কক্সবাংলা ডটকম(১৮ জানুয়ারী) :: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজীবন ক্ষমতায় থাকতে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদের সরকার বাদ দিয়ে নতুন সরকার গঠন করেছেন। খুব পরিচিত মুখ নন মিখাইল ভি মিশুস্তিনকে তিনি প্রধানমন্ত্রী করেছেন। নতুন সরকার গঠন ও সংবিধান সংশোধনে পুতিনের ঘোষণার পর প্রশ্ন ওঠেছে তিনি কি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন! তিনি যে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুতিনের এ পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাজ্যের জাতীয় দৈনিক গার্ডিয়ান শুক্রবার একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। সম্পাদকীয়টি এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল-
প্রায় বছর খানেক আগে এক সাক্ষাৎকারে পুতিনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ‘২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হলে রাশিয়ার অবস্থা কী হবে?’ ক্ষুদে প্রশ্নকারীর দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে পুতিন বলেছিলেন, ‘তোমার এত তাড়া কিসের? আমি কোথাও যাচ্ছি না।’
স্ট্যালিনের পর রাশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসক পুতিন। প্রায় ২০ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা পুতিন কখনও প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কখনও বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরমধ্য দিয়ে তিনি দেশটিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ইচ্ছা নিয়ে বহু আগ থেকে বিশ্লেষকরা সতর্কতা করে আসছেন। তারা বলছেন, সংবিধান অনুসারে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পুতিনের নেই। তবে এটা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তিনি আবার কোন পদে ফিরবেন। কেউ কেউ বলছেন আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন পুতিন। পার্লামেন্টের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে মূলত এ জন্যই।
তবে অনেক বিশ্লেষক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা বলছেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক দেশ কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েভের পথে হাঁটছেন পুতিন। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কাজাখস্তানে ক্ষমতায় ছিলেন নজরবায়েভ। ২০১৮ সালে তিনি দেশটির সিকিউরিটি কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন এবং আজীবনের জন্য এ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হন।
বুধবার পুতিনের ভাষণে সংবিধান সংশোধনের যেসব ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে, পুতিনও সেই পথে হাঁটছেন।
রাশিয়ার পুরো একটি প্রজন্ম পুতিনকে ছাড়া অন্য কোনো শাসক দেখেনি। অদূর ভবিষ্যতে দেখার সম্ভাবনাও কম। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে দিমিত্রি মেদভেদ ও তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ সে ধারণাকে আরও জোরদার করেছে। মেদভেদের এমন পদক্ষেপে অনেকে অবাক হয়েছেন। আরও অবাক হয়েছেন পুতিনের সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে। তবে সবচেয়ে বড় হতবাক করা বিষয় হল- এ পদক্ষেপের সময় ও ধরন। এতে বেশ স্পষ্টতই বোঝা যায়, পুতিন ২০২৪ সালের পরও ক্ষমতায় থাকতে চান। আর নিজের এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত তিনি। কারণ তিনি ফর্মে আছেন।
রাশিয়ার সংবিধান অনুসারে এক ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বোচ্চ টানা দু’বার ক্ষমতায় থাকতে পারেন। এটা হিসাব করে পুতিন ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট মেয়াদ শেষ করে ৪ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তখনও আড়াল থেকে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে তিনিই ছিলেন। এরপর ২০১২ সালে তিনি ফের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বৈরাচারী শাসকরা আদতে অবসর পছন্দ করেন না। বিশেষ করে ২ দশক ক্ষমতার শীর্ষে থাকার পর তারা আরও কঠিন হয়ে পড়েন। ৬৭ বছর বয়সী পুতিন নিজেকে ও নিজের ‘লিগ্যাসি’ রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান যেটি তাকে ছাড়া পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতার টানাটানি দেখার পর এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। পুতিনের ক্ষেত্রে ঝুঁকির সংখ্যা একাধিক।
তার মিত্ররা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন তো বটেই, একইসঙ্গে তার পুরো শাসন ব্যবস্থা ধসে পড়তে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে সমালোচনা সৃষ্টি না করেও ক্ষমতার শীর্ষে থাকা যায়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার প্রেসিডেন্সিয়াল মেয়াদের ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। পুতিনকে তার পথ অনুসরণ করতে হলে আগে সাংবিধানিক সংশোধনের আয়োজন করতে হবে।
২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষে পুতিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফেরার ঘোষণা ও নির্বাচনের পর রাশিয়ার রাস্তায় নেমে এসেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। নিশ্চিতভাবেই পুতিন ফের একই কৌশলের আশ্রয় নেয়ার মতো বোকা নন। ‘স্টেট অব দ্য ন্যাশন’ ভাষণে পুতিন গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানে বড় ধরনের সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টের অনেক ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের নিয়ম সংশোধন করা, বিদেশি নাগরিকত্ব কিংবা বিদেশে বসবাসের অনুমতি থাকা ব্যক্তিদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে নিষিদ্ধের আইন সুসংহত করা কথাও বলেছেন পুতিন।
এতদিন ধরে যে ‘প্রেসিডেন্সিকে’ তিনি জোরদার করেছেন প্রস্তাবিত পদক্ষেপ সেসব কিছুকে দুর্বল করে দেবে। অপরদিকে, এসব সংশোধনীতে বাড়বে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের ক্ষমতা। দেশের শীর্ষ ক্ষমতার পদ থেকে সরে আসা পুতিনের জন্য একদিক দিয়ে বেশ ভালো হতে পারে। তিনি দেশীয় রাজনীতির চেয়ে সামরিক ও বৈশ্বিক বিষয় পছন্দ করেন। তার শাসনামলের প্রথম দশকে রাশিয়া তেল খাতে উন্নতি দেখেছে। একইসঙ্গে বেড়েছে অর্থনীতিও। কিন্তু বর্তমানে দেশজুড়ে বেকারত্ব ও আয়ের হার হ্রাস পাওয়া নিয়ে সমালোচিত তার সরকার। তা সত্ত্বেও ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ তাকেই পছন্দ করেন।
পুতিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী হবে তা ঘিরে অস্পষ্টতা বিরাজ করছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো। তার হাতে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া দমিয়ে রাখার বহু অপশন খোলা থাকবে। আগেভাগে কাজ শুরু করায় প্রস্তুতি নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবেন তিনি। নিজের উত্তরসূরি বাছাই, গণভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংশোধন, আগামী বছরের স্থানীয় নির্বাচনে আশানুরূপ ফলাফল অর্জনসহ বহু কাজ বাকি রয়েছে। তবে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট ও অভিজাতদের জন্য নতুনভাবে ব্যবস্থা গড়ে তোলা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। পুতিনের বিরুদ্ধে যাওয়া অবশ্যই বোকামি। কিন্তু এমনটা ভাবাও ঠিক হবে না, তিনি আজীবন প্রশ্নাতীত থাকবেন।
Posted ২:০০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta