কক্সবাংলা ডটকম :: নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকেই নিয়মিত রক্তপাত ঘটছে মিয়ানমারে। প্রতিদিনই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বিক্ষোভকারী।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে দেশটিতে অন্তত ১২ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা। জাতিসংঘ বলছে, রক্তক্ষয়ী উপায়ে বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে মানবাধিকারবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে দেশটির সামরিক জান্তা।
এ কারণে নেপিদো আইনিভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে বলে মনে করছে বৈশ্বিক রাষ্ট্রজোটটি।
খবর রয়টার্স।
অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) নামে একটি আইনি সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান জানায়, গতকাল দেশটির ছোট শহর মায়াংয়ে সাধারণ লোকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত আটজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে প্রকাশিত কয়েকটি আলোকচিত্রে দেখা যায়, রক্তে পিচ্ছিল সড়কটিতে ক্ষতবিক্ষত নিথর কিছু দেহ পড়ে আছে। এছাড়াও অসমর্থিত আরো কিছু ছবিতেও বর্মি নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র উঠে এসেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মায়াংয়ের মতো ছোট শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতার এ ঘটনা প্রমাণ করে, সামরিক জান্তা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর জোরপূর্বক তাদের শাসন চাপিয়ে দিতে চাইছে। শুধু বড় শহর বা নগর নয়, দেশটির প্রত্যেক অঞ্চলেই তারা স্বৈরাচারী আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস জেনেভায় এক বিবৃতিতে বলেন, পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। সাধারণ জনগণের প্রতি জান্তা সরকারের খুন, গ্রেফতার, উদ্দেশ্যমূলক বিচার ও অন্যান্য অপরাধ একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে এবং তা ক্রমেই বেড়ে চলছে। আর এসব অপরাধের সবটুকুই হচ্ছে ঊর্ধ্বতন জান্তা নেতৃত্বের সম্মতিতে।
তিনি আরো বলেন, জান্তা সরকারের এমন পাশবিক প্রতিক্রিয়া দেশটিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আইনি প্রশ্নের মুখে ফেলবে।
এসবের প্রতিকারে জাতিসংঘের অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি মিয়ানমারে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে আহ্বান জানান টম অ্যান্ড্রুস। তিনি বলেন, দেশটির ওপর বহুজাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সামরিক মালিকানাধীন ও সেনা নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দেশটির বিদ্যুৎ সংস্থা এবং মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজের ওপর অচিরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বলছে, মিয়ানমারে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখল করার পর এখন পর্যন্ত অন্তত ৮০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। এছাড়া সম্প্রতি জান্তা সরকারের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে নিহত হয়েছেন অন্তত চারজন। তাদের মধ্যে দুজন অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সদস্য।
সম্প্রতি দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের উত্তর ডাগন অঞ্চলে নিহত বিক্ষোভকারী চিট মিন তু-এর স্ত্রী আয়ে মিয়াত তু বিদেশী এক সংবাদ সংস্থাকে জানান, সন্তানের দোহাই দিয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও তার স্বামী বিক্ষোভে অংশ নেন। এ বিষয়ে তার স্বামীর বক্তব্য ছিল, ‘এখন মৃত্যুবরণ করা অনেক মূল্যবান। লোকজন যদি বিক্ষোভে অংশ না নেয়, তবে দেশে কখনো গণতন্ত্র ফিরে আসবে না।’
এএপিপির মতে, দুই হাজারের বেশি লোককে নির্বিচারে গ্রেফতার করেছে জান্তা সরকার। তাদের অধিকাংশেরই পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি। তাদের শারীরিক অবস্থা ও তাদের কোথায় রাখা হয়েছে, তা নিয়েও অন্ধকারে আছেন তাদের স্বজনরা।
তবে সিএনএন কর্তৃপক্ষ এএপিপির দাবি করা গ্রেফতার ও নিহতের সংখ্যার সত্যতা যাচাই করতে সক্ষম হয়নি।
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। বিজ্ঞপ্তিতে সামরিক সরকারের মুখপাত্র দাবি করেন, বিক্ষোভকারীদের দমনে সর্বনিম্ন ক্ষমতা ও শক্তির প্রয়োগ করছে সামরিক কর্তৃপক্ষ।
তাতমাদো (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) ক্ষমতা দখলের পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী প্রথম মান্দালয় শহরে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। তারপর থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন শহরে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ ও জান্তাবিরোধী স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয় নিরাপত্তা বাহিনী। এদিন বিক্ষোভকারীদের ওপর ফাঁকা গুলি চালানোর পাশাপাশি রাবার বুলেট ও জলকামান প্রয়োগ করা হয়। এ সময় বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি আহত সে নারী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন শহরে পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ করায় বরখাস্ত হন দেশটির বিশেষ দূত কিয়াও মোয়ে তুন। ২৭ ফেব্রুয়ারি একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন অন্তত ১৮ বিক্ষোভকারী। এরপর থেকেই দেশটি কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য পর্যবেক্ষকদের।
বর্মি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিক্ষোভকারীদের একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ৩ মার্চ। ওইদিন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অন্তত ৩৮ জন নিহত হয় বলে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সামরিক কর্তৃপক্ষ উন্মাদ হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার্য মারাত্মক ধরনের অস্ত্র নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের গুলি ও হত্যা করছে।
বর্মি গণমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের এক সাংবাদিক জানান, জান্তা সরকারের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই দেশটি দিনের বেলায় যুদ্ধক্ষেত্র ও রাতের বেলা কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া তরুণ আন্দোলনকর্মী থিনজার সুনলেই বলেন, এটা ভয়াবহ গণহত্যা, এ অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য কোনো ভাষা নেই।
Posted ৩:২৩ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৩ মার্চ ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta