কক্সবাংলা ডটকম(২০ অক্টোবর) :: কুমিল্লার পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনার সাত দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ফেনী, বান্দরবানসহ দেশের আরও কিছু এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে। সর্বশেষ রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে ঘটে আরেক বর্বরতা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু অধ্যুষিত জেলেপল্লি। সহিংসতা থামাতে তৎপর প্রশাসন।
চলছে মামলা, গ্রেপ্তার ও তদন্ত। সরকারের শীর্ষ মহল ঘটনার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করছে। সরকারের শরিক দলগুলোর ইঙ্গিতও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির দিকে। তবে বিএনপি এ জন্য দোষারোপ করছে সরকারকেই।
পাল্টাপাল্টি দোষারোপের মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সরকারি দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা লোক হামলায় ছিল বলে অভিযোগ করেছেন। এ অবস্থায় পুলিশ, হামলার শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী এবং রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে কিছু তথ্য।
দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় পুলিশের মামলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম না থাকলেও বান্দরবানে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে পুলিশের মামলায় বিএনপি ও জামায়াত কর্মীদের নাম রয়েছে। কুমিল্লায় হামলার ঘটনায় পুলিশ জামায়াত সমর্থিত তিন কাউন্সিলর ও দুই যুবদল নেতার নাম পেয়েছে। চৌমুহনীতে কোনো রাজনৈতিক নেতার হামলায় জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। রংপুরের পীরগঞ্জে ‘চেনা মানুষরা’ হামলা করেছে বলে স্থানীয়রা জানালেও কেউ হামলাকারীদের পরিচয় প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বেশকিছু এলাকায় হামলাকারীদের মধ্যে অন্য এলাকার লোকজন থাকার তথ্য পাওয়া গেছে; যাদের চিনতে না পারার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো যেত।
লামায় আ’লীগ-বিএনপি নেতাদের দিকে ইঙ্গিত : বান্দরবানে হামলার পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও বিএনপি, জামায়াত ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কিছু নেতার ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্থানীয় নেতারা। কুমিলল্গায় কোরআন অবমাননার অভিযোগে লামা উপজেলা বাজারে কোর্ট জামে
মসজিদের ইমাম মাওলানা আজিজুল হকের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অন্যদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম এবং লামা বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. ইব্রাহিম বক্তব্য রাখেন। পরে শত শত মানুষ উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিতে দিতে লামা কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরের দিকে যায়। পুলিশের বাধা ভেঙে মন্দিরে হামলা চালায় উত্তেজিত জনতা। হরি মন্দিরে হামলা-ভাঙচুরের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
লামা কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরের সভাপতি প্রশান্ত ভট্টাচার্য বলেন, গত রোববার সন্ধ্যায় তিনি নিজে বাদী হয়ে ৯৪ জনের নাম উল্লেখ করে লামা থানায় মামলা করেছেন। মামলা করে আতঙ্কে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, মামলা করার কারণে আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, কুমিলল্গার ঘটনার পরদিন লামায় শত শত মুসল্লি কীভাবে জড়ো হলো? কারা এদের ডেকে এনে জড়ো করল? ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত না থাকলে বিএনপি-জামায়াত সাহস পেত না।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম বলেন, সেদিনের ঘটনায় আমি নিজে দাঁড়িয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি। নিজেও হামলার শিকার হয়েছি।
লামা থানার ওসি (তদন্ত) মো. আলমগীর জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুমিল্লায় জামায়াত-যুবদল নেতা আসামি : কুমিলায় পূজামণ্ডপে সহিংসতা ও ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ঘটনায় এ পর্যন্ত জেলার তিন থানায় পুলিশ বাদী হয়ে আটটি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলায় ৯২ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার মামলায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন, তার ভাই সাখায়াত হোসেন ও তার অনুসারী আরও ছয়জনকে আসামি করা হয়। একই থানার আরেকটি মামলায় কুসিকের ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরাম হোসেন বাবু, ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম কিবরিয়া এবং জামায়াতের অঙ্গসংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আসামি করা হয়। তবে তাদের কেউ এখনও গ্রেপ্তার হননি। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার মামলায় ২৩নং ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলী ও পৌর যুবদলের সভাপতি মিজানুর রহমানসহ যুবদলের আরও তিন কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে আসামি বিএনপি নেতার ছেলে : চট্টগ্রামের জেএমসেন হল পূজামণ্ডপে হামলা মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে ইমরান মাজেদ রাহুলকে। তার বাবা মো. ইলিয়াছ চট্টগ্রাম মহানগরের দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি। তার চাচা মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান।মণ্ডপে হামলার পর রাহুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পূজামণ্ডপে হামলার মিছিলে বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদের (ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরুর দল) চট্টগ্রাম মহানগর সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমানকেও নেতৃত্ব দিতে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, আমার ভাইপো রাহুলের অপরাধের দায়িত্ব আমরা কেউ নেব না।
নগরীর কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, জেএমসেন হলের পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধন ও উসকানি ছিল। ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানা গেছে, নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকার মো. হানিফ, রিয়াজ উদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটের আবদুর রহিম ও চন্দনাইশের হাশিমপুর এলাকার সায়দাবাদ গ্রামের এসএম ইউসুফও নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিল ও হামলায়। মহানগরের এ হামলার ঘটনায় ৯ শিশু ও কিশোর জড়িত ছিল। তবে খলিফাপট্টি এলাকার কিছু হকার্স লীগ সমর্থকও এ মামলায় জড়িত বলে খবর পাওয়া গেছে। হামলার ঘটনায় জড়িতদের বেশিরভাগই টেরিবাজার, রিয়াজ উদ্দিন বাজার ও খলিফাপট্টি এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। যাদের বাড়ি সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী এলাকায়।
পুলিশ জানায়, টেরিবাজারের ব্যবসায়ী ইমরান মাজেদ ও হানিফের নেতৃত্বে নামাজ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। অন্যদিকে জেলার সাতকানিয়া উপজেলায় পূজামণ্ডপের অস্থায়ী তোরণ ভাঙচুরের মামলার আসামিদের মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির জাফর সাদেক, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের নাম রয়েছে। তারা ছাড়া আসামির তালিকায় আছেন সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আবুল ফয়েজ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোজাফ্ফর আহমদ, সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের বর্তমান আমির মাওলানা কামাল উদ্দিন, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান।
হাজীগঞ্জে ছাত্রদল-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ : ১৩ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে হাজীগঞ্জ পৌরসভার রান্ধুনীমুড়া গ্রাম থেকে ৩০-৪০ জন শিশু-কিশোরের একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজার থেকে পূর্ববাজার ঘুরে মসজিদের সামনে এলে সেখানে আরও কিছু লোক যুক্ত হয়। হাজীগঞ্জ পৌরসভার রান্ধুনীমুড়ার বাসিন্দা মুন্সী মোহাম্মদ মনির বলেন, সাবেক কমিশনার খোরশেদ আলম ভুট্টু, ইউছুফ, সাবেক মেম্বার শফিক, ছাত্রদলের সফিক ও শিবিরের কয়েকজন মিছিলে নেতৃত্ব দেন। প্রথমে আমার গ্রাম থেকে মিছিল বের হয়। শিশু-কিশোরদের স্থানীয় ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের ছেলেরা তাদের বাড়ি থেকে নানা কৌশলে বের করে নেয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রামের শিশু-কিশোরদের মিছিল বাজারে গেলে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদে এশার নামাজ শেষে সেখানে কিছু মুসল্লি ঢুকে যায়। পরে তারা পূজামণ্ডপ ও পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়।
রান্ধুনীমুড়া গ্রামের নিহত হৃদয়ের বাবা ফজলুল হক বলেন, ‘আমার ছেলেকে সুকৌশলে বাড়ি থেকে নেওয়া হয়েছে। যারা নিয়েছে আমি তাদের সবাইকে চিনি। আমি মুখ খুললে আমার অসুবিধা হবে। তাই আমি চুুপ রয়েছি।’
চৌমুহনীতে হামলায় কওমি শিক্ষার্থী :নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী। চৌমুহনী শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা হিন্দু অধ্যুষিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন জানান, চৌমুহনীর কলেজ রোডের পূজামণ্ডপে হামলার অগ্রভাগে ছিল কওমি মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। ওই এলাকায় বেশকিছু কাওমি মাদ্রাসা রয়েছে। কলেজ রোড, আলীপুর ও ব্যাংক রোডের আটটি মন্দিরে হামলার ঘটনায় একই ব্যক্তিরা জড়িত বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এসব হামলার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফেনীতে সহিংসতার নেপথ্যে : গত শনিবার ফেনীতে সহিংসতায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের উপস্থিতি দেখেছে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় পুলিশ দুটি মামলা দায়ের ও ছয় কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনার সূত্রপাতের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ফেনী পৌর এলাকা থেকে হঠাৎ যুবলীগের একটি মিছিল বের হয়। বিকেল ৩টায় হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন হওয়ার কথা ছিল। তবে তারা সময় পিছিয়ে আসর নামাজের পর কর্মসূচি শুরু করে। এ সময় মুসল্লিদের প্রতিবাদ মিছিলও শুরু হয়। তিনটি সংগঠনের কর্মসূচি ট্রাঙ্ক রোডে মুখোমুখি হওয়ায় উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে সেই উত্তেজেনা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এটিকে পূর্বপরিকল্পিত বলছেন অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, হামলার সময় ব্যবসায়ীরা বারবার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম, ১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মানিক ও ১৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমির হোসেন বাহারের কাছে সাহায্য চেয়ে টেলিফোন করেন। কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেননি।
সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ তৌফিক মাহমুদ লাবিব (২২) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। র্যাব জানায়, লাবিব তার সঙ্গে থাকা মুন্না ও সফী নামের দু’জনের নাম বলেছে। এরা সবাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং রামপুর পুলিশ কোয়ার্টার এলাকার যুবলীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
Posted ৪:০২ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২০ অক্টোবর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta