কক্সবাংলা ডটকম(৫ আগস্ট ) :: করোনাকালে হঠাৎ একের পর এক মডেলকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভুয়া পরিচয়ে প্রভাব খাটানো ব্যক্তিও ধরা পড়েছেন। যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তাদের অধিকাংশের বাস রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত গুলশান-বনানী ও বারিধারায়। তাদের সখ্য যাদের সঙ্গে, তারাও সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।
হেলেনা জাহাঙ্গীর, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ গ্রেপ্তারের ধারাবাহিকতায় বুধবার গ্রেপ্তার হলেন অভিনেত্রী পরীমণি ও কথিত প্রযোজক রাজ। এ ছাড়া বিতর্কিত মডেলদের সহযোগী হিসেবে শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান ও মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কেন আকস্মিকভাবে এসব গ্রেপ্তার- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল নেপথ্য কাহিনি। মডেলদের কেউ কেউ পার্টির আড়ালে গোপন ক্যামেরায় সমাজের বিত্তশালীদের অসতর্ক মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিও তুলে রাখতেন। এর পরই এই ছবি তাদের পরিবারের স্বজন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে বিত্তশালীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করতেন।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ চক্রের সদস্যদের এজেন্ট রয়েছে। তারা সেখান থেকে সুন্দরী মেয়েদের নানা প্রলোভন দিয়ে ঢাকায় আনতেন। এরপর তাদের মাধ্যমে অভিজাত এলাকার পার্টি গার্ল হিসেবে ব্যবহার করতেন। অনেককে মডেল বানানো, নাটক-সিনেমায় কাজ করার টোপ দেওয়া হতো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি সম্প্রতি মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের চক্করে পড়েন। তার অসতর্ক অবস্থার ছবিকে পুঁজি করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এদের চক্কর থেকে বের হতে ওই ব্যাংকের এমডি বিষয়টি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জানিয়ে আইনি প্রতিকার চান। এরপর বেরিয়ে আসে; শুধু ওই ব্যাংকের এমডি নন, এখন পর্যন্ত পিয়াসা ও মৌয়ের মোবাইল ফোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৭টি ভিডিও পাওয়া গেছে।
এসব ভিডিওতে কয়েকজন শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর বখে যাওয়া সন্তানদের অসতর্ক মুহূর্তের ছবি রয়েছে। তাই এসব গোপন ভিডিও অন্যদের হাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। চক্রটির প্রতারণা থেকে ফেঁসে যাওয়া ব্যক্তিদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য এ অভিযান।
ব্যাংকের এমডির সূত্র ধরে বিত্তশালীদের ফাঁসানোর বিষয় জানার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গভীরভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এসব অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে সবুজ সংকেত মেলার পর গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার তালিকায় আরও ৩৫ থেকে ৪০ জন রয়েছেন। মূলত অসতর্ক মুহূর্তের ছবি ব্যবহার করে ফাঁসানোর এ চক্রটিকে একটি বার্তা দিতে চান সংশ্নিষ্টরা।
উঠতি মডেলদের যারা ব্যবহার করতেন, পার্টি আয়োজনের জন্য তাদের বিভিন্ন ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতি রাতে সেখানে পার্টির আয়োজন করা হয়। সেখানে চড়া দামে বিত্তশালীদের কাছে বিদেশি মদও বিক্রি করে আয় করা হয় লাখ লাখ টাকা। আবার সরকারি-বেসরকারি কাজ বাগিয়ে নিতে কেউ কেউ উঠতি মডেল ও নায়িকাদের ব্যবহার করেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, অসতর্ক অবস্থায় তোলা ছবি ও ভিডিও পুঁজি করে অনেক বিতর্কিত মডেল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে মাসোহারা নিতেন। কেউ কেউ দামি গাড়ি নিয়েছেন। অনেককে বিদেশ ভ্রমণের পুরো খরচও দেওয়া হয়। মূলত বিতর্কিত মডেলদের মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে যাদের অসতর্ক মুহূর্তের ভিডিও রয়েছে, তা জব্দ করা হবে। আরও কয়েকজন মডেল গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছেন।
সূত্রের দাবি, গতকাল র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার মিশু ঢাকার উঠতি মডেল ও নায়িকাদের নিয়ে দেশ-বিদেশে ‘বিশেষ পার্টির’ আয়োজক। তার বিলাসবহুল গাড়ির শোরুম আছে। মোহাম্মদপুরের সাবেক কাউন্সিলর রাজীবের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। মিশুর মাধ্যমে রাজীব বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রটি আরও দাবি করে, গুলশান কেন্দ্রিক এ চক্রের আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম রাজ। প্রযোজক হিসেবে তার কিছুটা পরিচিতি রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে তার পেশা করপোরেট কোম্পানির বড় কর্তাদের সঙ্গে ভিন্ন উদ্দেশ্যে উদীয়মান মডেলদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বিনিময়ে কমিশন পান তিনি। এ জগতের আরও দু’জন- নাজিম সরকার ও তুহিন কাজী। তাদের ব্যাপারেও গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে। ঢাকা ছাড়াও গাজীপুরকেন্দ্রিক তাদের চক্র সক্রিয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানে শোবিজ জগতের তারকা মডেল, নায়িকা, ভুঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীসহ কথিত সেলিব্রেটিদের মধ্যে চরম আতঙ্ক শুরু হয়েছে। যারা নিজ পেশা ও খ্যাতির আড়ালে নানা অপকর্মের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে বিত্ত-বৈভব গড়েছেন। নিজেদের পরিচিত মুখটা ব্যবহার করে জড়িয়েছেন অবৈধ মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।
তাদের ধরতে শুরু হয়েছে র্যাব-পুলিশের অভিযান। এ অভিযানে সর্বশেষ গ্রেপ্তার হন ঢালিউডের আলোচিত নায়িকা পরীমনি। এ তালিকায় আরও রয়েছেন সিনেমা পরিচালক, নায়িকা, মডেল, তারকাসহ সমাজের বিভিন্ন জগতের পরিচিত মুখ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, গ্রেপ্তারের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। এ তালিকায় শতাধিক নাম রয়েছে বলে সূত্র জানায়। ওই তালিকায় সেলিব্রেটিদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের সদস্যও রয়েছেন। এ তালিকায় এখন পর্যন্ত ২৫ জনের নাম এসেছে। যাদের ব্যবহার করে মাদক ও ব্ল্যাকমেইলসহ মিনি অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তারা। একজনকে গ্রেপ্তারের পর তার জবানবন্দি সূত্র ধরে নাম বেরিয়ে আসছে আরেকজনের।
এ ছাড়া তাদের সেলফোনের কললিস্ট যাচাই করে আরও পরিচিত মুখ ও তথাকথিত সেলিব্রেটিদের নাম জানতে পারছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া সামনে চলে আসছে তাদের পরিচিত মুখের অন্তরালে নানা অপকর্মের অজানা তথ্য। গত ২৯ জুলাই রাতে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর।
কথিত ‘চাকরিজীবী লীগ’ গঠনে সম্পৃক্ততার খবরে তোলপাড়ের পরই আটক হন তিনি? আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদও হারান হেলেনা জাহাঙ্গীর? চাকরিজীবী লীগ নিয়ে বিতর্ক শুরুর পরই তাকে সেই দায়িত্ব থেকে সরানো হয়। আর হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে র্যাব হরিণের চামড়া, বিদেশি মদ, ক্যাসিনোসামগ্রী, বিদেশি মুদ্রা এবং বেশ কিছু ছুরি ও চাকু উদ্ধার করে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে র্যাব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, মাদক, অর্থপাচার আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। গত সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় হেলেনা জাহাঙ্গীরের দুই সহযোগী হাজেরা খাতুন ও সানাউল্লাহ নুরীকে।
গত রবিবার রাতে গুলশান থানার বারিধারা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। তার বাসায় অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা জব্দ করে। পরে তাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে মডেল মৌয়ের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকেও এসব মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। পরে মৌকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়। তাদের জবানবন্দির সূত্র ধরেই র্যাব ৩ আগস্ট রাতে গ্রেপ্তার করে পিয়াসার সহযোগী মিশু হাসানসহ দুই জনকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন-অর-রশীদ বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া মডেল পিয়াসা ও মৌ রাতে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতেন। এমনকি ভিডিও করে রাখতেন। পরে সেসব ভিডিও ও ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠানোর হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন। তিনি সংখ্যা উল্লেখ না করে জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেক পরিচিত মুখের নাম বেরিয়ে আসছে বলে জানান। যারা পিয়াসাচক্রের সদস্য।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, পিয়াসা ও মৌ চক্রের হাতে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। আবার সমাজের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে তাদের সখ্যতা ছিল। এ দুই মডেল শুধু অসামাজিক ব্যবসা নয়, জড়িত ছিলেন মাদক ব্যবসার সঙ্গেও। তাদের সেলফোনের গত এক মাসের কল ডিটেইল রেকর্ড (কললিস্ট) ঘেঁটে অনেক পিলে চমকানো তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
তাদের প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলচক্রে আরও যেসব নারী, গ্ল্যামার জগতের তারকা যুক্ত ছিলেন তাদের নামধাম জানতে পেরেছে। এ তালিকায় শতাধিক নারী, পুরুষ, তারকা ও মডেল রয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র আরও বলেছে, পিয়াসা ও মৌ চক্রের টার্গেটই থাকে সমাজের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ বিত্তবান ও তাদের সন্তান। নানা প্রলোভনে তাদের বাসায় ডেকে মদ ও ইয়াবার জালে ফেলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই মূল লক্ষ্য। একদিকে চলত ডিজে পার্টি আরেকদিকে ব্ল্যাকমেইল। বছরের পর বছর ধরে তারা এ কাজ করে আসছিলেন।
পুলিশ বলছে মডেল পিয়াসা ও মৌ একের পর এক বিয়ে করেও হাতিয়ে নিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মডেল মৌয়ের ১১টি বিয়ের খবর ইতোমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মডেল পিয়াসাও একাধিক বিয়ে করেছেন। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর ছেলেকেও ব্ল্যাকমেইলের জালে ফেলে কয়েক বছর আগে বিয়ে করেন। এর পর তার কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা বাগিয়ে নেন। এ ছাড়া বেনামে ফ্ল্যাটেরও মালিক হয়েছেন পিয়াসা।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকার গ্লামার জগতের উঠতি মডেল, অভিনেত্রী ও নায়িকা শোবিজে পা দিয়ে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। তাদের এ অবৈধ সম্পদের পেছনে রয়েছে মাদক ও অনৈতিক উপায়। শোবিজ জগতের অনেকেই মাদক সেবন ও ব্যবসার পাশাপাশি নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত। তারা টাকার জন্য অনেক বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের বিপথগামী করেছেন। গুলশান, বনানী, বারিধারার অনেক পরিবারই এখন তাদের কারণে ভুক্তভোগী।
গৃহকর্মীকে মারধরের ঘটনায় গত ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এককালের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা একা। এর পর বেরিয়ে আসে, এ নায়িকার জীবনের আরেক গল্প। নিয়মিত মাদক সেবন করায় তার স্বাভাবিক জীবন প্রায় তছনছ হওয়ার পথে। এ নায়িকার বাসা থেকেও ইয়াবা, গাঁজা এবং মদ পাওয়া যায়। পুলিশের কাছে তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবনের কথা স্বীকারও করেন। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই তার চেহারার হাল দেখে অনেকেই বলেন, তার চেহারার যে হাল হয়েছে তা দেখে বলার উপায় নেই তিনি এক সময় জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন।
চিত্রনায়িকা পরীমনির বিরুদ্ধেও নানা অনৈতিক কাজের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। বোটক্ল্যাবের ঘটনায় বেরিয়ে আসে চিত্রনায়িকা পরীমনির অনেক অজানা গল্প। তার বিরুদ্ধেও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
Posted ৪:০৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ আগস্ট ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta