কক্সবাংলা ডটকম(২৬ জুন) :: ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের সব স্তরের মানুষের মনে এক ধরণের আশার সঞ্চার করেছেন। যা দেশের অর্থনীতির জন্য অবিশ্বরণীয় এক মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরাও একইভাবে আশার স্বপ্ন বুনেছিল,২৬ জুন পুঁজিবাজারে শতাব্দীর সাড়া জাগানো পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু তা হয়নি। আজও উল্টোপথেই হেঁটেছে দেশের পুঁজিবাজার। আমাদের পুঁজিবাজার যে কোন নিয়মে চলে না, তা আরেকবার প্রমাণ হল।
উল্টো টানা ষষ্ঠ দিন কমল লেনদেন। সেটি নেমে এলো ছয় শ কোটির নিচে। গত ২৬ মের পর ২০ কর্মদিবসে কখনও এত কম লেনদেন হয়নি। এমন দিনে সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে ছয়টিই লোকসানি। আবার দরপতনের মধ্য দিয়ে সপ্তাহ শুরু হলো পুঁজিবাজারে। টানা তিনটি সপ্তাহে এই প্রবণতা দেখা গেল। এদিন এমন কোনো খাত ছিল না, যেটি দরপতনের মধ্য দিয়ে যায়নি। এর মধ্যে গত দুই সপ্তাহের মতোই দুর্বল বা স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারে উল্লম্ফন দেখা যায়।
পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের ফলে বিনিয়োগকারীেদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ২০১০ সালের ধসের প্রায় ১২ বছর পরও স্থিতিশীল হয়নি দেশের পুঁজিবাজার। আইন সংশোধনসহ নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার পরেও এখনো একটি ভঙ্গুর বাজার হিসেবেই পারফর্ম করে আসছে। উল্টো দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। মূল্যসূচক কমছেই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। আজ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে গত এক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন।
মাঝখানে সময় সময় অল্পদিনের জন্য বাজারে স্থিতিশীলতার একটা আবহ দেখা গেলেও তা টেকসই হয়নি। পুঁজিবাজার যেন ধীরে ধীরে রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে। পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহল চরমভাবে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক, কেউই স্বস্তিতে নেই।
এদিকে বাজার বিশ্লেষনে দেখা গেছে, আগের দুই সপ্তাহের শুরুর দিন রোববার বড় বিনিয়োগকারীরা বড় বড় সেল প্রেসার দিয়ে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছেন। আজ তৃতীয় সপ্তাহেও দেখা গেল একই দৃশ্য। শুরুতে বাজার কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতায় থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা নেতিবাচক প্রবণতায় ফিরে আসে। এরপর পতন ধারাবাহিকভাবে গভীর হয়। সার্কিট ব্রেকারের প্রান্তসীমায় কোম্পানির সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আতঙ্ক তৈরি হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
স্টক অ্যান্ড বন্ডের বিনিয়োগকারী কাজী মাজহার হোসেন বলেন, গত ১২ বছর ধরে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের অপেক্ষা রয়েছি। আজও একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার পায়নি। গত জানুয়ারী মাসে নতুন করে পুঁজিবাজার ২২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। বর্তমানে আমার পুঁজি এসে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ টাকায়। এখন লাভ তো দুরের কথা পুঁজি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
আইসিবি সিকিউরিটিজের ট্রেডিং এর বিনিয়োগকারী আবদুল মতিন হাওলাদার বলেন, পুঁজিবাজার চলছে সিন্ডিকেট চক্রেরা জিম্মায়। তারা চাইলে বাজার উঠে, তারা চাইলে বাজার পতন হয়। দীর্ঘ এক বছরের কাছাকাছি ধরে বাজার দরপতন হচ্ছে। বার বার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আশার আলো দেখালে বাস্তবে আরো পুঁজি হারাচ্ছি। আমি গত ১২ বছর ধরে পুঁজিবাজারের সাথে জড়িত। কিন্তু একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার পায়নি। বর্তমান বাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র গড়ে উঠছে। এদের ইশারায় সব চলছে। ফলে এখন দুর্বল শেয়ারের রাজত্ব চলছে।
মশিউর সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী কেরামত হোসেন বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজার ক্যাসিনোকে হার মানিয়েছে। ভাল মৌল ভিত্তি শেয়ারের দাম না বাড়লেও দুর্বল শেয়ারের দাম ২ মাসের মাথায় ৫ গুনের বেশি বাড়ছে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরব আচরন করছেন।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বড় উত্থান হলেও রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন শেয়ারবাজারের প্রধান প্রধান সূচকই কমেছে। সূচকের সাথে টাকার পরিমাণে লেনদেন এবং অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দরও কমেছে। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ২৮২ কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে।
গতকাল শুরু হয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে। ফলে লেনদেন শুরু হতেই প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৭ পয়েন্ট বেড়ে যায়। আর লেনদেনের ১০ মিনিটের মাথায় সূচকটি বাড়ে ৪৫ পয়েন্ট। লেনদেনের শুরুতে সূচকের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিলেও প্রথম ঘণ্টার লেনদেন শেষে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের দরপতন হতে থাকে। লেনদেনের সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পতনের মাত্রা।
দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে ৬২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৮২টির এবং ৩৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। অবশ্য যে হারে বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে, সূচকের পতন হয়েছে তার থেকে কম হারে। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১৯ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৬ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ২ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ৩২৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ আগের দিনের তুলনায় ৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৯৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি বাজারটিতে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৮৯৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ১ হাজার ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ১৫০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ১১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ৪৬ কোটি ২০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৪৫ কোটি ২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে শাহিনপুকুর সিরামিক। লেনদেনের ভিত্তিতে (টাকায়) প্রধান ১০টি কো¤পানি হলো:- বেক্সিমকো লিঃ, বিএসসি, শাইনপুকুর সিরামিকস, আরএকে সিরামিকস, সাইফ পাওয়ার, জেএমআই হাসপাতাল, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, আইপিডিসি, ফু-ওয়াং ফুড ও ওরিয়ন ফার্মা।
দর বৃদ্ধির শীর্ষে প্রধান ১০টি কো¤পানি হলো:- মেঘনা ইন্স্যুরেন্স, সিনোবাংলা ইন্ডা., আল-হাজ্বটেক্স, পিটিএল, বিএসসি, ঢাকা ডাইং, এইচআর টেক্স, হাক্কানী পাল্প, আইএসএন লি. ও ইনটেক লি.। দর কমার শীর্ষে প্রধান ১০টি কো¤পানি হলো- সিএপিএম আইবিবিএল মি. ফা., মেঘনা কন্ডেন্সড মিল্ক, ন্যাশনাল পলিমার, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, সিলভা ফার্মা, নাহী অ্যালুমিনিয়াম, ইউনিক হোটেল, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সোনারগাঁও টেক্সটাইল।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ২৯ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি ১৮ টাকা। লেনদেন অংশ নেওয়া ২৯৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৯৬টির এবং ৩৪টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
Posted ১১:১৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৬ জুন ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta