কক্সবাংলা ডটকম :: তাশদিক হাসান তার বর্তমান আর্থিক চাপের বিষয়ে বলেন, ‘আমি বুঝাতে পারব না কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’ ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত তাশদিক করোনাভাইরাস মহামারি ও বাড়তে থাকা দৈনন্দিন খরচের মধ্যে সমন্বয় করে জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তার মাসিক বেতনের নির্ধারিত ৩৬ হাজার টাকার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই চলে যায় বাড়ি ভাড়া ও পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলের পেছনে। বাকিটা দিয়ে চলে তার ৫ সদস্যের পরিবারের বাকি সব খরচ। তার মধ্যে রয়েছে নবজাতক সন্তানের জন্য খরচ এবং অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচও।
নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই তাশদিকের নাগালের বাইরে ছিল। এর সঙ্গে মহামারির মধ্যে প্রায় সবকিছুর দাম বাড়তে থাকায় তার দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। মহামারিতে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে মাস্ক ও স্যানিটাইজার কেনার বাড়তি খরচও এর সঙ্গে যোগ হয়েছে।
সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং এর প্রভাবে অন্যান্য পণ্যের দামও বৃদ্ধি তার পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। বেড়েছে প্রতিদিনের খরচ, বিপর্যস্ত তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। বাস ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় তাশদিককে প্রতি মাসে অফিসে যাতায়াতের জন্য বাড়তি অন্তত ১ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। এই টাকা দিয়ে তিনি তার সন্তানের ২ সপ্তাহের খাবার কিনতে পারতেন।
তেলের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আয়ের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে করব জানি না।’
আয় একই থাকলেও এক বছর আগের তুলনায় তার শুধু খাবারের খরচই বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
তাশদিকের মত নিম্ন থেকে মধ্য আয়ের মানুষ অর্থনীতির চাকার ধীর গতি ও মূল্যস্ফীতির সমস্যায় জর্জরিত। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে তারা খুবই সমস্যায় পড়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারিতে দেখা গেছে, দেশের ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী মধ্যম আয়ের শ্রেণীভুক্ত এবং তাদের মাসিক আয় ৪০ থেকে ৮০ হাজারের মধ্যে। গত ৮ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে আয় বেড়েছে, কিন্তু সঙ্গে মূল্যস্ফীতির পরিমাণও বেড়েছে তাল মিলিয়ে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষের দিকে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, আর এ বছরের অক্টোবরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে।
মধ্যম আয়ের বেসরকারি চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন আয়ের মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, খাবারের খরচ কমানো, যতটা সম্ভব চিকিৎসা না নেওয়া এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে বিভিন্ন উৎস থেকে ধার নেওয়া।
ব্রডকাস্ট সাংবাদিক অনুপম (ছদ্মনাম) জানেন না সামনে কী করবেন। তিনি যে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করেন, মহামারির সময়ে তাদের আয় কমেছে। ফলে তার বেতনও হয়ে গেছে অনিয়মিত। গত ২ বছর ধরে তিনি কোনো উৎসব ভাতাও পাননি।
তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো ২ মাস পর ১ মাসের বেতন পাই। এই কঠিন সময়ে আপনি যদি ২ মাস পর ১ মাসের বেতন পান, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন জীবন কতটা জটিল হতে পারে।’
তার স্ত্রীও একটি সংবাদপত্রে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত। তিনিও তার পরিবারের খরচ চালানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন।
অনুপম বলেন, ‘গত ২ বছরে আমরা তেমন কোনো টাকা জমাতে পারিনি। আমার বাবা-মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের চিকিৎসার জন্য আমাদের সব জমানো টাকা খরচ হয়ে গেছে।’
দৈনিক রোজগারের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের অবস্থা এতটাই করুণ হয়েছে যে, তাদেরকে খাবারের পরিমাণ কমাতে হয়েছে।
রিকশা চালক রহিম শেখ (৪৫) বলেন, ‘এখন শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাই। কখনো কখনো শুধু চাল-ডালের খিচুড়ি খাই। মাছ বা মাংস কেনার সামর্থ্য আমার নেই।’
রহিম এক সময় গাইবান্ধার একজন অবস্থাপন্ন চাষি ছিলেন। ২০১৭ সালের বন্যায় তার খামার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তিনি ঢাকায় আসেন। এখন তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করেন। এর মধ্য থেকে রিকশার মালিককে ১৫০ টাকা দিতে হয়।
কঠোর পরিশ্রমের কাজ হওয়ায় প্রতিদিন তিনি রিকশা নিয়ে বের হতে পারেন না। যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি বাধ্য হন খাদ্য ও চিকিৎসার পেছনে খরচ কমাতে।
রহিম বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে আমার মতো মানুষকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, ‘তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন ধরণের খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে এবং এই দাম বাড়ানোর বিষয়টি পুরোপুরি ঐচ্ছিক।’
তার মতে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তেলের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয় এরকম খাতের পরিচালকরাও তাদের পণ্য বা সেবার দাম বাড়াবে। যেমন বাড়ি ভাড়া অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা আরও বলেন, ‘মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর ওপর এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব খুবই ভয়াবহ হবে।’
মহামারির কারণে আরও অনেকে তাদের আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। রেস্তোরাঁ কর্মী সুজন মিয়া তাদেরই একজন। তিনি এখনো সাভারের একটি রেস্তোরাঁয় কর্মরত আছেন। কিন্তু তার বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি এবং তার রেস্তোরাঁ মালিক উভয়েই সদস্যার মুখে পড়েছেন।
রেস্তোরাঁয় বেচাকেনা কমে গেলে কীভাবে তার মতো কম বেতনের কর্মীদের জীবন প্রভাবিত হয় সে প্রসঙ্গে সুজন বলে, ‘যে সবজি ১ মাস আগেও ৫০ টাকায় কেনা যেতো, সেগুলোর দাম এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা। তেলের দাম বেড়েছে, আরও বাড়ছে। ১ সিলিন্ডার গ্যাসের দাম প্রায় ১ হাজার ৭০০ টাকা। আমরা কীভাবে বাঁচবো?’
এ ধরনের রেস্তোরাঁর বেশির ভাগ ক্রেতা পরিবহন কর্মীরা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পর রেস্তোরাঁর খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে তাদের অনেকেই এখন আর সেখানে যাচ্ছেন না।
সুজন বলেন, ‘আমাদেরকে এখন বলা হচ্ছে, আমরা ৩ বেলা খাবার পাব এবং রেস্তোরাঁয় রাতে ঘুমাতে পারব। কিন্তু মালিক আমাদের দৈনিক ২০০ টাকা করে বেতন দিত, সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আমার যাওয়ার জায়গাও নেই।’
রেস্তোরাঁর মালিক আবুল হাসেম বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমার দোকানের বেশিরভাগ কমবয়সী কর্মচারীরা গৃহহীন। তাই তারা এখানে খাবার ও আশ্রয় পেয়ে খুশিই হয়েছে।’
Posted ৭:৫৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta