কক্সবাংলা সম্পাদকীয়(১৯ অক্টোবর) :: দুর্গাপূজাকে ঘিরে লাগাতার কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের মন্দির-পূজামন্ডপ-ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একের পর এক যে হামলা চলছে তাতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নতুন এক ভয়াল রূপ প্রত্যক্ষ করছে দেশবাসী। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ঠিক এমনটা আর কখনো দেখা যায়নি। ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়ানো এবং উসকানির ধরন একই হলেও একের পর এক জেলায় এবার যেভাবে সংগঠিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে বিগত দশকগুলোতে এমন হামলা এভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। ১৩ অক্টোবর বুধবার কুমিল্লার নানুয়া দীঘি থেকে যে হামলা শুরু হলো সেটা রবিবার পীরগঞ্জের ভয়াবহ তান্ডবের পরও থামেনি। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় ২০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের আগেও ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার সেই পুরনো অপকৌশলই ব্যবহার করা হয়েছে। একদিকে, দেশব্যাপী লাগাতার এমন সংগঠিত হামলায় যেমন প্রশ্ন উঠছে এসব হামলার নেপথ্যে কারা জড়িত; তেমনি অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও হামলা মোকাবিলায় পুলিশ ও প্রশাসনের গাফিলতি, নিষ্ক্রিয়তা কিংবা ব্যর্থতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে নাগরিক সমাজে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারাও তাদের আস্থাহীনতার কথা জানিয়েছেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠেই। এতসব হতাশা আর ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যেও আশার কথা হলো, দেশের মানুষ এখন এই বীভৎস সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সক্রিয় হয়েছেন, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন।
সোমবার রাজধানীর শাহবাগে বিপুল জমায়েতের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের মন্দির-পূজামন্ডপ-ঘরবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন হাজারো মানুষ। এর আগে চট্টগ্রামেও হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো হিন্দুদের ওপর হামলা-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোতে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় উসকানি ও মদদদাতা হিসেবে বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নামও এসেছে। আবার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের কথাও শোনা যাচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত দুর্গা পুজোর ঘটনা এবং তার জেরে একের পর এক যা ঘটছে কি বলা যায় তাকে-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা? দাঙ্গায় তো দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ থাকে। একে দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন বলাই বোধহয় বেশি সঙ্গত। সাম্প্রদায়িক উস্কানির আগুনে ঘি ঢেলে মাঝ থেকে লাভবান হতে চায় একটি পক্ষ। সেই যে ব্রিটিশরা ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বীজ বুনে সযত্ম পরিচর্যায় মহীরুহ করে তার ফল ভোগ করে উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছিল এ অঞ্চলের দু’সম্প্রদায়ের ঘাড়ে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আজও মাঝে মাঝেই তা তীব্র ব্যথার ক্ষত তৈরি করে, নাড়িয়ে দেয় সুস্থ চিন্তাকে। এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাস্তবতা গ্রহণযোগ্যতা হারালেও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের ধারাবাহিকতা সমানভাবেই অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
একটা সময় নসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লীলাভূমি ছিল বাংলাদেশ। যুগ যুগ ধরে এই দেশে সকল ধর্মের মানুষ এক সমাজে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাসও করছে। ধর্মীয় দিবসগুলো পালিত হয়েছে সামাজিক উৎসব হিসেবে। এখানে ধর্মীয় পরিচয়ে মানুষের মূল্যায়ন হয় না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সকল ধর্মের মানুষকে বিচার করা হয় সমান দৃষ্টিতে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত আওয়ামী লীগ এই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
কিন্তু গত ১০ বছরে নানা অজুহাতে রামু,নাসিমনগর ও সর্বশেষ কুমিল্লাসহ সারাদেশে সংখ্যালঘুদের মন্দির,ঘরবাড়িতে হামলা,ভাংচুর ও নির্যাতন পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। একশ্রেণীর সুবিধাবাদী লোক কখনও রাজনৈতিক কারণে, আবার কখনও নিজের স্বার্থ হাসিল করার লক্ষ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এই যে ধর্মীয় উৎপীড়ন, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস, ধর্মের নানা মাত্রার অপব্যবহার সব কিছুর পেছনেই রয়েছে আধিপত্য বিস্তারের খেলা।
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক কারণে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস শুরু করে। সেসময়ের ৩ হাজারের অধিক মামলা এখনো শুরুই করা যায়নি।রামুর বৌদ্ধ বিহার,ভোলা ও নাসিম নগরেরর মামলারও একই অবস্থা।এতেই বোঝা যায় ভোটের রাজনীতি আর স্বার্থ হাসিলে সংখ্যালঘুরা বিএনপি-আওয়ামীলীগের খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। বাংলার মাটি থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উৎখাত করতে পারলেই যেন লাভবান হবে তারা।খুশি করা যাবে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠিকে।
এবার পবিত্র কোরান অবমাননার অভিযোগে প্রথমে কুমিল্লা এবং পরে রংপুরে ঘটেছে সেই ঘৃণ্য ঘটনা। এর জের ধরে দেশের ১১টি জেলায় হামলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ঘরবাড়িতে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এসব অপচেষ্টা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কোন সম্প্রদায়ের লোক অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ এনে অপমান করবে, এ ধরনের মানসিকতা বাংলাদেশের মানুষের নেই।’ এর আগেও কক্সবাজারের রামু, ভোলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ঘটেছে এমন ঘটনা।
এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করেছে। গ্রেফতার করেছে অনেক লোক। মামলাও হয়েছে। এবারের ঘটনার পর অভিযোগ উঠেছে, ইতোপূর্বে সঙ্ঘটিত ঘটনায় এখন পর্যন্ত কারও শাস্তি হয়নি। এ কারণে দুর্বৃত্তরা আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনায় সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব দুর্বৃত্তকে কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধীদের ধরতে চলছে ব্যাপক অভিযান। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে অনেক। সরকার মনে করছে, এসব ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। গ্রেফতারকৃতদের অনেককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে হামলার নেপথ্যের নেতৃত্বদানকারী ও উস্কানিদাতাদের নাম বলেছে অনেকে। জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম এসেছে তাদের খুঁজছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কমকর্তাদের রদবদল করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা ঘটনার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। শীঘ্রই প্রমাণ পেয়ে যাব। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ দেশবাসীর প্রত্যাশাও তাই। যারা এসব ঘৃণ্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হোক। দৃষ্টান্তমৃলক শাস্তিই পারে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রুখতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য সরকারকে কঠোর থেকে কঠোরতম হতে হবে।অসম সমাজ ব্যবস্থায় এমন হওয়াই স্বাভাবিক।
Posted ৩:২৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২০ অক্টোবর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta