কক্সবাংলা রিপোর্ট :: মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লক্ষ শরণার্থীকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৬টি ক্যাম্পে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। করোনা আবহে প্রবল অর্থনৈতিক চাপের মুখেও উদ্বাস্তুদের ভরণপোষণ দিচ্ছে শেখ হাসিনা সরকার। এহেন পরিস্থিতিতে আর্থিক সাহায্যের বদলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকের মর্যাদা দেওয়ার শর্ত আরোপ করেছিল বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু সরকারের প্রবল আপত্তির মুখে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে এবার সাফাই দিল আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
বিতর্কের মুখে এবার বিশ্ব ব্যাংক সাফাই দিয়েছে যে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্টভাবে কোনও সুপারিশ তারা করেনি। মায়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তায় প্রদান করছে বিশ্ব ব্যাংক।
আর শরণার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে যে পর্যালোচনা, সেটি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে হয়েছে।মঙ্গলবার তাদের ওয়েবসাইটে প্রচারিত এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব ব্যংক।
বিবৃতিতে বিশ্ব ব্যাংক আরও জানিয়েছে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে মায়ানমারে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক প্রভাব কমাতেও বিশ্ব ব্যাংক সহায়তা করছে।
প্রসঙ্গত, সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররপষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, “রোহিঙ্গারা শরণার্থী নয়। সে কারণে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক যে রূপরেখা দিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, সেটা বাংলাদেশের জন্য নয়, ১৬টি দেশের জন্য প্রযোজ্য। যেসব দেশে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সেখানে যাতে আত্মীকরণ করা যায়, যাতে শরণার্থী ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বিবাদ কমে, শরণার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়া যায়, সে জন্য বিশ্ব ব্যাংক এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।”
উল্লেখ্য,কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার। অন্যান্য অনেক দেশ শরণার্থীদের দেখভালের জন্য জাতিসংঘকে অর্থ প্রদান করে। এই অর্থ প্রদানের পরিমাণ দিনদিন কমে আসছে এবং এর ফলে বাড়তি বোঝা বাংলাদেশের ওপর চাপানোর একটি চেষ্টা আছে বিদেশিদের বলে অভিযোগ।
এই বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, “বিদেশি অর্থদাতারা চাইছে রোহিঙ্গাদের উপার্জনের ব্যবস্থা, যাতে তারা নিজেদের খরচ নিজেরাই মেটাতে পারে। এছাড়া তাদের জন্য শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, অবাধ চলাচলের বিষয়েও তারা জোর দিচ্ছে। এজন্য রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন-সহ অন্যান্য বিষয়গুলো চালু করার প্রস্তাব করছে তারা।”
এই বিষয়ে বাংলাদেশের পররাস্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন আগেই জানিয়েছিলেন, বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য এইসব শর্ত মেনে নিলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্য আছে তার সঙ্গে সংঘাত হতে পারে। এজন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে। সহজ কথায়, বাংলাদেশ এই প্রস্তাব মানবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ‘ঋণ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে কক্সবাজারের শরনার্থী শিবিরে আশ্যয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির’ বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব কোনওভাবেই সমর্থন যোগ্য নয় বলে ব্যপক প্রতিক্রিয়া জানায় জেলার বিশিষ্ঠজনরা। তাদের দাবি, বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের প্রস্তাব মেনে না নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা বলেন, ‘বাংলাদেশকে নতুন ফিলিস্তিন বানানোর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া এই ধরনের পরামর্শের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তিগুলোকে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে।’ ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে মিয়ামনারে ফেরত পাঠানো। এ ধরনের প্রস্তাবের মাধ্যামে বিশ্বব্যাংক মূলত রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করছে। কারণ সম্মানজনকভাবে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়াটাই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে সমর্থন দিলে তাদের সেই অধিকার ব্যাহত হবে।’
কক্সবাজার বাচাঁও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন,‘বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব গৃহীত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য। ‘এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে সরকারকে তার অবস্থান দ্রুত সুস্পষ্ট করতে হবে এবং দেশের ভেতরও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটা দেশের জন্য একটি শুভ দিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের জায়গা দিয়েছেন, তখন আশ্রয় না দিলে জাতিসংঘ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের দুর্নাম করত। মানবতার খাতিরে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলেই কি তাদের স্থায়ী করে নিতে হবে? এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলব, আপনি বিশ্ব ব্যাংকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। সুন্দর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করুন। আপনার আহ্বানে প্রয়োজনে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষ সাড়া দিয়ে হেঁটে ঢাকায় এসে বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতে প্রস্তুত। বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করা হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ফজলুল কবির সোমবার সন্ধ্যায় জানান, রোহিঙ্গাদের কীভাবে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে একীভূত করার কথা তারা বলতে পারে? বিশ্ব ব্যাংক যদি বাংলাদেশকে ভিক্ষুক মনে করে তা তাদের ভুল হবে। যেহেতু আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ স্বনির্ভর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশরক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত রয়েছে এদেশের জনগণ।
Posted ৬:০৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৩ আগস্ট ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta