কক্সবাংলা ডটকম(১০ নভেম্বর) :: অব্যাহত রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চিন্তিত সরকার। এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মায়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নেই। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা জোরদার করেছে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গাদের জন্য মায়ানমারের ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে ও ২য় ভাষা হিসেবে থাকবে ইংরেজি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, গত ২৫ আগস্ট থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত দুই মাসে দেশে প্রায় ৬ লাখ ৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগ থেকেই আরও প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ১১ হাজার। তবে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিসভার একজন সদস্য বলেন, ‘এদের আমরা আশ্রয় দিয়ে যেমন বেকায়দায় পড়েছি; আবার আশ্রয় না দিলেও বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামি জোট এই ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করত। এই রাজনৈতিক চিন্তা ও মানবিক কারণেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এখন এদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে মায়ানমার সরকারের তেমন আন্তরিকতা দেখা যাচ্ছে না। এরপরও সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
এদিকে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে দেশি-বিদেশি উগ্রবাদী গোষ্ঠী যাতে কোন ধরনের অপকর্ম বিশেষ করে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালাতে না পারে সে সম্পর্কেও সচেষ্ট রয়েছে সরকার। এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান ভিত্তিক কোন জঙ্গি সংগঠন ও সংস্থা পার্বত্য জেলায় যাতে অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ না পায় সে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে রয়েছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে গত ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম’ শীর্ষক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় জানানো হয়, ‘গত ২৫ আগস্ট থেকে গত দুই মাসে ৬ লাখ ৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এত অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক লোক এক দেশ হতে অন্য দেশে প্রবেশ করার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাদের এদেশে আশ্রয় প্রদান করেছেন এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।’
এর আগে মায়ানমার নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদান ও ত্রাণ কাজ সমন্বয়ের জন্য গত ১৪ ও ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুটি সভা হয়। মায়ানমারের সেনাবাহিনী/নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সে দেশের নাগরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত অমানবিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুর অভিযানের ফলে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে চলে এসেছে বলে ওই সভার কার্যবিবরণীতে মন্তব্য করা হয়।
স্বাস্থ্যসেবা জোরদার
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা বিভাগ সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কক্সবাজারের উখিয়া ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যমান আশ্রয়স্থলসমূহে ইতোমধ্যে সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে ৩৬টি মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নতুন ক্যাম্প এলাকায়ও মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর ১২টি কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা এবং মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছে।
উখিয়ার টিভি স্টেশনের পাশে নরওয়েজিয়ান রেডক্রসের সহযোগিতায় বিডিআরসিএস ৬০ শয্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এমএসএফ ও আরএইচইউ পরিচালিত বিদ্যমান স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহের সক্ষমতা (৩৫ শয্যার কলেরা হাতপাতালসহ) বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও উপজেলা হাসপাতালসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীসহ মোট ১২ লাখ লোককে কলেরা ভ্যাকসিন দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে সাত লাখ ৪৮৭ জনকে কলেরা ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে।
তুরস্ক সরকারের কাছে থেকে ২টি ফিল্ড হাসপাতাল এবং ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। সবমিলিয়ে মোট ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৪ জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। তবে নতুন ব্লক ও ক্যাম্পে আরও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন বলে মনে করছে দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
রোহিঙ্গাদের শিক্ষা মায়ানমারের ভাষায়
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিশু ও নাগরিকদের সব শিক্ষা কার্যক্রম মায়ানমারের ভাষায় পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয়। তবে তাদের ২য় ভাষা ইংরেজি হতে পারে। প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ রোহিঙ্গাদের শিক্ষা কার্যক্রম মনিটরিং করবে। বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আশ্রয়প্রার্থী শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার করছে।
নির্ধারিত এলাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়া:
দুর্যোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা নির্ধারিত এলাকার বাইরে কক্সবাজার ও আশপাশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার থেকে ৩০ হাজার ২১৩ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে। অন্যান্য জেলা থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে ৭০৯ জন রোহিঙ্গাকে। তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে ২৩টি স্থানে পুলিশ চেকপোস্টের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদের সম্ভাব্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য মানবিক সহায়তার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। নিরাপত্তার জন্য নতুন আরও ২০টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মায়ানমারের নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মায়ানমার সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মায়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত থাকবে।’
রোহিঙ্গা নিবন্ধন
রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের জন্য পাসপোর্ট অধিদফতর বিজিবির সহযোগিতায় ৫০টি রেজিস্ট্রেশন বুথ পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৫১ জনের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। পাসপোর্ট অধিদফতর প্রতিদিন ১৩ হাজার জনের নিবন্ধন করতে পারে। আসন্ন ডিসেম্বরের মধ্যে সব মায়ানমার নাগরিকের নিবন্ধন এবং ডাটাবেজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় সরকারের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব জানান, গত ২৫ আগস্টের আগ থেকে বসবাসকারি মায়ানমার নাগরিকদের ৪৬ ধরনের তথ্য নিয়ে তাদের ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। কৌশলগত কারণে প্রকৃত সংখ্যা পরবর্তীতে জানানো হবে।
খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আরআরআরসি’র বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত চাল খাদ্য বিভাগের গুদামে সংরক্ষণ করতে পারলে বিশেষ সুবিধা হতো।
আশ্রয়প্রার্থীদের প্রকৃত সংখ্যার ভিত্তিকে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবাইকে খাদ্য সহায়তা প্রদানে ডব্লিউএফপি’র (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি) সম্মতি পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ৬ লাখ ৭৩২ মেট্রিক টন চাল ছাড়াও তেল ও ডাল সরবরাহ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ৩৮১ দশমিক ৭০ মেট্রিক টন ডাল ও ১৯০, ৮৬৬ লিটার তেল সরবরাহ করেছে। ডব্লিওএফপি মোট ৫ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ জনকে (১ লাখ ১৩ হাজার ২২০টি পরিবার) খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। বাকি আশ্রয়প্রার্থীদের বিভিন্ন এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।
Posted ২:১৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta