হেলাল উদ্দিন টেকনাফ :: ঘর থেকে ঘুরতে বাহির হয়ে পথ হারিয়ে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন একজন ব্যক্তি।তার নাম মোহাম্মদ মোস্তফা(৪৪)।
সে জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার চরকাউরিয়ার পাখিমারা গ্রামের বাসিন্দা মৃত আবদুল মজিদ মুন্সি ও মোসাম্মৎ মেহম্মার ছেলে।তিনভাই ও চারবোনের মধ্যে সে সবার ছোট ছেলে।
তিনি পেশায় একজন চালক ও গ্যারেজের মালিক ছিলেন।এরমধ্যে একই এলাকার ময়না বেগমকে বিয়ে করে তাদের সংসারে আসে একটি ছেলে সন্তান।যে কিনা ছয়মাসের মধ্যে মারা যায়।এর কয়েক বছর পরে মোস্তফার সংসারে জন্মে একটি মেয়ে সন্তান।মেয়ের জন্মের চার মাসের মধ্যে সে(মোস্তফা)মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।তিন বছর আগে স্বামীকে ছেড়ে স্ত্রী ময়না বেগম অন্যত্রে বিয়ে করেন।বতমানে মোস্তফার সেই মেয়েটি ১৩বছর বয়সী কিশোরী মনিরা বেগম।সে এখন নবম শ্রেণিতে মাদ্রাসায় পড়ছে।
কিশোরী মনিরা বললেন,আমি জন্মের পর বাবার মানসিক রোগী হয়ে পড়ে।এরমধ্যে দুইটি বছর পার করেছি বাবা-মায়ের ছায়া বিহীন।তবে বাবাকে ফেরত পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম।স্বজন হারানোর বেদনা আমার চেয়ে আর কেহ বুঝবে না।কারো জীবনে যেন এধরনের ঘটনা না ঘটে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফ উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা(ইউএনও)মোহাম্মদ কায়সার খসরুর উপস্থিতিতে মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানসিক রোগীদের তহবিল (মারোতের) সদস্যদের উপস্থিতিতে মোস্তফাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।এটি ছিল ৩৫তম মানসিক রোগী হস্তান্তর।এরআগে দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ৩৪জন নারী-পুরুষকে স্বজনদের কাছে তুলে দিয়েছেন এ সংগঠনটি।
এসময় উপস্থিত ছিলেন-উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান তাহেরা আক্তার,সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক সন্তোষ কুমার শীল,টেকনাফ পৌর আওয়ামীলীগ সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী,সাইফুল ইসলাম,মোহাম্মদ ফেরদৌস ইসলাম,মোশাররফ হোসেন,যুগ্নসম্পাদক মোবারক হোসাইন ভুইয়া,সাংগঠনিক সম্পাদক মিরাজ উদ্দিন,পল্লীচিকিৎসক রুপন শর্মাসহ আরও অনেকে।
ওই সংগঠনের সভাপতি আবু সুফিয়ান বললেন,প্রায় দুই বছর আগে ঘর থেকে ঘুরতে বাহির হয়ে আর ঘরে ফিরেনি মোস্তফা।মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসেন টেকনাফে।ঘুরাঘুরি করতেন,তাকে কেহ তেমন চিনতে পারেনি।নিয়মিত মারোতের দেওয়া খাবার নিয়ে খেতেন।কিছুদিন আগে মারোতের সদস্য মোহাম্মদ ফেরদৌস ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সামনে ঘুরাঘুরি অবস্থায় (মোস্তফাকে)দেখতে পান তিনি।এরপর খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করেন এবং নিয়মিত খাবার দেন।
ইতিমধ্যে সে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে তার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে জামালপুরের পাখিমারা বলে জানায় সে।তখন মোস্তফার একটি ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম(ফেসবুকে)পোস্ট করার পাশাপাশি প্রশাসনের সহযোগিতায় বকশীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো আলমগীর কবির আলমাসে সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।তখন তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।এরপর ভিডিও কলের মাধ্যমে তারা মোস্তফাকে শনাক্ত করেন এবং ঘরে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেই চেয়ারম্যান বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করেন।
মারোত সদস্য মোহাম্মদ ফেরদৌস ইসলাম বলেন,প্রায় সময় মোস্তফাকে আমার ব্যবসা প্রতিষ্টানে সামনে রাখার চেষ্টায় ছিলাম।কিভাবে পরিবারের কাছে পাঠানো যায় সেভাবে কাজ শুরু করি।এরমধ্যে মো আলমগীর কবির আলমাস চেয়ারম্যানকে অনেক বিরক্ত করেছি কিন্তু হাল ছাড়িনি।প্রায় প্রতিনিয়ত মোস্তফার পরিবারের একাধিক লোকজনের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায় ছিলাম।
তারই সুত্র ধরে,মোস্তফাকে স্বজনদের কাছে নেওয়ার জন্য জামালপুর থেকে টেকনাফ আসেন তার বড় ভাই মোহাম্মদ আবু বক্কর আকন্দ ও ভাগিনা মোহাম্মদ আবু রায়হান।আজ বৃহস্পতিবার সকালে তারা টেকনাফ পৌঁছান।এরপর বড়ভাই ও ভাগিনার সঙ্গে সাক্ষাত হলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছেন অনেক।
বড় ভাই মোহাম্মদ আবু বক্কর আকন্দ বলেন,করোনাকালিন সময়ে হয় তো বা কোথাও মারা গেছে এরকম ধারণা করেছিলাম।পরিবারের সকলেই ধরে নিয়ে ছিলাম ছোট ভাই মোস্তফা আর বেঁচে নেই।কিন্তু আমাদের ধারণা ভূল প্রমাণ হয়েছে।আজ দুই বছর পরে ভাইকে ফিরে পেয়েছি।আমার পুরো পরিবারটি এ সংগঠনের প্রতি আজীবন চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
মারোত সূত্র জানায়,মানসিক রোগীদের তহবিল(মারোত)এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১৭সালের ১৬জানুয়ারি।উপজেলায় কর্মরত ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি,চিকিৎসক,শিক্ষক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মিলিয়ে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।তখন থেকে ২০জন সদস্যের আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে এসংগঠনটি প্ররিচালিত হয়ে আসছিল।এরপর থেকে সংগঠনের সদস্যরা মানসিক রোগীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করে আসছেন।অসহায় এসব মানুষকে চিকিৎসা সেবা,শীতবস্ত্রের পাশাপাশি সৎকার ও দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অসহায়দের যত্নআত্তি ছাড়াও হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পৌঁছে দেন পরিবারের কাছে।অন্যদিকে,বিশ্বব্যাপী যখন কোভিড-১৯সংক্রমণে একের পর এক রাষ্ট্র যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।ঠিক তখনই টেকনাফে এসব মানসিক রোগীদের কথাবিবেচনা করে(খাবার হোটেল ও দোকানপাট বন্ধ থাকায়)২০২০সালের ২৫মার্চ(লকডাউন শুরুরদিন)থেকে ৬৩৫দিন টানা প্রায় শতাধিক মানসিক রোগীদের দৈনিক এক বেলা করে রান্না করা খাবার বিতরণ করে আসছিল।
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও)মোহাম্মদ কায়সার খসরু বলেন,মানবতা কি ? এ সংগঠনটি শিখিয়ে দিয়েছে।কিছু উদ্যমী লোকজন মিলে মানসিক রোগীদের তহবিল মারোত নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি গঠন করে।প্রতিনিয়ত মানসিক রোগীদের নানা ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা ও খাবার দিয়ে আসছে।
Posted ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta