কক্সবাংলা ডটকম(২৭ জুলাই) :: শেয়ারবাজারের টানা পতনে দিনকে দিন পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। সবচেয়ে বড় কারসাজির চক্রের হোতাদের (গ্যাম্বলার) সহায়তায় শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকানোর চেষ্টা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। গত সোমবার শীর্ষ গ্যাম্বলারদের সঙ্গে বৈঠকের দিন পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে বেড়েছিল শেয়ারদর ও সূচক। কিন্তু তা দুইদিনও টিকল না।
আজ প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রথম দেড় ঘণ্টার লেনদেন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর মাত্র ২ মিনিটে প্রধান মূল্য সূচক ৭ পয়েন্ট বেড়ে ৬১২০ পয়েন্টে উঠেছিল। এর ২৩ মিনিট পর ১০টা ২৫ মিনিটে আগের অবস্থান থেকে ৬১ পয়েন্ট (গতকালের তুলনায় ৫৩ পয়েন্ট) হারিয়ে ৬০৫৯ পয়েন্টে নামে।
লেনদেনের প্রথম দেড় ঘণ্টা শেষে সকাল সাড়ে ১১টায় সূচকটি গতকালের তুলনায় ৫২ পয়েন্ট হারিয়ে ৬০৫৯ পয়েন্টে অবস্থান করতে দেখা গেছে। এ সময় মাত্র ৬০ শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দরবৃদ্ধির বিপরীতে ২৮২টি দর হারিয়ে কেনাবেচা হতে দেখা যায়। দর অপরিবর্তিত অবস্থায় কেনাবেচা হচ্ছিল ৩৬ শেয়ার। প্রথম দেড় ঘণ্টায় ২৬১ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়।
এর আগে টানা নয়দিনে ডিএসইএক্স সূচক ৩৪০ পয়েন্ট হারানোর পরও গত সোমবার সকালে দশম দিনেও বড় দরপতন দিয়ে লেনদেন শুরু হয়েছিল। প্রথম ঘণ্টার দরপতনে সূচক হারিয়েছিল ৬৭ পয়েন্ট। কিন্তু ওই অবস্থা থেকে ৩০ পয়েন্ট বৃদ্ধি দিয়ে দিনের লেনদেন শেষ হয়েছিল।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, নাটকীয় ওই পরিবর্তনের নেপথ্যে ছিল ওইদিন শীর্ষ গ্যাম্বলারদের সঙ্গে বিএসইসির বৈঠকের খবর।
পরদিন গত মঙ্গলবার সিংহভাগ শেয়ারের দরবৃদ্ধির কারণে সোয়া এক ঘণ্টায় সূচক বৃদ্ধিতে সেঞ্চুরি হয়েছিল। বেড়েছিল ১০৩ পয়েন্ট। কিন্তু এর পর অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে থাকলে সূচকও নিম্নমুখী হয়। লেনদেন শেষ হয় সূচকের ২৯ পয়েন্ট বৃদ্ধি দিয়ে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে লাগাতার দরপতনে সময় শীর্ষ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক বা তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক করে বিনিয়োগের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি করণীয় নির্ধারণে পরামর্শ নিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
এবারই প্রথম সবাইকে অবাক করে ব্যক্তি শ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের নাম করে শীর্ষ গ্যাম্বলারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএসইসি। বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আবুল খায়ের হিরো, মিজান, সাইফুল্লাহ, বিশ্বজিত, আবু সায়েমসহ বেশ কয়েকজন অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।
বিষয়টি এমন যে, দেশের আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠক করলে যেমনটি দাঁড়াবে গ্যাম্বলারদের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠকটি তেমনই।
যাদের নিয়ে কমিশন বৈঠক করেছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কারসাজির অভিযোগ আছে। এর আগে কমিশন জরিমানা করেছে হিরো সরকারি কর্মকর্তা। অভ্যাসগতভাবে শেয়ার কেনাবেচা করার বিষয়ে তার ওপর সরকারি বিধি-নিষেধ আছে। কিন্তু গত দুই বছরে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বড় গ্যাম্বলার সে। এক মাসেরও কম সময় আগে, তাকে বাদ দিয়ে তার স্ত্রী ও নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান নামমাত্র জরিমানা করেছিল বিএসইসি। সায়েম ২০০৯-২০১০ সালের কারসাজির বড় হোতা- সে সময় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তার নাম আছে।
শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা বলেন, ‘বড় বিনিয়োগকারী’র নাম করে আসলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘গ্যাম্বলার’ দের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ বাজারকে এ বার্তা দিয়েছে যে, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার গ্যাম্বলারদের বাজার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের সঙ্গে আছে।
তিনি বলেন, ওই বৈঠক দিয়ে কিছু অনলাইন পোর্টালে খবরে পড়েছি- ওই গ্যাম্বলাররা দাবি করেছেন, তাদের ভুল-ত্রুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেনো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। এ কথার অর্থ হলো- তারা শেয়ার কারসাজি করলে সংস্থাটি তা নিয়ে যেনো প্রশ্ন না তোলে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়। এমনটি হলে এখানে প্রকৃত কোনো বিনিয়োগকারী কেনো বিনিয়োগ করতে আসবেন- প্রশ্ন তাদের।
এদিকে, বুধবার ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমার বাইরে বন্ডের বিনিয়োগ রাখা এবং কস্ট প্রাইজে বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জে কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত উল ইসলাম বুধবার বলেছিলেন, এখন থেকে বন্ডের বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের এই সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন।
অপরদিকে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষা করতে আগামী রোববার থেকে ফ্লোর প্রাইস দিতে দাবী করা হচ্ছে। যদি ফ্লোর প্রাইস না দেওয়া হয়, তাহলে সোমবার থেকে সারা দেশের বিনিয়োগকারীদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ কে এম মিজান উর রশিদ চৌধুরী।
বুধবার (২৭ জুলাই) স্যোসাল মিডিয়ায় এক ভিডিও বার্তায় তিনি এই ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, বাজারের এমন পরিস্থিতি দেখার মতো কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে বলে আমরা মনে করি না। বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। মার্জিন ঋণের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারগুলো হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাজারের এই ক্রান্তিকালে আমি সকল বিনিয়োগকারীদের আহবান করবো আপনারা আপনাদের শেয়ার বিক্রি করবেন না।
মিজান উর রশিদ কয়েকটি দাবি উল্লেখ করে বলেন, আগামী রোববারের মধ্যে ফ্লোর প্রাইস দিতে হবে। সাথে সাথে এসএমই মার্কেটকে বন্ধ করতে হবে। আর বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পযন্ত আগামী দুই বছর সকল প্রকার আইপিও বন্ধ রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আস্থা রেখে বিনিয়োগের জন্য বাজারে ৭০-৮০টি কোম্পানি ছাড়া এখন কোন শেয়ারই নেই। তাই আপনারা বুঝে শুনে বিনিয়োগ করবেন। কোন প্রকার মার্জিন ঋণ নিয়ে আর বিনিয়োগ করবেন না। কারণ মার্জিণ ঋণের কারণে বাজার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার থেকে স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে মূল শেয়ারবাজারে অন্তত ৩০ লাখ টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে।
বুধবার নিয়মিত কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
মূল শেয়ারবাজারে যখন ব্যাপক দরপতন চলছে, তখন এসএমই বোর্ডের গুটিকয় শেয়ারের অস্বাভাবিক উত্থানের প্রেক্ষাপটে সমালোচনা পড়ে এ নিয়ম করেছে সংস্থাটি।এর আগে সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে কারো বিনিয়োগ মূল্য ২০ লাখ টাকা থাকলেই সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারতেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, এ নিয়ম বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে। যাদের ইতিপূর্বে এ বাজারে কোনো বিনিয়োগ ছিল না, প্রথমে তাদের জন্য এ নিয়ম কার্যকর হবে।
তবে যারা বুধবার বা তার আগে বিনিয়োগ করেছেন, তারা আগামী তিন মাস কেনাবেচার সুযোগ পাবেন। এরপর এ বাজার থেকে শেয়ার কিনতে হলে মূল শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ মূল্য ৩০ লাখ টাকায় উন্নীত না করে সে সুযোগ পাবেন না। তবে তখনও তার বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার থাকলে বিক্রি করতে পারবেন।
স্বল্প মূলধনী কোম্পানির পৃথক শেয়ারবাজার গড়তে ২০১৯ সালের ৩০ জুন ‘কোয়ালিফাইড ইনভেস্টরস অফার বাই স্মল ক্যাপিটাল কোম্পানিজ ২০১৮’ নামে বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করেছিল বিএসইসি।
শুরুতে ওই বিধিমালা অনুযায়ি, এসএমইর শেয়ারবাজারের ঝুঁকি বিবেচনায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের এ বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করা হয়। নিয়ম করা হয়- মূল বাজারে এক কোটি টাকার কম বিনিয়োগ থাকলে কেবল এ বাজারে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ থাকবে। এবং আগে থেকে যোগ্য বিনিয়োগকারী হিসেবে নিবন্ধন নিতে হবে। এর মূল বাজারে এর কম বিনিয়োগ নিয়ে কেউ এসএমইর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না।
বাজারটি চালুর পর বর্তমান কমিশন প্রথমে তা ৫০ লাখ টাকায় এবং গত ফেব্রুয়ারিতে ২০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনে। উদ্দেশ্য ছিল এ বাজারে বেশি সংখ্যক বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া।
এ নিয়মের পর গত মার্চের পর হু হু করে এসএমই বোর্ডের শেয়ারগুলোর দর বাড়তে থাকে। মাত্র সাড়ে চার মাসে এ বাজারের মূল্য সূচক ডিএসএমইএপ ৫৯৩ পয়েন্ট থেকে ২১০০ পয়েন্ট ছাড়িয়েছিল। যদিও একই সময়ে মূল শেয়ারবাজার সূচক ডিএসইএপ ৬৮০০ পয়েন্ট থেকে ৬০০০ পয়েন্টের নিচে নামে।
Posted ১০:০২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta