কক্সবাংলা ডটকম(১৯ আগস্ট) :: চার দিনের ঢাকা মিশনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের অভিযোগ সত্য কিনা, তার কোনো জবাব সরাসরি না দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগই খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে ফিরে গেলেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। এজন্য নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থার পরামর্শও তার। এ নিয়ে সরকার দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মরিয়া সাবেক বিরোধী দল বিএনপি। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিতে অবিলম্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
তবে মিশেল ব্যাচেলেটের এমন সতর্ক বার্তা এবং বিএনপির পুরনো গীতে কোনো চাপ অনুভব করছে না ক্ষমতাসীনরা। তারা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তদন্ত করার কোনো এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে যে মানবাধিকার, এমন মানবাধিকার আমরা চাই না।
গত বুধবার আওয়ামী লীগের এক বিক্ষোভ সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বুধবার বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত করার সুযোগ নেই। বিএনপি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। তাদের মহাসচিব বোধহয় জানেন না, তারা যে নালিশ করেছেন, তার বিচার করার এখতিয়ার মিশেল ব্যাচেলেটের নেই। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তদন্ত করার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই।
বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের উচিত ফিলিস্তিন, মিয়ানমারের দিকে নজর দেয়া। ভালো হতো যদি হাইকমিশনার ২০১৩-১৪-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসে আহত-নিহত পরিবারের সদস্যদের কথা শুনতেন। আর রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে বাংলাদেশকে বাহবা দিলেই হবে না, মিয়ানমারে গিয়ে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়া নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটা এসব দেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের নজর দেয়া উচিত।
বিএনপির তৎপরতার বিষয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী জিয়া ও তার দল। জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করেছিল, খুনিদের পুনর্বাসিত করেছিল। শুধু তাই নয়, ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে হাজার হাজার সেনাসদস্যকে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল। আর ২০১৩-১৪-১৫ সালে তার তৈরি করা বিএনপি ও তাদের দোসর জামায়াতের হরতাল-অবরোধের নামে শত নিরীহ মানুষকে পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ব্যাচেলেটের মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ডিজিটাল নিরাপত্তা দিতেই এই আইন। আমাদের এ আইন নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, তাদের বলব অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরের আইনের দিকে তাকান। সেখানে আমাদের চেয়েও কঠিন ধারা আছে। ভারত ও পাকিস্তানেও এ রকম ধারা আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফ্রেমওয়ার্ক ল’ করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। সেটির আলোকে সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের আইন করেছে। কই, সেগুলো নিয়ে তো কোনো কথা বলেন না।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মিশেল ব্যাচেলেট এসেছেন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করতে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘের দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি কোনো কথা বলেননি। অথচ এখানে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, তাদের বিষয়েও জাতিসংঘ কোনো কথা বলেনি। ২০০১ সালের পর হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, নারী ধর্ষণ করা হয়েছে তখনও আমরা মানবাধিকারের কথা এদের কাছ থেকে শুনিনি।
এদেশে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, সেই বিএনপি-জামায়াতের থেকে সবক নিয়ে মিশেল ব্যাচেলেট যে কথা বলেছেন, তাতে মনে হয় না বাংলাদেশের মানবাধিকারকে তারা শক্তিশালী করবে। তার বক্তব্যের ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তি আবার অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ক্ষতি করবে। আমার মনে হয়, এই সব কিছুর পেছনে কোনো অশুভ উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট ও এরপর ইনডেমনিটি দিয়ে হত্যাকারীদের বিচারের পথ বন্ধ করেছিল বিএনপি, সেটা নিয়েও জাতিসংঘের কোনো মন্তব্য বা উদ্যোগ আমরা দেখিনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনার পরও তাদের তৎপরতা আমরা দেখিনি। এখন হঠাৎ কী এমন হলো যে, তাদের তৎপর হতে হবে? আমরা মনে করি, আমাদের দেশের মানবাধিকার বিশ্বের অন্যান্য দেশের এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের চেয়েও ক্ষুণ্ন অথবা পিছিয়ে আছি- এটা বলে আত্মতৃপ্তি পেতে পারে বিএনপি-জামায়াত।
কিন্তু আমরা আমাদের আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বা সমৃদ্ধির পথে যে কোনো বাধা মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এখানে কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে বা শক্তিশালী করবে যে মানবাধিকার, সেই মানবাধিকার আমরা চাই না।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান রোরি মআংগোভেনের সঙ্গে দেখা করে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। দলটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ এ বৈঠকে অংশ নেন। ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তারা। এ সময় তারা জানান, পৃথিবীর সব দেশে মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা আছে বলে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল আমাদেরকে জানিয়েছে। তারা মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার কথাও বলেছেন।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, আমরা তাদেরকে জানিয়েছি, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ। মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বলেছি, আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে যে রাজনৈতিক শক্তিটি নির্বিচারে হত্যা করেছে, তারা এখনো রাজনীতিতে বলবৎ। এই অপরাজনৈতিক শক্তির যারা সিমপ্যাথাইজার, তারা নানাভাবে দেশে-বিদেশে, সরকারে এবং সরকারের বাইরে অবস্থান করছে। এগুলো ম্যানেজ করেই আমাদের কাজ করতে হয়।
বাংলাদেশে চরমপন্থি, উগ্রবাদী রাজনৈতিক অর্থাৎ উগ্র বাম ও উগ্র ডান শক্তিটা যে আছে, এই শক্তির প্রচেষ্টা হচ্ছে এই প্রগতিশীল সরকার ও তাদের রাজনৈতিক আদর্শের বিরুদ্ধে কাজ করা। সেটি পরিষ্কার করতে পেরেছি। যে রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তারা উধাও হয়ে যায়নি। তারা রাজনীতিতেই আছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাদেরকে প্রতিহত করে আমাদের কাজ করতে হয়।
ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, আমরা বলেছি, তারা যে তথ্য ও গবেষণার ওপর নির্ভর করবে, সেগুলো অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ও স্বাধীন হতে হবে। আমরা ডেভিড বার্গম্যান, অধিকার এবং তাদের সব অংশীজনদের রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছি। আমাদের কথা শুনে তারা কনভিন্সড হয়েছেন এবং গুরুত্বসহকারে সেগুলো দেখবেন বলে জানিয়েছেন। তারা এখন আমাদেরকে কমিটমেন্ট করেছেন যে, ভবিষ্যতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে রিপোর্ট প্রকাশ করবে, তাদের সেসব তথ্য-উপাত্তের নিরপেক্ষতা বা স্বাধীন সোর্স সঠিক কিনা, সেটা গুরুত্বসহকারে দেখবেন।
Posted ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta