কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৭ ফেব্রুয়ারী) :: ভাতের সঙ্গে ঢেঁড়স আর কত ভালো লাগে! এই এক রেসিপিতে যেন হাঁফিয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের তরফ থেকে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে, তাতে অরুচি এসে গেছে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। এ জন্য অনেকেই পছন্দের খাবার কিনতে বেচছেন কদিন ধরে পাওয়া ত্রাণের জিনিষ।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআরের পাশাপাশি সস্থানীয় কিছু বেসরকারি সংস্থাও রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। তবে আগের তুলনায় অনেক কম। সামনের দিনে এই সহায়তা আরও কমবে বলে ধারণা। এই দফায় আগত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ জীবন-জীবিকা যে অনিশ্চিত, সেটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
তবুও থেমে নেই, এক রেসিপির এইসব আশ্রয় শিবিরে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন ‘অতিথি’। শনিবারও শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে অন্তত ১৭০ জন সদস্য। তাদের সবার ঠাঁই হয়েছে নয়াপাড়ার দক্ষিণে শালগম অস্থায়ী শিবিরে।
শুধু গতকাল নয়, এভাবে প্রতিদিনই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। ৩০০ জন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রতিদিন আসছে নাফ নদীর ওপার থেকে। গত ২৩ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারকে সই করার পর গতকাল পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
অথচ এক মাস আগেও (১৬ জানুয়ারি) প্রত্যাবাসন চুক্তিতে সই করার সময় মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব ‘আন্তরিকভাবেই’ বলেছিলো, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সব ধরনের ব্যবস্থা তারা করবে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তৎপর হয়নি কোনো দেশই।
জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী দুটি থানা বুথিডং এবং রাথিডংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোই এই কদিন ধরে বাংলাদেশে ছুটে আসছেন। কারণ হিসেবে অনুপ্রবেশকারীরা জানাচ্ছেন, হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা আগের চাইতে কমলেও তাদের নানারকম ভয়-ভীতি দেখিয়ে দেশছাড়া করা হচ্ছে।
বিশেষ করে পুরুষদের গুম করা এবং তরুণী-যুবতীদের ধরে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের ইনডিপেনডেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা করেন আবদুল হাকিম নামে এক রোহিঙ্গা; যিনি বহু বছর ধরে এ দেশে বসবাস করছেন।
সর্বশেষ পরিসি’তি সম্পর্কে শনিবার বিকেলে তিনি বলেন, ‘এখন হত্যা-নির্যাতন ওভাবে নেই। তবে এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। বিশেষ করে পুরুষদের গুম এবং যুবতীদের সেনা ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করায় ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম ছেড়ে না পালালে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে। সেনা সদস্যদের পাশাপাশি স’ানীয় চরমপনি’ মগ দস্যুরা প্রতিদিন এসে হুমকি দিয়ে যায়।’
হাকিম আরও জানান, রাখাইন রাজ্যের খুব কম গ্রামেই এখন রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব আছে। তবে সীমান্তবর্তী বুথিডং ও রাথিডং থানায় এখনও কিছু রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করছে বলে জানা গেছে। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ওইসব গ্রামে বর্বরতার আঁচ লাগেনি। কিন’ এখন সেনা ও
মগ দস্যুদের চোখ সেদিকে পড়ায় সেখানকার রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
বিকেলে হাকিমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিলো, ঠিক তখনই নয়াপাড়া ক্যাম্পের সামনে এসে থামে রোহিঙ্গাদের বহনকারী একটি বাস। তাৎক্ষণিকভাবে ওই দৃশ্যটা মোবাইলে ধারণ করে এই প্রতিবেদকের কাছে পাঠান।
ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, বাস থেকে একে একে নেমে আসছেন গতকালই সীমান্ত পাড়ি দেওয়া রোহিঙ্গারা। তাদের সঙ্গে কাপড়চোপড়সহ আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ছিলো।
হত্যা নির্যাতনের মাত্রা কমে আসার পরেও তারা কেন পালিয়ে আসছেন- হাকিমের এমন প্রশ্নের জবাবে এক রোহিঙ্গা যুবক জানায় গুম এবং ধর্ষণের কথা। সেনা ও মগ দস্যুদের হুমকি ধমকি এবং গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে পালিয়ে আসার কথা উল্লেখ করেন তিনি। রাথিডংয়ের আনুপ্রাং মোজাইন থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে অনুপ্রবেশ করে পরিবারগুলো।
কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির থেকে মজিব উল্যাহ নামে একজন ফোনে বলেন, ‘গত আগস্টের সহিংসতার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ ফিরে যেতে মরিয়া।
কিন্তু প্রত্যাবাসন চুক্তিতে যেসব শর্ত উল্লেখ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে হবে খুবই অমানবিক পরিবেশে। তাদের জন্য যেসব ক্যাম্প বানানোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো মূলত খোলা আকাশের নিচে একেকটি কারাগার
তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গারা চাইছে তাদের জন্য নিরাপদ একটি পরিবেশ। তারা যেন নিজেদের ভিটেমাটি ফেরত পায়। তারা সেখানেই যেন শান্তিমত বসবাসের নিশ্চয়তা পায়। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো স্বাধীন মর্যাদা দিলে ফিরে যেতে কারোরই অনীহা থাকার কথা না।
তবে প্রত্যাবাসন চুক্তির শর্তগুলো দেখে রোহিঙ্গারা আরও বেশি ভয় পেয়ে গেছেন।
পাঁচ বছর আগে একই পরিসি’তিতে জাতিগত নিধনের ফলে ঘরছাড়া প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে পরবর্তীতে একটি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয় মিয়ানমার সরকার।
এখনও সেই ক্যাম্পে কোনো সাংবাদিক এবং বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিকে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। সেই ক্যাম্পের ভেতরের অমানবিকতা এবং নির্মমতার কথা প্রায়ই শোনা যায়। সেটিকে এক অর্থে কারাগার বলেই সম্বোধন করেন অনেকে। মানবেতর ওই ক্যাম্পের উদাহরণ টেনেই বর্তমান চুক্তির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ দেখিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা।
এদিকে, মিয়ানমারের ইন-দিন এলাকায় ১০ জন রোহিঙ্গাকে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে নির্মমভাবে হত্যার আগে-পরের দুটি ছবি সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে ওই গণহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণ উঠে এলে উদ্ভুত পরিসি’তিতে মিয়ানমার সরকারও নড়েচড়ে বসে। এর দায়ে ১৬ জন সেনা সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন’ এখনও আটক করে রাখা হয়েছে রয়টার্সের সেই দুজন সাংবাদিককে। তাদের বিচার শুরু এবং অন্তত ১৪ বছরের জেল দেওয়া হতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসছে প্রত্যাবাসন চুক্তিকে ঘিরে।
স্থানীয় আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তরফ থেকে কক্সাবজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এখন যে খাবার দেওয়া হয়, সেখানে প্রায় প্রতিদিনই চালের সঙ্গে ঢেঁড়স। এই খাবার খেতে খেতে রোহিঙ্গারা হাঁফিয়ে উঠেছে।
অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, তারা নাকি মাছের স্বাদই ভুলে গেছেন। তাই এক রেসিপির রুচিতে নতুন স্বাদ যোগ করতে অনেকেই পছন্দের খাবার কেনেন। তবে এর জন্য বেচতে হয় ত্রাণ হিসেবে পাওয়া নানারকম জিনিষপত্র।
তবে রোহিঙ্গা নেতারা এটিও বলছেন, আশ্রিত শরণার্থীরা এখন তো অন্তত এক রকমের খাবার পাচ্ছেন, কিছুদিন পরে সেটিও মিলবে কি-না তা ভাবার বিষয়। এ জন্য তারা ফেরত যেতে চায়। কারণ, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি পরিবারও নিঃস্ব নয়।
অনেকের চাষের জমি কিংবা হালের বলদ ছিলো। অনেকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিলো। যার কিছুই নেই, অন্তত ভিটেমাটি তো ছিলোই। সেই রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে মানবেতর জীবনযাপন করতে চান না।
কিন’ তাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হতেই বিলম্ব হচ্ছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটিই স্পষ্ট হচ্ছে যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশামতো পরিবেশে পাঠানোর দাবি বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনাই নেই। অবশ্য ঢাকা সফররত মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিউ সির সঙ্গে বৈঠককালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সুর মেলালেন।
তিনি বললেন, রোহিঙ্গাদের জন্যে মিয়ানমারে একটি নিরাপদ ও বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা হোক। আনান কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হোক আগে। রোহিঙ্গাদের দাবিও কিন’ এগুলোই।
Posted ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta