কক্সবাংলা ডটকম(১৮ অক্টোবর) :: দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্ডপে, মন্দিরে হামলার ঘটনা তদন্তে নেমেছে পুলিশ। পুলিশের সবকটি সংস্থাই অভিযানের পর অভিযান চালাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত বুধবার থেকে দেশের ১০ জেলায় পূজামণ্ডপ, মন্দিরসহ হিন্দুদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ঘটনায় ২৮টি মামলায় অজ্ঞাতসহ ৯ হাজার ৫২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এ পর্যন্ত ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির কয়েকজন নেতাও আছেন।
কুমিল্লার ঘটনার পর দফায় দফায় বৈঠক করছেন পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের হাইকমান্ডও বৈঠকে বসেছে। রবিবারও পুলিশ সদর দপ্তরে বৈঠক করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এসব হামলার সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে পুলিশের সবকটি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশি তদন্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় সম্পৃক্তদের বিষয়ে বিশদ তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। প্রতিমা ভাঙচুরের উসকানিদাতা ও হামলায় জড়িত শতাধিক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে পুলিশসহ গোয়েন্দারা।
তাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একাধিক নেতার নাম উঠে এসেছে। পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ইন্ধন দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
গুজব রটানোর অভিযোগে ২০০ ফেইসবুক অ্যাডমিনের প্রোফাইল কালো তালিকাভুক্ত করেছে পুলিশ। তাদেরও আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এমনকি কয়েকজনের মোবাইলের ভয়েস বার্তাও পেয়েছে পুলিশ। বার্তায় কেউ কেউ হামলা করার কথাও বলতে শোনা গেছে বলে তদন্তকারী সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, তালিকাভুক্ত উসকানিদাতা ও হামলাকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য দেশের সবকটি বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ। তাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করতে বারণ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন, পুজামন্ডপে হামলার ঘটনায় প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। যারা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বা উসকানি দিয়েছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এজন্য পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করছে। বিভিন্ন স্থানে হামলার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। অসাম্প্রদায়িকতা নষ্ট করার জন্যই একটি মহল এসব অপকর্ম করেছে। তদন্ত করে শিগগিরই দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি খুব সিরিয়াসলি দেখছেন। আমরা একটি নির্ভুল তদন্তের মাধ্যমে শিগগিরই সুখবর দিতে পারব। আমরা মনে করি, আমাদের দেশের লোক ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
কুমিল্লায় একটি পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনার জের ধরে গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামন্ডপে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ শনিবার রাতে ফেনীতে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত ৩৫টি পূজামন্ডপে হামলা করে মূর্তি ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা।
মন্ডপে হামলার প্রতিরোধ করতে গিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পাঁচজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সরকারের হাইকমান্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক করেন কর্তাব্যক্তিরা।
হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের ধরতে পুলিশের সবকটি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশের সবকটি রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার ও মেট্রো পুলিশ কমিশনাররা আলাদাভাবে বৈঠক করে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা পাঠান থানার ওসিদের কাছে। পাশাপাশি সবকটি গোয়েন্দা সংস্থাও মাঠে নামে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, হামলার আশপাশে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিমা ভাঙচুরে যারা যারা অংশ নিয়েছিল তা ওইসব ফুটেজে ফুটে উঠেছে। তাছাড়া আড়ালে থেকে যারা উসকানি দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। আর যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তার সংখ্যা শতাধিক হবে। ইতিমধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একাধিক নেতার নাম রয়েছে। পাশাপাশি শাসক দলের কিছু নেতা ইন্ধন দিয়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাদেরও নাম পাওয়া গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০০ ফেইসবুক অ্যাডমিনের প্রোফাইল কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন বলেন, যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। একটি মহল শান্ত পরিবেশ অশান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তাদের আশা পূরণ হবে না। প্রতিমা ভাঙচুর ও হামলার সঙ্গে যারা জড়িত আছে তাদের ধরতে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক হামলাকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের পাওড়াও করা সম্ভব হবে।
কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, যারা পূজামন্ডপে হামলা করেছে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করা হবে। যারা মন্ডপে কোরআন শরিফ রেখে গেছে তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে বাড়তি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে উসকানিদাতা ও হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
গত বুধবার সকালে কুমিল্লা কোতোয়ালির নানুয়া দীঘির উত্তরপাড় জনসংঘ পূজামণ্ডপে কে বা কারা পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে যায়। এ ঘটনার পর শহরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে চারজন পুলিশ সদস্য আহত হন।
চাঁদপুর জেলা পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, বুধবার রাতে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ত্রিনয়নী সংঘ শ্রী শ্রী রাজলক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া পূজামণ্ডপে ৫০০-৬০০ দুষ্কৃতকারী হামলা চালায়। হামলায় ১৫ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মক জখম হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি করতে বাধ্য হয় পুলিশ। এতে চারজন মারা যান।
তিনি আরও বলেন, যারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই ফুটেজে দেখা গেছে, হামলাকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের শ্রী শ্রী মা কালীমন্দিরে ১০০-১৫০ লোক হামলা চালায়। হামলাকারীরা একটি প্রতিমা ভেঙে ফেলে।
তাছাড়া গন্ডামারা, বাংলাবাজার ব্রিজ, চান্দনাইশ, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, পটিয়া এবং বোয়ালখালীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হামলা-ভাঙচুর এবং বিক্ষোভ মিছিলের ঘটনা ঘটে। কক্সবাজারের পেকুয়া কেন্দ্রীয় সার্বজনীন দুর্গামন্দির বিশ্বাসপাড়ায়ও হামলার ঘটনা ঘটে। ৩০০-৪০০ দুষ্কৃতকারী হামলা করে মন্দিরের প্রধান গেট ভাঙচুর করে আগুন জ¦ালিয়ে দেয়। বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানান, কুমিল্লার ঘটনার পর কিছু স্থানে হামলার চেষ্টা করা হয়। তবে বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ। হামলার সঙ্গে যারা জড়িত আছে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামন্ডপে হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রায় শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্তকারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। হামলা ও সংঘাতের ঘটনার নেপথ্যে থেকে যারা মূল ভূমিকা পালন করেছে, তাদের শনাক্ত করতে কাজ চলছে।
তিনি আরও বলেন, ফেইসবুক ও ইউটিউবে ভুল তথ্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে ২০০ অ্যাডমিনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ে সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। আমাদের পাশাপাশি সিআইডিসহ আরও বেশ কয়েকটি সংস্থা এসব ঘটনার তদন্ত করছে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের মধ্যে কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রামে সংখ্যা বেশি। বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা ইন্ধন দিয়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তারা যেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন সেই জন্য দেশের সবকটি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত এলাকায় বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া তাদের ধরতে দফায় দফায় অভিযান চালানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, তাছাড়া যেসব ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কুমিল্লার ঘটনার রেশ দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে, তাদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণাদি যাচাই শেষে শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনার রেশ আরও কয়েক দিন থাকতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। তবে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। শান্ত পরিবেশকে যারা অশান্ত করার চেষ্টা চালচ্ছে তাদের কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হবে। পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ইউনিটগুলোকে বলা হয়েছে, হামলাকারীদের ঠেকানো ও শনাক্ত করতে প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সহায়তা নিতে।
১০ জেলায় ২৮ মামলায় আসামি সাড়ে ৯ হাজার
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত বুধবার থেকে দেশের ১০ জেলায় পূজামণ্ডপ, মন্দিরসহ হিন্দুদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ঘটনায় ২৮টি মামলায় অজ্ঞাতসহ ৯ হাজার ৫২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এ পর্যন্ত ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির কয়েকজন নেতাও আছেন।
ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে থানা-পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য পেয়েছেন।
গত শনিবার সন্ধ্যায় ফেনী শহরে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। একটি মামলায় ২০০-২৫০ জন এবং অপর মামলায় ১০০-১৫০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন জানান, পৃথক দুটি মামলায় প্রায় ৪০০ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। রোববার বিকেল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ায় মন্দির ও বসতঘরে দুই দিন ধরে চলা হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় থানায় গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ছয়টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ২৯৩ জনকে।
আসামির তালিকায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতার অনুসারী ছাড়াও জামায়াত-শিবিরের সমর্থকদের নাম রয়েছে। একাধিক মামলার বাদী অভিযোগ করেছেন, হামলাকারী হিসেবে তাঁরা যাঁদের নাম দিয়েছেন, তাঁদের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দেওয়া নামই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে হাতিয়া থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাদীরা লিখিত অভিযোগ থানায় জমা দিয়েছেন। বাদীর দেওয়া অভিযোগই মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে গত বুধবার রাতে বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২ হাজার ৯৫০ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ বুধবার রাতে সাতজন ও শনিবার রাতে আটজনকে গ্রেপ্তার দেখায়।
এদিকে এসব হামলার ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নাসির উদ্দিন সারোয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন জেলা প্রশাসক। আর চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কুমিল্লা নগরে উত্তেজিত জনতার বিক্ষোভ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপে অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাঙচুর এবং ফেসবুকে উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশ চারটি ও র্যাব বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। এসব মামলায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের জামায়াতের ৩ কাউন্সিলরসহ এজাহারনামীয় ৬২ জন ও অজ্ঞাতনামা আসামি আছেন ৫০০ জন। এর মধ্যে পুলিশ ৩৯ জনকে ও র্যাব একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এদিকে নানুয়াদিঘির পাড়ে বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা, আগুন দেওয়া, ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসন একটি ও জেলা পুলিশ প্রশাসন আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কারা এই কাজ করেছে, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় পূজামণ্ডপে হামলা ও তোরণ ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১ হাজার ৩০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামিদের মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির জাফর সাদেক, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ রয়েছে।
এসব মামলায় গতকাল পর্যন্ত ৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত ও আসামি করা হয়েছে বলে জানান কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন।
সিলেট নগরের দুটি পূজামণ্ডপে গত শুক্রবার দুপুরে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০-২৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। এ ঘটনায় পুলিশ শনিবার দিবাগত রাতে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলার বাদী জালালাবাদ থানার এসআই কাজী জামাল।
সিলেটের জকিগঞ্জের কালীগঞ্জ বাজারে বুধবার রাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর এবং হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছিল। পুলিশ তিনজনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় গতকাল ভোরে কালীগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিনটি মন্দিরে ভাঙচুর ও দুটি মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। হামলায় আরও তিনটি মন্দির আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
উলিপুর থানার ওসি ইমতিয়াজ কবির বলেন, হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা প্রায় এক হাজার। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে একজন জামায়াত নেতাসহ বিএনপির কয়েকজন সমর্থক রয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুর এলাকায় তিনটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
কাশিমপুর পূজা কমিটি ও পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবার সকালে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১৮ জনকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্য দুজনকে ঘটনার দিন আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছিল। তাঁরা সুস্থ হলে পরে তাঁদেরও রিমান্ড চাওয়া হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষায় দুটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ১০ আসামির মধ্যে ২ জনের পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আজ সোমবার আদালতে রিমান্ডের শুনানি হওয়ার কথা। আসামিরা হচ্ছেন কাওসার আলী ও নাঈম আহমেদ।
তদন্ত কর্মকর্তা শিবগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসাদুজ্জামান জানান, ঘটনার দিন বুধবার রাতেই ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন ভোরে দায়ের হওয়া মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এজাহারনামীয় কাওসার আলী, নাঈম আহমেদসহ অজ্ঞাত ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে হামলার ঘটনায় অজ্ঞাত ২০০-৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আগের হামলা-মামলার সুরাহা হয়নি
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা দেশে এর আগেও ঘটেছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বরিশাল সদর, বানারীপাড়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে।
ওই বছরের ৪ অক্টোবর নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতায় ১৮টি বসতঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছিল। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার কয়েক শ পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গৌরনদী উপজেলার সাধারণ সম্পাদক প্রণব রঞ্জন দত্ত জানান, ওই সময়কার সহিংসতার ঘটনাগুলোয় কোনো মামলা হয়নি। তবে তৎকালীন সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশন সরেজমিন আক্রান্ত মানুষজনের বক্তব্য নিয়েছিল এবং ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছিল। পরে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।
২০০১ সালে নির্বাচন–পরবর্তী অত্যাচার-নির্যাতন ভোলাতেও হয়েছিল। জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক অবিনাশ নন্দী বলেন, ওই সময় কয়েকটি মামলা হয়। নিম্ন-আদালত এসব মামলার রায় দিয়েছেন। তবে কারও শাস্তি হয়েছে কি না, জানা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক পেজে ধর্ম অবমাননার ছবিকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ পল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৩৪টি বসতি ধ্বংস করা হয়। পরের দিন উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি মন্দির ও বিহারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে এক ব্যক্তির করা একটি মামলা আপসমূলে নিষ্পত্তি হয় কয়েক বছর আগে। পুলিশের করা ১৮টি মামলা কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। ঘটনার ৯ বছরে একটি মামলারও বিচারকাজ শেষ হয়নি।
যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ার বাসিন্দারা ব্যাপক সহিংসতার মুখে পড়েছিলেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। ওই দিন সন্ধ্যায় জামায়াত ও বিএনপির আড়াই থেকে তিন শ নেতা-কর্মী মালোপাড়ায় অতর্কিত হামলা চালান। তাঁরা ১০-১৫টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। তাঁরা শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালান।
হামলার প্রায় এক বছর পর যশোর জেলা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক মো. আমিনুল ইসলাম আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ১০০ জন নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের রজরাজ দাস নামে এক যুবকের ফেসবুক পেজ থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেওয়া হয় ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর। ঘটনার পরপরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনার জের ধরে পরদিন নাসিরনগর সদরের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এসব হামলার ঘটনায় আটটি মামলা করা হয়। হামলার ১৩ মাস পর আট মামলার একটিতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এতে হরিপুরের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান ও সদরের ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাশেমসহ ২২৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তাঁদের দুজনকে প্রথমে মনোনয়ন দেয়। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তাঁদের মনোনয়ন বাতিল করে আওয়ামী লীগ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, দেশে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি।’
আশঙ্কা প্রকাশ করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, দেশে ততই এ রকম বিধ্বংসী ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা চলবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই। কুমিল্লার ঘটনার পরপরই ব্যবস্থা নেওয়া হলে অন্যান্য স্থানে এটি ছড়িয়ে পড়া আটকানো যেত।’
Posted ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৮ অক্টোবর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta