনের বৃত্তি। এখানে এসে কেউ যদি এ ধরনের অনিয়ম করে; তিনি নৈতিকভাবে শিক্ষকতা করার অযোগ্য।
অনিয়মে পিছিয়ে নেই মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেরপুরের নাচন মহুরী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় যান নিরীক্ষা কর্মকর্তারা।
পরিদর্শন শেষে তারা বলেন, মাদ্রাসাটির স্বীকৃতির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৩ সালে, যদিও এখনো তা নবায়ন করা হয়নি। এমনকি ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদও ২০১৬ সালে ফুরিয়ে যায়। সনদ জাল হওয়ায় মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষকের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে পরিদর্শক দল। এছাড়া আগের পরিদর্শন প্রতিবেদনে জমি খারিজ বিষয়ে নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
স্বীকৃতির মেয়াদ পূর্ণ হলেও তা নবায়ন না করেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে সাতক্ষীরার কলারোয়া শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির স্বীকৃতির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৫ সালে। বিদ্যালয়টিতে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়মিত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি নেই, বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে আয়-ব্যয় পরিচালনা করা হয় না, এমনকি আর্থিক লেনদেনও ব্যাংকের মাধ্যমে করা হয় না, যা আর্থিক বিধি-বিধান পরিপন্থী।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, দেশের বেসরকারি স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজগুলো পরিচালিত হয় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এর ফলে নিয়মিত এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম তদারকি সম্ভব হয় না। এ সুযোগে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন।
এর পরও নিরীক্ষা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর, স্থানীয় শিক্ষা অফিস ও বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে। অভিযোগের ভিত্তিতেও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা হয়। সব মিলিয়ে মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
Posted ১২:৪২ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta