যদি বলতে পারেন তাহলে আপনি অবশ্যই অল্প কিছু ভাগ্যবান মানুষের একজন, যে কিনা অনেক রকম দূষণের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। জীবনে আরাম আয়েশ আনতে যেয়ে আর জীবনকে সহজ করে ফেলতে যেয়ে আমরাই আমাদের প্রকৃতিকে দূষিত করে ফেলছি। কোন কিছু তো আর একপাক্ষিক ভাবে চলতে পারে না, প্রকৃতিও তার মত করে শোধ নিয়ে নিচ্ছে। চলুন আজ আমরা দেখি আমাদের ভবিষ্যতে এই দূষণ কি রকম ভয়ানক প্রভাব রাখতে পারে।

পরিবেশ দূষণ আমাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে; Image Source: European Institute for Gender Equality – Europa EU

দূষণ বলতে আসলে কী বোঝায়?

যেকোনো কিছুতে যদি ক্ষতিকর কোন উপাদান মিশে তার স্বাভাবিক ক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, সৌন্দর্য্য, কার্যকারিতা কমে যায় তাকেই দূষণ বলা যেতে পারে। আমরা এখানে পরিবেশের দূষণ নিয়ে আলোচনা করবো তাই পরিবেশ কিভাবে দূষিত হতে পারে সেটাই আমাদের বিবেচ্য। পরিবেশ দূষণ তখনই হতে পারে যখন কোন বাইরের কণা বা ছোট উপাদানের কারণে পানি, মাটি বা বায়ু তার স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।

এই কণা পরিবেশের জন্য বিষাক্ত হতে পারে আর এটা পরিবেশ ও বাস্তু সংস্থানের জন্য খুবই ভয়াবহ, আর সেই সাথে ওই বাস্তুসংস্থানের ভিতরে থাকা প্রাণীদের জন্যও বিপদজনক। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংস্থার সচেতনতা বাড়াতে নানা রকম উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও পরিবেশ দূষণের বর্তমান হার যদি অব্যহত থাকে তাহলে মানবজাতি ও পরিবেশের জন্য তা হবে ভয়াবহ। আর সেই ভয়াবহতা কেমন হতে পারে সেটা নিয়েই এখন আলোচনা করব।

আমরা দূষিত করে ফেলছি পরিবেশকে; Image Source: Steemit

নানা জীব প্রজাতির বিলুপ্তি

নানা ধরণের দূষণের পিছনে প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী লাগামহীন ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। জলাধার ভরাট হচ্ছে। নানা ধরণের বন্য আর জলজ প্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যের অভাব, বাসস্থানের অপ্রতুলতা সহ নানাবিধ কারণে অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির দিকে চলে যাচ্ছে।

“নিউ সায়েন্টিস্ট” এ ২০০৪ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় শুধুমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নানা ধরণের প্রজাপতি ও পোকামাকড় ব্রিটেন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনের অবস্থা এমন জলে পশ্চাৎপদ এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

দূষণের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য প্রজাতি; Image Source: Inquiries Journal

এখন প্রশ্ন হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কিভাবে দূষণের জন্য দায়ী? অধিক জনসংখ্যা মানে অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড, বেশি করে বনভূমি ধ্বংস। গাছপালা কমে যাবার কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কম শোষণ, ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে অধিক কলকারখানা, অধিক ক্ষতিকর গ্যাস আর ধোয়া নির্গমন, ফলে বায়ুদূষণ। এই সব কারখানার বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলে পানি দূষণ ইত্যাদি।

বিভিন্ন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি দশকে প্রায় ১১% করে জলজ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেকোন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানে খাদ্য শৃঙ্খলের কোথাও না কোথাও শূন্যতা তৈরি হওয়া আর এই শূন্যতা শৃঙ্খলের অন্যদের উপরেও প্রভাব ফেলে।

রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে

দূষণের মাত্রা যত বাড়তে থাকে মানুষ তত বেশি বিষাক্ত পরিবেশের মুখোমুখি হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন যে পরিবেশ দূষণের সাথে নানা ধরণের হৃদরোগ ও ক্যান্সারের সরাসরি যোগাযোগ আছে।

বাড়ছে দূষণজনিত রোগবালাই; Image Source: www.envione.com

বায়ুদূষণ শহর অঞ্চলের জন্য খুব প্রাথমিক সমস্যা, বিশেষ করে যারা রাস্তাঘাটের আশেপাশে থাকেন তাদের জন্য। যানবাহন থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া, কয়লা বা ফসিল ফুয়েল পোড়ানোর কারণে নির্গত ধোঁয়া অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। এই ধোয়া ফুসফুস, হৃদপিন্ড এমনকি ত্বকের জন্যও ক্ষতিকর।  আবার দূষিত পানিও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। লিভার, কিডনি আর চামড়ার নানা ধরণের রোগের জন্য দায়ী পানিদূষণ।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

শক্তির জন্য আমরা যে তেল, গ্যাস বা কয়লার মত ফসিল ফুয়েল পোড়াই তাতে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে আয়নার মত কাজ করে। এরা সূর্যরশ্মিকে আটকে রাখে ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। পৃথিবীর রক্ষাকবচ হয়ে থাকা ওজোন স্তর আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাচ্ছে ফলে অল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির মতো আমাদের জন্য ক্ষতিকর রশ্মি বিনা বাধায় সরাসরি পৃথিবীতে প্রবেশ করছে।

গলে যাচ্ছে মেরুর বরফ; Image Source: Foundation for Economic Education

তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে দুই মেরুতে জমে থাকা বিশাল বিশাল বরফখন্ড গলতে শুরু করেছে। ফলে বেড়ে যাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। ডুবে যাবে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল। ভয়ের কথা হলো এই নিচু এলাকার মাঝে আমাদের বাংলাদেশ ও আছে। বাস্তুচ্যুত হবে বিপুল পরিমাণ মানুষ। লোনা পানি ঢুকে নষ্ট করে দেবে মিষ্টি পানির জলাধার সমূহকে। মিষ্টি পানিতে থাকা মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য সেটা হবে প্রাণঘাতী। সুপেয় পানির সংকটে পড়বে কোটি কোটি মানুষ। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের প্রভাব কেবল মানুষ বা একটি প্রজাতির উপরে পড়বেনা। ধ্বংসের প্রান্তে পৌঁছে যাবে আমাদের প্রকৃতি, আর প্রকৃতির যেকোন ক্ষতি হওয়া মানে আমাদেরই ক্ষতি হওয়া। সব থেকে বেদনার কথা হল এই বিপর্যয়ের মূলে আছে মানুষেরই স্বার্থপরতা। প্রকৃতি আর সকল প্রাণিজগতের মাঝে যে সুন্দর বন্ধন আছে সেটা আমরা নিজেরাই অবিমৃষ্যকারীর মতো নষ্ট করে ফেলছি। নিজেদের চাহিদা মেটাতে ভবিষ্যতের কথা একেবারেই ভাবছিনা। যার ফল এখনই ভোগ করছি। যদি এখনও সতর্ক না হই তাহলে তার দায় আমাদেরই চরম মূল্য দিয়ে মেটাতে হবে।