মঙ্গলবার ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

মঙ্গলবার ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

রুয়ান্ডায় ৮ লক্ষ গণহত্যা ও ঔপনিবেশিক ফ্রাঙ্কোফোন-অ্যাংলোফোন স্বার্থ

সোমবার, ২৬ জুলাই ২০২১
541 ভিউ
রুয়ান্ডায় ৮ লক্ষ গণহত্যা ও ঔপনিবেশিক ফ্রাঙ্কোফোন-অ্যাংলোফোন স্বার্থ

কক্সবাংলা ডটকম(২৬ জুলাই) :: ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১০০ দিনের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিল রুয়ান্ডার প্রায় আট লাখ নাগরিক। ২৫ বছর আগে শুরু গণহত্যার শিকার অধিকাংশই সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। গণহত্যা পরিচালনাকারীরা ছিল হুতু সম্প্রদায়ের। যদিও রুয়ান্ডাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, কিন্তু তারপরও এত অল্প সময়ে বিশালসংখ্যক মানুষকে হত্যা করার কথা চিন্তা করাও ছিল কল্পনাতীত। দীর্ঘদিন শাসনক্ষমতায় থাকা তুতসিরা হুতুদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ছিল। দেশটির মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশ হুতু।

১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল রাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন নটারিয়ামনাকে—যাঁদের দুজনেই হুতু সম্প্রদায়ের—বহনকারী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। ওই বিমানে থাকা সব যাত্রী নিহত হন। এই ঘটনার জন্য আরপিএফকে দায়ী করে হুতু চরমপন্থীরা এবং গণহত্যার সুপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড শুরু করে। আরপিএফের দাবি, ওই বিমানকে গুলি করেছে হুতুরাই, যাতে তারা গণহত্যার একটি প্লট তৈরি করতে পারে। অতি সতর্কতার সঙ্গে বিরোধী পক্ষের সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকা হুতুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তালিকা ধরে ধরে তাদের পরিবারের সদস্যসহ হত্যা করা হয়। ওই সময় প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীদের হত্যা করে। এমনকি অনেক হুতু স্বামী তাদের তুতসি স্ত্রীদের হত্যা করেছে। এর কারণ হিসেবে হুতুরা দাবি করে, এ হত্যা না করলে তাদের (হুতু) হত্যা করা হতো। সেই সময় প্রত্যেকের পরিচয়পত্রে গোত্রের নাম উল্লেখ থাকত। এ কারণে চরমপন্থীরা রোড ব্লক বসিয়ে পরিচয়পত্র যাচাই করত এবং তুতসিদের হত্যা করত। বেশির ভাগ সময় এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে ধারালো ছুরি। হাজারো তুতসি নারীকে আটক করে যৌনদাসী করা হয়।

রুয়ান্ডার তখনকার সরকারি দল এমআরএনডির একটি যুব শাখা ছিল ইন্টেরা হামায়ি। এই যুব শাখার সদস্যরাই পরে চরমপন্থী মিলিশিয়ায় রূপ নেন। তাঁরাই বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছেন। স্থানীয় গ্রুপগুলোর হাতে অস্ত্র এবং হিটলিস্ট তুলে দেওয়া হয়, যারা ভালোভাবে জানত যে এসব মানুষকে কোথায় পাওয়া যাবে।

হুতু চরমপন্থীরা একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিল, যার নাম ছিল আরটিএলএম। ওই বেতার কেন্দ্র এবং পত্রিকার মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হতো, লোকজনকে হত্যা করার জন্য বলা হতো। যে নামীদামি ব্যক্তিদের হত্যা করা হতো, তাঁদের নাম ওই রেডিওতে পড়ে শোনানো হতো। এই সময় ১০০ দিনের হত্যাযজ্ঞে আট লাখ তুতসি আর প্রগতিশীল হুতুকে হত্যা করা হয়।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ১৯৫৯ সালে তুতসি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে হুতুরা। তখন হাজারো তুতসি প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে পালিয়ে যায়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত চলা গণহত্যায় প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০০২ সালে। এর অনেক আগে রুয়ান্ডার গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ফলে, এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করতে পারবেন না এই আদালত। তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ওই হত্যাযজ্ঞের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিচারের জন্য তানজানিয়ার আরশা শহরে একটি আদালত স্থাপন করেছে। এ আদালতের নাম ‘রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত’। দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল বিচারের পর গণহত্যার জন্য এখন পর্যন্ত ৯৩ জনের বিচার হয়েছে। এঁদের অনেকেই হুতু সরকারের আমলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। সবাই হুতু সম্প্রদায়ের।

গণহত্যায় অভিযুক্ত লাখো মানুষের বিচার দ্রুত করার জন্য রুয়ান্ডা সামাজিক আদালত তৈরি করেছে। এর নাম গাসাসা। বিচার শুরু হওয়ার আগেই অন্তত ১০ হাজার অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগারে মারা গেছেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত ১২ হাজার গাসাসা আদালত বসেছেন। প্রায় ১২ লাখ মামলার বিচার করার চেষ্টা করছেন গাসাসা। সাধারণত, বাজার বা কোনো গাছের নিচে এসব আদালত বসেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্য বের করা, বিচার এবং পুনর্মিলন ঘটানো। রুয়ান্ডার ভাষায় গাসাসার অর্থ হলো একত্রে বসা এবং আলোচনা করা।

গণহত্যা কেন হয়েছিল, এর প্রধান কারণ জানতে হলে ফিরে যেতে হবে পেছনে। ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম সেনাবাহিনী দখল করে নেয় পূর্ব আফ্রিকার ছোট সবুজঘেরা দেশটিকে। জাতিগতভাবে রুয়ান্ডাতে সংখ্যাগুরু হুতু এবং সংখ্যালঘু তুতসি দুই সম্প্রদায়ের লোক বাস করত। চালচলন ও আচার-আচরণের দিকে থেকে দুই সম্প্রদায়ের লোকই একই রকম ছিল। তারা একই ভাষায় কথা বলত, একই এলাকায় থাকত, কিন্তু দেখতেই কেবল কিছুটা ভিন্ন ছিল। তুতসিরা ছিল হুতুদের চেয়ে কিছুটা লম্বা এবং চিকন গড়নের। কথিত আছে, তুতসিদের আদি বাসস্থান ইথিওপিয়া। সেখান থেকে আদি পুরুষেরা রুয়ান্ডায় পাড়ি জমান। এই নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক আগে থেকেই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল।

বেলজিয়াম ক্ষমতা দখলের পর রুয়ান্ডার নাগরিকদের সম্প্রদায়ের ওপর ভিত্তি করে দুই রকম পরিচয়পত্র দেওয়ার নিয়ম প্রচলন করে। এতে তুতসি ও হুতুদের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি হয়। যেখানে তাদের একমাত্র পরিচয় হওয়ার কথা ছিল রুয়ান্ডার নাগরিক, সেখানে তারা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে হুতু এবং তুতসি দুই গোত্রে বিভক্ত হয়ে গেল। বেলজিয়ানরা তুতসিদের বেশি প্রাধান্য দিত হুতুদের চেয়ে এবং বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করত। বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তুতসিরাও বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছিল।

বৈষম্যের স্বীকার হুতু সম্প্রদায়ের মধ্যে ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমতে থাকে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৯ সালে। সে বছর হুতু ও তুতসিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় ২০ হাজার তুতসি। অনেকেই পালিয়ে পাশের দেশ বুরুন্ডি, তানজানিয়া ও উগান্ডায় যায়। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পায় রুয়ান্ডা। স্বাধীনতা পাওয়ার পরপরই হুতুরা তাদের হারিয়ে ফেলা ক্ষমতা আবার ফিরে পায়।

২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল রুয়ান্ডান সরকার ৬০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ১৯৯৪ সালে সংঘটিত রুয়ান্ডান গণহত্যার জন্য ফ্রান্স ‘ব্যাপকভাবে’ দায়ী ছিল। এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডান গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হয়েছে।

রুয়ান্ডায় ঔপনিবেশিক শাসন এবং হুতু–তুতসি সংঘাত

রুয়ান্ডা আফ্রিকা মহাদেশের একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। ২৬,৩৩৮ বর্গ কি.মি. আয়তন এবং প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৮৫% জাতিগতভাবে হুতু এবং প্রায় ১৪% জাতিগতভাবে তুতসি। এই জাতিগত বিভাজন এবং উক্ত বিভাজন সংক্রান্ত রাজনৈতিক কূটকৌশল রুয়ান্ডার বিগত শতাব্দীর ইতিহাসকে অত্যন্ত রক্তাক্ত করে রেখেছিল, এবং এখন পর্যন্ত দেশটি এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার রেশ পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

অতীতে রুয়ান্ডায় হুতু ও তুতসি শব্দদ্বয় দ্বারা পৃথক কোনো জাতি/নৃগোষ্ঠীকে বোঝাতো না, বরং দুটি পৃথক অর্থনৈতিক শ্রেণিকে বোঝান হতো। অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ব্যক্তিরা ছিল তুতসি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, এবং অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা ছিল হুতু শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সেসময় যেকোনো ব্যক্তিই নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হুতু বা তুতসি হতে পারত। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি হুতু পরিবারে জন্ম নিয়েও নিজের অর্জিত বিত্তবলে তুতসি হতে পারত, আবার বিপরীতক্রমে একজন তুতসিও হুতুতে পরিণত হতে পারত। কিন্তু ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন এই ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায় এবং এক মারাত্মক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়।

১৮৯৭ সালে রুয়ান্ডা জার্মানির একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং জার্মানরা রুয়ান্ডার হুতুদের তুলনায় তুতসিদের অধিকতর সুযোগ–সুবিধা প্রদান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের হস্তগত হয় এবং ১৯২৬ সালে অঞ্চলটিতে প্রত্যক্ষ বেলজীয় শাসন স্থাপিত হয়। বেলজীয়রাও প্রাথমিক পর্যায়ে হুতুদের তুলনায় তুতসিদের অধিকতর সুযোগ–সুবিধা প্রদান করে এবং ১৯৩৫ সালে হুতু ও তুতসি সম্প্রদায় দুটিকে স্থায়ীভাবে পৃথক করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে হুতু–তুতসি বিভাজন অর্থনৈতিক বিভাজনের পাশাপাশি জাতিগত বিভাজনেও পরিণত হয় এবং হুতু–তুতসি দ্বন্দ্বের সূচনা হয়।

মানচিত্রে রুয়ান্ডা; Source: Nations Online Project

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেলজীয়রা রুয়ান্ডার প্রতি তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনে এবং হুতুদের সুযোগ–সুবিধা প্রদান করতে শুরু করে। এই পর্যায়ে হুতুরা তুতসিদের তুলনায় অধিক সুযোগ–সুবিধা দাবি করতে থাকে এবং অঞ্চলটির রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমশ হুতুদের হস্তগত হতে থাকে। ১৯৫০–এর দশকের শেষভাগে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র দাঙ্গাহাঙ্গামা আরম্ভ হয়ে যায় এবং এর মধ্যেই ১৯৬২ সালে বেলজিয়াম রুয়ান্ডাকে স্বাধীনতা প্রদান করে। স্বাধীন রুয়ান্ডায় একটি হুতু–কর্তৃত্বাধীন সরকার স্থাপিত হয় এবং তারা তীব্র তুতসিবিরোধী নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে হাজার হাজার তুতসি নিহত হয় এবং কয়েক লক্ষ তুতসি দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যেখানে তাদের নিচু দৃষ্টিতে দেখা হত এবং তাদের প্রতি নানাবিধ বৈষম্য করা হতো।

১৯৭৩ সালে রুয়ান্ডান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জুভেনাল হাবিয়ারিমানা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির শাসনক্ষমতা দখল করেন এবং একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অধীনে রুয়ান্ডান সরকারের তুতসিবিরোধী নীতি বজায় থাকে এবং রাষ্ট্রীয় মদদে তুতসিদের বিরুদ্ধে নিষ্পেষণ চালানো অব্যাহত থাকে, যদিও এ সময় তুতসিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পায়। এ সময় রুয়ান্ডায় বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ফ্রান্সের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এদিকে ১৯৭৯ সালে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র উগান্ডায় তুতসি নেতারা তুতসি শরণার্থীদের সমন্বয়ে ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ (আরপিএফ) নামক একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন। এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডায় তুতসিদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং এজন্য তারা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ এবং তুতসিবিরোধী গণহত্যা

১৯৯০ সালে আরপিএফ উগান্ডায় তাদের ঘাঁটি থেকে উত্তর রুয়ান্ডায় আক্রমণ চালায় এবং এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই রুয়ান্ডান সরকার অন্তত ৮,০০০ তুতসিকে গ্রেপ্তার করে ও ব্যাপক তুতসিবিরোধী প্রচারণা শুরু করে, এবং রুয়ান্ডা জুড়ে তুতসিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। প্রায় তিন বছর যুদ্ধ চলে, কিন্তু কোনো পক্ষ বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৩ সালের আগস্টে উভয় পক্ষের মধ্যে ‘আরুশা চুক্তিসমূহ’ নামক একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, কিন্তু ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল হুতু উগ্রপন্থীরা রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানাকে বহনকারী হেলিকপ্টারকে ভূপাতিত করে। হাবিয়ারিমানার মৃত্যুর পরপরই হুতু উগ্রপন্থীরা একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রুয়ান্ডার শাসনক্ষমতা দখল করে নেয় এবং তুতসিদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে।

হাবিয়ারিমানা নিহত হওয়ার পরের দিনই রুয়ান্ডা জুড়ে সৈন্য, পুলিশ, মিলিশিয়া ও বেসামরিক হুতু জনসাধারণ তুতসিদের বিরুদ্ধে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে হুতু উগ্রপন্থীদের হাতে প্রায় ৫ থেকে ৮ লক্ষ তুতসি (ও তুতসিদের সমর্থনকারী হুতু) নিহত হয় এবং আড়াই লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ তুতসি নারী (ও তুতসি পুরুষদের সঙ্গে বিবাহিত হুতু নারী) ধর্ষণের শিকার হয়। এত কম সময়ের মধ্যে এত বড় মাত্রার হত্যাযজ্ঞ সম্পাদনের ঘটনা মানব ইতিহাসে বিরল।

রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির দক্ষিণে অবস্থিত ন্তামারা গির্জার ধ্বংসাবশেষ। ১৯৯৪ সালে হুতু মিলিট্যান্টরা এখানে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ৫,০০০ তুতসিকে হত্যা করেছিল; Source: Wikimedia Commons

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই গণহত্যা রোধের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় প্রদান করে। জাতিসংঘ কর্তৃক তুতসিদের রক্ষার উদ্দেশ্যে রুয়ান্ডায় মোতায়েনকৃত ‘জাতিসংঘ রুয়ান্ডা সহায়তা মিশন’ (United Nations Assistance Mission for Rwanda, ‘UNAMIR’) নির্বাক দর্শক হিসেবে এই হত্যাযজ্ঞ অবলোকন করে, কারণ বিশ্বশক্তিগুলো আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গৃহযুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী ছিল না। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সই রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, কিন্তু গণহত্যার শিকার তুতসিদের রক্ষা করার জন্য নয়, বরং গণহত্যাকারী রুয়ান্ডান সরকারকে রক্ষা করার জন্য!

এদিকে রুয়ান্ডান গণহত্যা শুরু হওয়ার পরপরই আরপিএফ নতুন করে আক্রমণাভিযান শুরু করে এবং ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে প্রায় সমগ্র রুয়ান্ডা অধিকার করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডান গণহত্যার অবসান ঘটে এবং রুয়ান্ডার হুতু–নিয়ন্ত্রিত সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী জায়ারেতে (বর্তমান কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র) আশ্রয় নেয়। তখন থেকে তুতসি–প্রধান আরপিএফ রুয়ান্ডার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে।

লা ফ্রাঙ্কোফোনি এবং রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে ফ্রান্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যান্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের মতো ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে। কিন্তু ব্রিটেন যেরকম যুদ্ধ ব্যতিরেকে অধিকাংশ উপনিবেশ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, ফ্রান্স সেরকম নমনীয়তা প্রদর্শন করতে পারেনি। এর ফলে ইন্দোচীন ও আলজেরিয়ায় ফ্রান্সকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় এবং অবশেষে তারা তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এরপরও ফ্রান্স বিশেষত তাদের প্রাক্তন আফ্রিকান উপনিবেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।

এই উদ্দেশ্যে তারা ‘ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব’ (Francophone World বা La francophonie) নামক একটি ধারণার প্রবর্তন করে। এই অনুযায়ী, যেসব রাষ্ট্রে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে, সেগুলো মিলে ফ্রান্সের নেতৃত্বে একটি ‘বৃহৎ পরিবার’ গঠন করবে। ফ্রান্সের দৃষ্টিতে রুয়ান্ডা ছিল ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্বের অংশ। রুয়ান্ডা ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল না এবং সেখানকার জনসাধারণের মাত্র এক–অষ্টমাংশ ফরাসি ভাষায় কথা বলত। কিন্তু ফরাসি ভাষা ছিল দেশটির সরকারি ভাষা এবং দেশটির শাসকশ্রেণি ফ্রান্সকে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও নিরাপত্তার উৎস হিসেবে বিবেচনা করত। এর ফলে হাবিয়ারিমানার সরকারের সঙ্গে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

রুয়ান্ডার তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জুভেনাল হাবিয়ারিমানা (ডানে) এবং আরপিএফ নেতা ও রুয়ান্ডার বর্তমান রাষ্ট্রপতি পল কাগামে (বামে)। হাবিয়ারিমানা ছিলেন ফ্রান্সের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে ফরাসিরা কাগামেকে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাংলোফোন বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করত; Source: Wikimedia Commons

১৯৯০ সালের অক্টোবরে আরপিএফ কর্তৃক রুয়ান্ডায় পরিচালিত আক্রমণকে ফরাসি সরকার বিবেচনা করে ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্বের সঙ্গে অ্যাংলোফোন বিশ্বের (‘Anglophone World’; ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত রাষ্ট্রগুলো) চিরন্তন দ্বন্দ্ব হিসেবে। তদানীন্তন ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরার আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, মিতেরা এই আক্রমণকে একটি অ্যাংলোফোন ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন। তার ধারণা ছিল, এর মূল উদ্দেশ্য অ্যাংলোফোন উগান্ডা (প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ) ও আরপিএফ কর্তৃক একটি ইংরেজিভাষী তুতসিল্যান্ড প্রতিষ্ঠা এবং এর মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলে ফরাসি প্রভাব হ্রাস করে অ্যাংলোফোন প্রভাব বৃদ্ধি করা।

মিতেরা একা নন, ফ্রান্সের শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তারা সেসময় রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধকে ফ্রাঙ্কোফোন হুতু এবং ‘হানাদার’ অ্যাংলো–স্যাক্সন তুতসিদের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন। রুয়ান্ডার জনসংখ্যার ১৫% যে তুতসি এবং তাদের বিরুদ্ধে রুয়ান্ডার সরকার যে দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য, হত্যাযজ্ঞ ও অন্যান্য নিষ্পেষণ চালিয়ে আসছিল, এই বিষয়টিকে তারা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেন। কিছু কিছু ফরাসি সামরিক কর্মকর্তা দাবি করেন যে, আরপিএফ রুয়ান্ডার হুতুদের ধ্বংস করতে চায় এবং তারা কার্যত ‘কৃষ্ণাঙ্গ খেমার’। উল্লেখ্য, ১৯৭০–এর দশকে উগ্র বামপন্থী ‘লাল খেমার’ বা ‘খেমার রুজ’ দল কম্বোডিয়ায় এক ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিল এবং ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল।

https://assets.roar.media/assets/zSIUhd1ZAwxlShpu_000_Par7840366_1.jpg

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ চলাকালে ফ্রান্সের একদল উচ্চপদস্থ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও ব্যবসায়ী মিলে রুয়ান্ডা সংক্রান্ত একটি গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, যেটির কেন্দ্রে ছিলেন রাষ্ট্রপতি মিতেরা। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে আরপিএফ যাতে সামরিকভাবে বিজয়ী হতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য, ফরাসি পররাষ্ট্রনীতিতে আফ্রিকার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ ‘আফ্রিকা সেল’ ফ্রান্সের আফ্রিকা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এজন্য রুয়ান্ডার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মিতেরাকে ফরাসি আইনসভার পরামর্শ বা অনুমোদন নিতে হয়নি। এ সময় আফ্রিকা সেলের প্রধান ছিলেন মিতেরার ছেলে জাঁ ক্রিস্তফ মিতেরা এবং হাবিয়ারিমানার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল।

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ শুরুর পরপরই এই যুদ্ধে ফ্রান্সের অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ফ্রান্স রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনীকে রসদপত্র সরবরাহ শুরু করে। যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জাঁ–বস্কো বারায়াগউয়িজা ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ রুয়ান্ডান সরকারি কর্মকর্তারা প্যারিস সফর করেন এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বারায়াগউয়িজাকে পরবর্তীতে রুয়ান্ডান গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ এবং ফরাসি–রুয়ান্ডান সামরিক সহযোগিতা

এ সময় ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার মধ্যে যে সামরিক সংক্রান্ত চুক্তিগুলো হয়, সেগুলোর সিংহভাগই সম্পাদিত হয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত রুয়ান্ডান দূতাবাসের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এই দূতাবাস থেকে প্রচুর নথিপত্র উদ্ধার করা হয়, কিন্তু ফরাসি–রুয়ান্ডান সম্পর্ক সংক্রান্ত কোনো নথিই পাওয়া যায়নি। কারণ, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে আরপিএফের বিজয়ের পর ফ্রান্সে নিযুক্ত রুয়ান্ডান সামরিক অ্যাটাশে কর্নেল সেবাস্তিয়েন ন্তাহোবারি এই সংক্রান্ত সকল নথিপত্র ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যান্য সূত্র থেকে ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার মধ্যবর্তী সামরিক সহযোগিতা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেছে।

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিতেরা; Source: Wikimedia Commons

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে রুয়ান্ডায় ৪৭ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি ফরাসি সামরিক সহযোগিতা দল ছিল এবং এটি কোনো গোপন তথ্য ছিল না। রুয়ান্ডান সশস্ত্রবাহিনী ও মিলিশিয়াগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে এরা ‘উপদেষ্টা’ ও ‘কারিগরি সহায়ক’ হিসেবে কর্মরত ছিল। রুয়ান্ডান সেনাবাহিনীর রিকনিস্যান্স ব্যাটালিয়নে ৩ জন ফরাসি কারিগরি সহায়ক ছিল। রুয়ান্ডান বিমানবাহিনীতে ২ জন ফরাসি ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর, ১ জন নেভিগেটর, ১ জন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ও ১ জন মেকানিক ছিল। রুয়ান্ডান প্যারাকমান্ডো বাহিনীতে ৪ জন ফরাসি সদস্য ছিল, যাদের মধ্যে একজন ছিল ফরাসি সেনাবাহিনীর মেজর।

তদুপরি, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর রুয়ান্ডান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ফরাসি ক্যাপ্টেন পল বারিলকে একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের জন্য নিযুক্ত করে। উল্লেখ্য, বারিল ছিলেন একজন প্রাক্তন ফরাসি পুলিশ কর্মকর্তা এবং রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানার প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা। বারিল উত্তর–পশ্চিম রুয়ান্ডার বিগোগোয়েতে অবস্থিত একটি ঘাঁটিতে ১২০ জন রুয়ান্ডান সৈন্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এই বিশেষ ইউনিটটিকে লক্ষ্যভেদ ও অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত কৌশল শেখানো হয় এবং আরপিএফ–নিয়ন্ত্রিত ভূমির গভীরে অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়।

তদুপরি, প্রাক্তন রুয়ান্ডান সামরিক প্রশিক্ষক ইসিদোর ঞ্জেয়িমানার ভাষ্যমতে, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ চলাকালে ফরাসি সেনা কর্মকর্তারা রুয়ান্ডার ‘ইন্টারাহামোয়ে’ মিলিশিয়া সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এই মিলিশিয়াটি পরবর্তীতে তুতসিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। রুয়ান্ডান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য কর্পোরাল জাঁ দামাসে কাবুরারের ভাষ্যমতে, রুয়ান্ডান সৈন্যদের মধ্যে তুতসিবিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টিতে এবং উগ্র হুতু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও ফরাসি সৈন্যরা ভূমিকা রেখেছিল।

ফ্রান্স রুয়ান্ডান সরকারকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে, কিন্তু এই তথ্য গোপন রাখা হয়। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচে’র প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ফ্রান্স রুয়ান্ডাকে ৩৬টি অস্ত্রের চালান সরবরাহ করে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে ৩১টি চালানই ফ্রান্সের অস্ত্র বাণিজ্যের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে প্রেরণ করা হয়েছিল। তদুপরি, ফ্রান্সের সহায়তায় রুয়ান্ডান সরকার মিসর ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ মার্কিন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম লাভ করে, এবং রুয়ান্ডান গণহত্যা শুরু হওয়ার পরেও অস্ত্রশস্ত্রের এই প্রবাহ অব্যাহত থাকে।

তুতসি–নিয়ন্ত্রিত ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ বা ‘আরপিএফ’–এর পতাকা; Source: Wikimedia Commons

রুয়ান্ডায় কর্মরত বেলজীয় গোয়েন্দাদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ শুরুর পর রুয়ান্ডায় অবস্থানরত ফরাসি কূটনীতিকরা রুয়ান্ডার বিরোধী দলীয় হুতু নেতাদের রুয়ান্ডার সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য চাপ প্রদান করেন। তাঁরা রুয়ান্ডান বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের বুঝান যে, তুতসি আরপিএফকে প্রতিহত করতে হলে হাবিয়ারিমানাকে সমর্থন করা ছাড়া হুতুদের আর কোনো বিকল্প নেই। এভাবে রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ চলাকালে রুয়ান্ডার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হাবিয়ারিমানার অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্যও ফ্রান্স সচেষ্ট ছিল।

রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের প্রথম সামরিক অভিযান

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ চলাকালে রুয়ান্ডান সরকারের প্রতি ফ্রান্সের সমর্থন কেবল পরোক্ষ সামরিক সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ চলাকালে ফ্রান্স রুয়ান্ডান সরকারের সমর্থনে দেশটিতে তিনটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে প্রথম অভিযানটি পরিচালিত হয় ১৯৯০ সালের অক্টোবরে।

১৯৯০ সালের অক্টোবরে আরপিএফ যখন উগান্ডা থেকে উত্তর রুয়ান্ডায় আক্রমণ চালায়, সেসময় রুয়ান্ডান সশস্ত্রবাহিনী অসতর্ক অবস্থায় ছিল। ফলে যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে আরপিএফ দ্রুত অগ্রসর হয় এবং রুয়ান্ডান সরকার আশঙ্কা করতে থাকে যে, আরপিএফের হাতে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির পতন ঘটবে। আরপিএফের অগ্রাভিযান প্রতিহত করার জন্য রুয়ান্ডান সরকার ফ্রান্সের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে। ফ্রান্স এই আহ্বানে সাড়া প্রদান করে এবং রুয়ান্ডায় ৬০০ সৈন্য প্রেরণ করে।

আনুষ্ঠানিকভাবে রুয়ান্ডায় ফরাসি সৈন্য প্রেরণের কারণ ছিল দেশটিতে অবস্থানরত ফরাসি নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান করা। কিন্তু কার্যত ফরাসিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আরপিএফের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা। ফরাসি সৈন্যরা কিগালি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান গ্রহণ করে এবং আরপিএফ যাতে কিগালির দিকে অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য অবস্থান গ্রহণ করে। বিভিন্ন সূত্রের মতে, রুয়ান্ডান সেনাবাহিনী যে আরপিএফের ওপর গোলাবর্ষণ করছিল, সেটি ফরাসিরা তত্ত্বাবধান করতে থাকে এবং ফরাসি হেলিকপ্টার গানশিপ আরপিএফের অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে।

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের সময় গ্যাবনের রাজধানী লিব্রেভিলে একটি ফরাসি ‘সি–১৩০ হারকিউলিস’ পরিবহন বিমান। এই বিমানে করেই ফরাসিরা রুয়ান্ডায় সৈন্য প্রেরণ করত; Source: Wikimedia Commons

এমতাবস্থায় আরপিএফের পক্ষে কিগালি আক্রমণ করা সম্ভব হয়নি এবং তাদের অগ্রাভিযান গতি হারিয়ে ফেলে। ক্রমশ রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনী আরপিএফ কর্তৃক অধিকৃত অধিকাংশ অঞ্চল পুনর্দখল করে নেয়। আরপিএফ রুয়ান্ডার পার্বত্য অঞ্চলে পশ্চাৎপসরণ করে এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। বস্তুত ফরাসি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে এই পর্যায়ে রুয়ান্ডান সরকার রক্ষা পায়। যদি ফরাসিরা আরপিএফের অগ্রযাত্রা প্রতিহত না করত, সেক্ষেত্রে হয়ত রুয়ান্ডান সরকারের পতন ঘটত এবং তারা তিন বছর পর তুতসিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর সুযোগ পেত না।

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ শুরুর পরপরই রুয়ান্ডান সরকার তুতসিদের ওপর ব্যাপক দমন–পীড়ন শুরু করে এবং বিভিন্ন স্থানে তুতসিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ১৯৯৩ সাল নাগাদ এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, রুয়ান্ডায় তুতসিদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটি গণহত্যা সংঘটিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু রুয়ান্ডান সরকারের প্রতি ফ্রান্সের সমর্থন অব্যাহত থাকে।

১৯৯০ সালের অক্টোবরে ফ্রান্সের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির দিকে তুতসি বিদ্রোহী দল ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টে’র (আরপিএফ) অগ্রযাত্রা প্রতিহত হয় এবং রুয়ান্ডার হুতু–নিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে সক্ষম হয়। এরপর আরপিএফ রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে এবং প্রায় এক বছর এভাবে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এই সময়ে রুয়ান্ডান সরকার ব্যাপকভাবে তুতসিবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকে এবং এর ফলে হুতু জনসাধারণের মধ্যে তীব্র তুতসিবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। একই সময়ে রুয়ান্ডান সরকার তুতসিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে নিপীড়ন শুরু করে এবং হুতু মিলিট্যান্টরা হাজার হাজার তুতসিকে হত্যা করে।

রুয়ান্ডান সরকারের প্রধান মিত্র ফ্রান্স রুয়ান্ডায় বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিল এবং রুয়ান্ডায় যে একটি তুতসিবিরোধী গণহত্যার পূর্বপরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটিও তারা ভালোভাবেই জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসি সরকার এই ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং এ সময় তারা রুয়ান্ডান সরকারকে পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখে। এদিকে ১৯৯২ সালের শেষদিকে রুয়ান্ডান সরকার ও আরপিএফের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি সম্পাদিত হয়, কিন্তু রুয়ান্ডান সরকার কর্তৃক তুতসিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাসের মধ্যেই এই যুদ্ধবিরতি অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের দ্বিতীয় সামরিক অভিযান

১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরপিএফ একটি ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে রুয়ান্ডার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয় এবং রাজধানী কিগালির ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পৌঁছায়। রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনী তাদেরকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। আরপিএফ যেকোনো মুহূর্তে কিগালির ওপর আক্রমণ চালিয়ে শহরটি দখল করে নিতে পারে, এই আশঙ্কায় রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানা ফ্রান্সের কাছে জরুরি সহায়তার জন্য আবেদন করেন। যথারীতি ফ্রান্স এই আহ্বানে সাড়া প্রদান করে এবং প্রথমে ১৫০ ও পরবর্তীতে ২৫০ জন সৈন্যকে রুয়ান্ডায় প্রেরণ করে। ৪০০ সৈন্যবিশিষ্ট এই ফরাসি সৈন্যদলটির নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল দিদিয়ে তুজাঁ।

কিগালি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একজন ফরাসি সৈন্য। রুয়ান্ডান শিশু–কিশোররা তার কার্যকলাপ দেখছে; Source: Wikimedia Commons

ফরাসি সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে রুয়ান্ডান সেনাবাহিনী আরপিএফের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করে এবং ফরাসিদের সরবরাহকৃত কামানের গোলা আরপিএফের অবস্থানের ওপর আঘাত হানতে শুরু করে। এর ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এমতাবস্থায় ফরাসিদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানোর জন্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান তীব্র তুতসিবিরোধী মনোভাবের প্রেক্ষাপটে কিগালি দখল করলেও সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয় এই উপলব্ধি থেকে আরপিএফ কিগালি আক্রমণ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় এবং পশ্চাৎপসরণ করে। এভাবে ফ্রান্স দ্বিতীয় বারের মতো আরপিএফের বিজয় রোধ করে এবং রুয়ান্ডান সরকারকে রক্ষা করে। কিন্তু একই সঙ্গে রুয়ান্ডান গণহত্যাকে এড়ানোর আরেকটি সুযোগ হারিয়ে যায়।

রুয়ান্ডান গণহত্যা এবং ফ্রান্স

১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল হুতু উগ্রপন্থীদের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানাকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয় এবং তিনি নিহত হন। হুতু উগ্রপন্থীরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তুতসিদের দায়ী করে এবং ৭ এপ্রিল থেকে রুয়ান্ডা জুড়ে তুতসিদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত গণহত্যা আরম্ভ করে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে হুতু মিলিট্যান্টদের হাতে অন্তত ৮ লক্ষ তুতসি ও মধ্যপন্থী হুতু নিহত হয়।

গণহত্যা চলাকালে রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের ভূমিকা পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। গণহত্যা আরম্ভ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ফরাসি সৈন্যরা রুয়ান্ডায় পৌঁছায় এবং সেখান থেকে ফরাসি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। কিন্তু মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা তুতসিদেরকে কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করতে তারা অস্বীকৃতি জানায়। তারা কিগালিতে অবস্থিত ফরাসি দূতাবাসের কুকুরটিকে পর্যন্ত নিরাপদে সরিয়ে নেয়, কিন্তু অন্য কোনো তুতসি তো পরের কথা, ফরাসি দূতাবাস ও ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তুতসি কর্মচারীদেরকেও তারা সহায়তা করেনি। শুধু তা-ই নয়, যেসব তুতসি নারী/পুরুষ ফরাসি নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিল, তাদেরকেও ফরাসিরা রুয়ান্ডায় ফেলে যায়।

অবশ্য ফরাসি সৈন্যরা কিছু হুতুকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে ছিলেন নিহত রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানার স্ত্রী এবং কিছু হুতু রাজনীতিবিদ, যাঁরা এই গণহত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডায় তুতসিবিরোধী গণহত্যার প্রতি ফ্রান্সের যে সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল, সেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৯৯৪ সালে গ্যাবনের লিব্রেভিলে একটি ফরাসি ‘সি–১৩০ হারকিউলিস’ পরিবহন বিমান। এই বিমানটি ব্যবহার করে ফরাসিরা রুয়ান্ডায় সৈন্য মোতায়েন করেছিল; Source: Wikimedia Commons

ফরাসিরা একে তো গণহত্যার শিকার তুতসিদের কোনো প্রকার সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায়, তদুপরি তারা রুয়ান্ডায় যে গণহত্যা ঘটছে, এই বিষয়টিও স্বীকার করতে চায়নি। ফ্রান্সের আফ্রিকা সেলের প্রধান জাঁ ক্রিস্তফ মিতেরা দাবি করেন যে, রুয়ান্ডায় কোনো গণহত্যা সংঘটিত হওয়া সম্ভবই নয়, কারণ আফ্রিকানরা ‘এতটা সংগঠিত নয়’। তার বাবা এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরা গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করেননি, কিন্তু তিনি মত প্রকাশ করেন যে, এই জাতীয় দেশগুলোতে গণহত্যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়! উভয়ের বক্তব্যেই তাদের তীব্র বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

অপারেশন তুর্কোয়া: রুয়ান্ডান গণহত্যাকারীদের রক্ষায় ফ্রান্স

রুয়ান্ডান গণহত্যা চলাকালে আরপিএফ রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযান শুরু করে এবং একের পর এক অঞ্চল আরপিএফের হস্তগত হতে থাকে। এমতাবস্থায় রুয়ান্ডান সরকারের পতন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। কিন্তু রুয়ান্ডান সরকার কর্তৃক তুতসিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার কারণে এবার আর ফ্রান্সের জন্য সরাসরি আরপিএফের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফ্রান্সের মর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হতো। এজন্য রুয়ান্ডান সরকারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ফ্রান্স একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে।

১৯৯৪ সালের জুনে ফ্রান্স জাতিসংঘের অনুমতিক্রমে রুয়ান্ডায় একটি ‘মানবিক অভিযান’ শুরু করে। ‘অপারেশন তুর্কোয়া’ নামক এই অভিযানটি আনুষ্ঠানিকভাবে ছিল ‘বহুজাতিক’, কিন্তু ৩২ জন সেনেগালিজ সৈন্য ব্যতীত ২,৫০০ সৈন্যবিশিষ্ট এই ‘বহুজাতিক’ বাহিনীর বাকি সকল সদস্যই ছিল ফরাসি। এই বাহিনীটিতে ছিল ১০০টি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, এক ব্যাটারি ১২০ মি.মি. মর্টার, ৪টি ‘জাগুয়ার’ ফাইটার–বম্বার, ৮টি ‘মিরেজ’ ফাইটার এবং ১০টি হেলিকপ্টার। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সুসজ্জিত বাহিনীটির দায়িত্ব ছিল রুয়ান্ডায় চলমান গণহত্যা বন্ধ করা এবং অবশিষ্ট তুতসি জনসাধারণকে রক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে রুয়ান্ডার পশ্চিমাঞ্চলে রুয়ান্ডান সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে তারা একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ (safe zone) স্থাপন করে।

পরবর্তীতে ফ্রান্স দাবি করে যে, এই অভিযানের ফলে তারা হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে এবং উপদ্রুত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তারা দাবি করে যে, এই অভিযানের অংশ হিসেবে তারা রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনী ও বিভিন্ন হুতু মিলিশিয়া বাহিনীকে আংশিকভাবে নিরস্ত্র করতে সক্ষম হয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্য দিয়ে ফ্রান্স রুয়ান্ডায় তাদের ভূমিকাকে গৌরবান্বিত করার প্রয়াস পায়।

মানচিত্রে ‘অপারেশন তুর্কোয়া’র প্রথম পর্যায়; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু ফ্রান্সের প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘মানবিক’ ছিল না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডান সরকারকে নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা করা, আরপিএফের পরিপূর্ণ বিজয় রোধ করা এবং আরপিএফ যাতে রুয়ান্ডার নতুন সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে না পারে ও তদানীন্তন রুয়ান্ডান সরকারের সদস্যদের বন্দি করে বিচারের সম্মুখীন করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা। এজন্য হুতুরা সোৎসাহে ফরাসি সৈন্যদের আগমনকে স্বাগত জানায়। ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ হুতু মিলিট্যান্টরা তুতসিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা অব্যাহত রাখে এবং হাজার হাজার তুতসিকে হত্যা করে। ফরাসি সৈন্যরাও তুতসিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনে জড়িত ছিল, তুতসি ভুক্তভোগীরা এরকম অভিযোগও উত্থাপন করেছে।

এদিকে ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে আরপিএফ ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত ‘তুর্কোয়া অঞ্চল’ বাদে রুয়ান্ডার বাকি অংশ অধিকার করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এ সময় তুতসিবিরোধী গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ফরাসি ‘নিরাপদ অঞ্চলে’র মধ্য দিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র জায়ারে ও অন্যান্য রাষ্ট্রে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। লক্ষ লক্ষ হুতু জনসাধারণও আরপিএফ/তুতসিদের প্রতিশোধের ভয়ে ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে জায়ারেতে পালিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ২১ আগস্ট সর্বশেষ ফরাসি সৈন্য রুয়ান্ডা ত্যাগ করে এবং এরপর আরপিএফ রুয়ান্ডার প্রাক্তন ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিও হস্তগত করে।

রুয়ান্ডান ডোমিনো: জায়ারের পতন

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে আরপিএফের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের আশঙ্কা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। রুয়ান্ডা ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায় এবং অ্যাংলোফোন বিশ্বের নিকটবর্তী হতে শুরু করে। এদিকে রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের অবসানের পর পার্শ্ববর্তী জায়ারে হুতু বিদ্রোহীদের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয় এবং সেখান থেকে তারা রুয়ান্ডার অভ্যন্তরে আক্রমণ চালাতে শুরু করে। জায়ারের ফরাসি–সমর্থিত রাষ্ট্রপতি মবুতু সেসে সেকো হুতু বিদ্রোহীদের সমর্থন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে রুয়ান্ডা হুতু বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে জায়ারেতে আক্রমণ চালায় এবং প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জায়ারেতে মবুতুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অবশেষে ১৯৯৭ সালে মবুতুর পতন ঘটে।

অর্থাৎ, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে আরপিএফ/তুতসিদের বিজয়ের ফলে ক্ষুদ্র রুয়ান্ডা তো বটেই, এর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জায়ারেও ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ অ্যাংলোফোন বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে আফ্রিকার এই অঞ্চলে ফ্রান্সের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। স্বভাবতই ফ্রান্সের ‘লা ফ্রাঙ্কোফোনি’ ধারণার জন্য এটি ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কাস্বরূপ।

মানচিত্রে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় প্রতিষ্ঠিত ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত ‘তুর্কোয়া জোন’; Source: Wikimedia Commons

গণহত্যার দায়: ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

যুদ্ধের পর ফ্রান্স রুয়ান্ডান গণহত্যায় তাদের ভূমিকার কথাকে অস্বীকার করেছে এবং নিজেদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছে। ১৯৯৮ সালে ফরাসি আইনসভা কর্তৃক গঠিত রুয়ান্ডা সংক্রান্ত কমিশন এবং ২০২১ সালে ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁ কর্তৃক গঠিত রুয়ান্ডা সংক্রান্ত কমিশন উভয়েই দাবি করেছে যে, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার ক্ষেত্রে ফ্রান্স কিছু ‘ভুল’ করেছে, কিন্তু রুয়ান্ডান গণহত্যার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অবশ্য ২০২১ সালে মাক্রোঁ কর্তৃক গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে এটি স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, রুয়ান্ডান গণহত্যার প্রতি ফ্রান্স ‘অন্ধ’ ছিল, অর্থাৎ ফ্রান্স এই গণহত্যাকে দেখেও না দেখার অভিনয় করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, ফরাসি সরকার স্পষ্টভাবে রুয়ান্ডান গণহত্যার দায় স্বীকার থেকে বিরত থেকেছে।

উল্টো ২০০৬ সালে ফ্রান্সের একটি সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালত ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানাকে হত্যার জন্য আরপিএফকে এবং রুয়ান্ডার বর্তমান রাষ্ট্রপতি পল কাগামেকে দায়ী করেছে, যদিও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, আরপিএফ নয়, হুতু মিলিট্যান্টরা এই খুনের জন্য দায়ী ছিল। কিন্তু হাবিয়ারিমানার খুনের মধ্য দিয়েই যেহেতু রুয়ান্ডান গণহত্যা আরম্ভ হয়েছিল, তাই এই খুনের দায় আরপিএফ তথা রুয়ান্ডার বর্তমান সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্রান্স কার্যত রুয়ান্ডান গণহত্যার দায় তুতসিদের ওপরেই চাপিয়ে দিতে চায়। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স নিজে এই গণহত্যার দায় থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি পাবে।

কিন্তু এই ঘটনাটি ফরাসি–রুয়ান্ডান সম্পর্কে নতুন তিক্ততার সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি আদালতের এই রায়ের পর রুয়ান্ডান সরকার রুয়ান্ডা থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছিল, ফরাসি স্কুল ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছিল এবং রুয়ান্ডায় ফরাসি রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ করেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য রাষ্ট্র দুটির মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার মধ্যবর্তী সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধের পর আরপিএফ–নিয়ন্ত্রিত রুয়ান্ডান সরকারও কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে এবং এই কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে রুয়ান্ডান গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডান সরকার এই সংক্রান্ত ৬০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং উক্ত প্রতিবেদনে রুয়ান্ডান গণহত্যার জন্য ফ্রান্স ‘বহুলাংশে দায়ী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্রান্স চাইলে ১৯৯৪ সালের গণহত্যা রোধ করতে পারত, কিন্তু তারা সেটা করা থেকে বিরত ছিল এবং উল্টো এ সময় রুয়ান্ডান হুতু–নিয়ন্ত্রিত সরকারকে নানা ধরনের সহায়তা প্রদান করে কার্যত তারা গণহত্যা পরিচালনার জন্য রুয়ান্ডান সরকারকে সমর্থ করে তুলেছিল।

গণহত্যা–পরবর্তী ফরাসি–রুয়ান্ডান সম্পর্ক

কার্যত রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে ফ্রান্সের ভূমিকা যুদ্ধোত্তর সময়ে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি করেছে। বেশ কয়েকবার ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। বহু রুয়ান্ডান উক্ত গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকার জন্য তাদের ওপর ক্ষিপ্ত এবং রুয়ান্ডায় ফরাসি প্রভাব সীমিত রাখতে আগ্রহী। গৃহযুদ্ধ শেষে রুয়ান্ডান সরকার সক্রিয়ভাবে রুয়ান্ডাকে ফরাসি প্রভাব বলয় থেকে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করে। এর অংশ হিসেবে রুয়ান্ডা ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ইংরেজিকে একটি সরকারি ভাষা ঘোষণা করে। এমনকি রুয়ান্ডা ব্রিটিশ–নেতৃত্বাধীন ‘কমনওয়েলথ অফ ন্যাশন্স’–এ যোগদান করেছে, যদিও রুয়ান্ডা কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল না।

১৯৯৪ সালের আগস্টে আরপিএফ নেতা (ও রুয়ান্ডার বর্তমান রাষ্ট্রপতি) পল কাগামে (বামে) এবং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম পেরি (ডানে)। কাগামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন; Source: Wikimedia Commons

ফরাসি সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রতিহত করার জন্য রুয়ান্ডান সরকার দেশটিতে সক্রিয়ভাবে ইংরেজি ভাষার চর্চাকে উৎসাহিত করেছে। রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি কাগামে মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি ফরাসি ভাষা শিখতে আগ্রহী নন। বর্তমানে রুয়ান্ডান সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফরাসি ভাষাকে বিবেচনা করে ‘মৃত্যুর ভাষা’ হিসেবে, যে ভাষাটির ব্যবহারকারীরা রুয়ান্ডায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। অন্যদিকে, ইংরেজি ভাষাকে তারা বিবেচনা করছে ‘প্রতিরোধের ভাষা’ হিসেবে, কারণ ইংরেজিভাষী তুতসিরাই গণহত্যা মোকাবিলা করতে সমর্থ রয়েছে। তদুপরি, দেশটিতে অ্যাংলোফোন প্রভাব জোরদার করার জন্য রুয়ান্ডান সরকার ক্রিকেট খেলার ব্যাপক প্রচলন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং একটি ক্রিকেট বোর্ড গঠন করেছে। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে আফ্রিকায় চলমান তুর্কি–ফরাসি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে রুয়ান্ডান সরকার দেশটিতে প্রথমবারের মতো তুর্কি ভাষার কোর্সও চালু করেছে।

অনুরূপভাবে, গৃহযুদ্ধোত্তর সময়ে ফ্রান্সও বিভিন্ন ক্ষেত্রে রুয়ান্ডার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেছে। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রুয়ান্ডার উন্নয়নের জন্য সহায়তা লাভের প্রচেষ্টায় তারা বাধা প্রদান করেছে। আরপিএফ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে রুয়ান্ডা সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সহায়তা লাভ করত ফ্রান্সের কাছ থেকে। কিন্তু আরপিএফ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রুয়ান্ডা বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম সহায়তা লাভ করেছে ফ্রান্সের কাছ থেকে। সব মিলিয়ে ফ্রান্স এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রুয়ান্ডায় আরপিএফের উত্থানে তারা মোটেই সন্তুষ্ট নয়।

সামগ্রিকভাবে, রুয়ান্ডা ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় ফ্রান্স রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে হুতু–নিয়ন্ত্রিত রুয়ান্ডান সরকারকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে এবং তুতসিবিরোধী গণহত্যা রোধের পরিবর্তে গণহত্যাকারীদের সহায়তা প্রদান করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের আশঙ্কাই বাস্তবে পরিণত হয়। রুয়ান্ডা নিজে তো ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়ই, পার্শ্ববর্তী জায়ারেকে ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, রুয়ান্ডান গণহত্যাকে সমর্থন করে ফ্রান্সের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থোদ্ধার হয় নি, উল্টো এর মধ্য দিয়ে তাদের ইতিহাসে একটি নেতিবাচক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে ফ্রান্স যদি রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের সময় বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করত, সেক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ রক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। যদি তারা রুয়ান্ডার তদানীন্তন সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আরপিএফের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য করত, সেক্ষেত্রে রুয়ান্ডায় হুতু–নিয়ন্ত্রিত একটি সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সম্ভাবনা বেশি হতো এবং রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের প্রভাব বজায় থাকত। কিংবা ফ্রান্স যদি রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করত এবং রুয়ান্ডান গণহত্যা রোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখত, সেক্ষেত্রেও গৃহযুদ্ধের পর তারা রুয়ান্ডার নতুন তুতসি–নিয়ন্ত্রিত সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হতো। কিন্তু বর্ণবাদী মানসিকতা ও অ্যাংলোফোন তুতসি জনগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ থেকে ফ্রান্স রুয়ান্ডান গণহত্যাকে মৌন সমর্থন প্রদান করে, এবং ফলশ্রুতিতে রুয়ান্ডা স্থায়ীভাবে তাদের ‘হাতছাড়া’ হয়ে যায়।

541 ভিউ

Posted ১১:৩৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৬ জুলাই ২০২১

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com