
বিশেষ প্রতিবেদক :: দেশে লবণের মোট চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হয় দেশীয় উৎপাদন থেকে। কক্সবাজার জেলায় প্রতি বছর কয়েক লাখ টন লবণ উৎপাদিত হয়, যা দেশের লবণের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চলতি মাস থেকে কুতুবদিয়ায় মৌসুমের প্রথম লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে প্রতি বছরের মতো এবারো দাম নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন লবণচাষীরা।
গত মৌসুমের চার লাখ টনের বেশি মাঠে মজুদ থাকলেও সরকার নতুন করে দেড় লাখ টন লবণ আমদানির পরিকল্পনা করছে।
এতে উৎপাদন মৌসুম শুরু হলেও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার শঙ্কায় অনেক চাষী এখনো মাঠে ফেরার ব্যাপারে দ্বিধায় আছেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে ২৬ লাখ ১০ হাজার টনের চাহিদার বিপরীতে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৫১ হাজার ৬৫১ টন।
এর আগের মৌসুমে উৎপাদন ছিল ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯০ টন।
চাহিদা পূরণে ঘাটতি থাকলেও মৌসুম শেষ হওয়ার ছয় মাস পর পর্যন্ত ৪ লাখ ২০৩ টন লবণ বিক্রি হয়নি—এখনো মাঠেই পড়ে রয়েছে এসব লবণ।
বর্তমানে মণপ্রতি লবণের দাম ২৪০ টাকা।
কক্সবাজারের সাত উপজেলা মিলিয়ে ৫৯ হাজার ৯৯৯ একর এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও পটিয়ায় ১০ হাজার ৮৯ একর জমিতে লবণ চাষ হয়ে থাকে।
এ চাষাবাদে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ৪১ হাজার ৩৫৫ জন চাষী।
দেশে উৎপাদিত মোট লবণের ৮৭ শতাংশই আসে কক্সবাজারের সাতটি উপজেলা থেকে। বাকি অংশ উৎপাদিত হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও পটিয়ার উপকূলে।
প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদন মৌসুম চলে। এবারো নভেম্বর থেকেই উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে কুতুবদিয়ার চাষীরা উৎপাদনে নেমে দাম নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
প্রায় এক যুগ ধরে লবণ উৎপাদন করছেন উপজেলার লেমশীখালীর লবণচাষী মোহাম্মদ কাশেম। নিজস্ব ও বর্গা নেয়া জমি মিলিয়ে প্রায় ২ দশমিক ৪৪ বিঘায় লবণ চাষ করেন তিনি।
এবারো একই পরিমাণ জমিতে উৎপাদন শুরু করেছেন কাশেম। কিন্তু বিঘাপ্রতি জমি ভাড়া বেড়েছে, পাশাপাশি প্রতিজন শ্রমিকের জন্য দৈনিক খরচ এখন ১ হাজার টাকারও বেশি।
তিনি বলেন, ‘এক যুগের বেশি সময় ধরে লবণ চাষ করছি। প্রতি বছর গড়ে মণপ্রতি দাম ১৮০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে থাকে।
মূল মৌসুমে দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা উঠলেও উৎপাদন বেশি হলে সবাই সেই দাম পায় না। এবারো কাজ শুরু করেছি, কিন্তু দাম ওঠা নিয়ে শঙ্কায় আছি।
শুনছি চার লাখ টনের বেশি লবণ এখনো মাঠে পড়ে আছে। আগে সেগুলো বিক্রি হবে, তারপর ব্যবসায়ীরা নতুন লবণ ধরবে।
জমি আর শ্রমিকের খরচ যেভাবে বাড়ছে, এবারো যদি লোকসান হয়, তাহলে এ চাষ ছেড়ে দিতে হবে।’
কুতুবদিয়ায় উৎপাদন শুরু হলেও পার্শ্ববর্তী মহেশখালী উপজেলায় কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। মহেশখালীর লবণচাষী নুরুল ইসলাম এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না উৎপাদন শুরু করবেন কিনা।
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই লোকসান দিয়ে লবণ উৎপাদন করতে হয়। দেশে সবার লবণ লাগে, দোকানে দাম বেশি হলেও কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না। মৌসুম শুরু হলেও মাঝপথে এসে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেয়।
মাঠে লবণ পড়ে থাকে, আর সরকার শিল্পের নামে সোডিয়াম সালফেট কেনে। অথচ দেশের লবণ প্রক্রিয়াজাত করলে শিল্প লবণ উৎপাদন সম্ভব। তারপরও কৃষকের কথা না ভেবে শিল্প মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সুবিধা দিতেই আমদানি করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমদানির সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে স্থানীয় লবণের দাম অনেক কমে গেছে। এখন এক মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়, যেখানে উৎপাদন খরচই প্রায় ৩০০ টাকা। এতে হাজারো চাষী ক্ষতির মুখে পড়ছেন।’
এদিকে সরকার জানিয়েছে, আগামী দুই মাস মাঠে মজুদ থাকা লবণই ব্যবহার করা হবে। তবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ঠেকাতে দেড় লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (লবণ সেল প্রধান) সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের বর্তমানে যে মজুদ রয়েছে, তা ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
এরপর কোনো সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য দেড় লাখ টন লবণ আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
অনুমোদন মিললে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান থেকে অপরিশোধিত লবণ কেনা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমদানীকৃত লবণ সাধারণত বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে কেনা হয়, কারণ ডাই সোডিয়াম সালফেট শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হয়। যদি কোনো কারণে উৎপাদন দেরি হয়, তাহলে কৃত্রিম সংকট তৈরি হতে পারে।
সেটি ঠেকানোর জন্যই আমদানির পরিকল্পনা করেছি। উৎপাদন ভালো হলে বিদেশ থেকে কেনার প্রয়োজন পড়ে না। দেশে কেজি ৫ টাকায় পাওয়া গেলেও বিদেশ থেকে আনতে হয় ১৩ টাকায়। তবে সংকট দেখা দিলে শিল্পের চাহিদা দেখে কেনা হবে।’
তবে লবণচাষী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্প-কারখানা ও কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিতে সরকার প্রতি বছর আমদানির পথ বেছে নেয়, ফলে স্থানীয় চাষীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও অযৌক্তিকভাবে আমদানির অনুমতি দিলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ধরে রাখতে হলে সরকারকে চাষীদের জন্য কার্যকর প্রণোদনা দিতে হবে। প্রতি বছর কিছু চাষী ১ লাখ টাকা করে প্রণোদনা পেলেও সেই সংখ্যা খুবই সীমিত। ফ
লে অধিকাংশ চাষীকেই ব্যক্তিগত অর্থে উৎপাদনে নামতে হয়।
জমির ভাড়া, সেচ ব্যবস্থা ও শ্রমিকের পেছনে বড় অংকের টাকা ব্যয় হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। তাই আমদানির পরিকল্পনা বাতিল করে স্থানীয় লবণ সংগ্রহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, ‘বাজারে লবণের দাম কম থাকায় অনেকে অনেক চাষী এখনো মাঠে নামছেন না।
তবে দাম স্থিতিশীল রাখতে আমরা সরকারিভাবে এবার লবণ কেনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তার জন্য গোডাউন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকারিভাবে কৃষকদের কাছ থেকে লবণ কিনে সেটি গোডাউনে মজুদ করা হবে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাম বেশি ছিল। নতুন মৌসুমে দাম কমবে বলে আমরা আশাবাদী।’

Posted ৩:২৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta