কক্সবাংলা ডটকম(২৬ মার্চ) :: ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর ২ লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের ইতিহাসের ৫০ বছরে বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে মুক্তির ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভিযাত্রায় এক মহাসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এ বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’- এর মাহেন্দ্রক্ষণে উদযাপিত হচ্ছে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। এটি সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক আনন্দঘন গৌরবের অনুভূতি। বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় একের পর এক মাইলফলক অর্জন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকে মহিমান্বিত করেছে।
পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে উপমহাদেশের জনগণ পেয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ে দীপ্ত বাঙালির সামনে কোন মরণাস্ত্রই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালি হয়ে ওঠে সংগ্রাম, আন্দোলন আর স্বাধিকারে জাগরিত মহান স্বাধীনতা অর্জনের অনন্য উজ্জ্বলতার প্রতীক। বাঙালি জাতিকে মুক্তির এই মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান ইতিহাসের মহানায়ক, মহাবীর, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ৫৬-এর সংবিধান প্রণয়ন আন্দোলন, ৫৮-এর মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফা ভিত্তিক ৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ খ্যাত কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভূত ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাত্রীতে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকারের অধীনে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।
বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের এই ধারাবাহিক সংগ্রামে জীবনের অধিকাংশ সময় জেলে কাটিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুবার ফাঁসি কাষ্ঠের মুখোমুখি হয়েছেন, অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অসংখ্যবার কারাবরণ করার পরও স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নে আপস করেননি। তিনি বাংলার মানুষকে দিয়েছেন একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, জাতীয় সংগীত, সংবিধান, বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয়।
বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু একই বৃত্তে তিনটি চেতনার ফুল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী-মেহনতী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া, শত যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট-বেদনাকে সহ্য করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক জনতার মুখে হাসি ফোটাতে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধু চিরদিন অম্লান এবং বাংলার জনতার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীনতার মূলমন্ত্র আজও আমাদের প্রেরণা জোগায় নির্ভীক যোদ্ধা হওয়ার, দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদিত রাখার। এর মধ্য দিয়েই বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আসবে প্রকৃত মুক্তি। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ ও ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ উদযাপন উপলক্ষে বাঙালির জাতীয় জীবনে এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ ২০২১ হতে মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে দশ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে ‘মুজিববর্ষ’ ও ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সারা দেশে বছরব্যাপী কর্মসূচি পালনের সাংগঠনিক নির্দেশনা দিয়েছে।
অনেক প্রাপ্তি নিয়েও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবার উদযাপিত হবে অন্যরকমভাবে। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। গত ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে এ অনুষ্ঠান। বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অতিথিরা অংশ নিচ্ছেন। ১৭ মার্চ অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্, ১৯ মার্চ অনুষ্ঠানে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, ২২ মার্চ অনুষ্ঠানে নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি, ২৪ মার্চ অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং উপস্থিত ছিলেন। ২৬ মার্চ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি ১৯৭৩ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২৫ বছর। এর অর্ধেক সময়ও অপেক্ষা করতে হয়নি। স্বাধীনতার ৪০ বছরে ২০১১ সালে এদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৯২৮ ডলারে। গত বছর তা ২০০০ ডলার ছাড়িয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার।
১৯৭৬ সালে অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফালান্ড এবং জন রিচার্ড পারকিনসন ‘বাংলাদেশ :দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, উন্নয়ন প্রত্যয়টি যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সফল হবে। উন্নয়নের ‘টেস্ট কেস’ নামে আলোচনায় আসা দেশটি সব বাধা পেরিয়ে এখন উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদার আসনে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিকরণে ২০১৫ সালে নিম্ন-আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর সম্প্রতি জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার সুপারিশ পেয়েছে। আর্থসামজিক উন্নয়নে অনন্য সব অর্জন নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে বাংলাদেশ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দারিদ্র্য পরিস্থিতি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশটি বৈদেশিক ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। তার আশঙ্কাও ভুল প্রমাণ হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ঋণ পরিশোধে সফল দেশগুলোর অন্যতম। গর্বের বিষয় হলো, কিসিঞ্জারের দেশেরই বড় সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের স্বনামধন্য কলাম লেখক নিকোলাস ক্রিস্টফ সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় জানতে বাংলাদেশের কাছ শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক জনপ্রিয় দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল কয়েকদিন আগে লিখেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ‘তেজি ষাঁড়’। ওয়াশিংটন পোস্টের ভাষ্যকার মাইক বার্ড লিখেছেন, একসময় দক্ষিণ কোরিয়াকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে উদাহরণ দেওয়া হতো। এখন সেই স্থান বাংলাদেশের।
উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঘোষণা করেন, মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়ে তিনি এদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবেন। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও তাদের জীবনমানের উন্নতির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
স্বাধীনতার আগের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এ ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দশকে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩ শতাংশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছায়। করোনার কারণে গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে যায়। অবশ্য পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে করোনার বছরে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি না হয়ে সংকোচন হয়েছে। বাংলাদেশে যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা পৃথিবীতে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের যাত্রা মসৃণ ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও বৈচিত্র্যহীন অর্থনীতি হাতে পায়। আগে থেকেই এ অঞ্চলের অর্থনীতি ছিল কৃষিপ্রধান এবং উৎপাদনশীলতা ছিল খুব কম। শিল্প ও সেবা খাত ছিল খুব অনুন্নত। এর সঙ্গে ছিল দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং দুর্বল অবকাঠামো। এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নাটকীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিভিন্নভাবে জনগণের সামাজিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দারিদ্র্য কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মানুষের আয়ুস্কাল অনেক বেড়েছে। আশির দশকের তুলনায় মাতৃমৃত্যুর হার প্রায় ৪ গুণ এবং শিশু মৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৫ গুণ। এ ছাড়া আরও অনেক দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ৫০ বছরে এসে দেশের এসব অর্জন অবশ্যই গৌরবের।
ফাহমিদা খাতুন অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হলেও তার ফল সমানভাবে বণ্টিত হয়নি। একটি সমতাভিত্তিক ও ন্যায্য সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ রয়ে গেছে। আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে গেছে এবং সমাজের কিছু লোকের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, তাহলে সবাই উন্নয়নের সুফল পান। ফলে আগামীতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের বেশিরভাগ অংশের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনকে আরও অর্থবহ করে তুলতে পারে।
দারিদ্র্য বিমোচন: দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। শত বাধার মুখেও উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সম্মান জানাতে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে বাংলাদেশে আসেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির প্রথম হিসাব করা হয়। ওই সময় দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ভিত্তিতে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের প্রাক্কলিত হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কভিডের কারণে গত বছর দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ বলছে, এর অনেকটাই এখন পুনরুদ্ধার হয়েছে।
অন্যান্য সামাজিক সূচক: নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘ভারত :উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে, এ কথা কেউ ভাবেনি। দেশ স্বাধীনের পর অনেকেই তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেউ কেউ তাকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে খরচের খাতায় ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, এ দেশকে কোনো অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়াই উচিত নয়। কারণ, সে জনসংখ্যা বিস্ম্ফোরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে উঠতে পারবে না। এই গ্রন্থে তুলনামূলক আলোচনায় অমর্ত্য সেন বলেছেন, জীবনমানের নানা সুপ্রচলিত মাপকাঠিতে বাংলাদেশ কেবল ভারতের চেয়ে অনেক ভালো করছে না, অনেকটা এগিয়েও গেছে। অনেক সামাজিক সূচক, যেমন- গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, টিকা দেওয়ার মাত্রা, সন্তান প্রজননের হার এবং এমনকি স্কুলশিক্ষার কিছু মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর। গড় আয়ু এখন ৭২ বছরের বেশি। ২০১৯ সালে প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে ২১ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৭৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০ বছর আগে ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর ( প্রতি হাজার জীবিত শিশুর জন্মে) অনুপাত ছিল ৪ দশমিক ৮, যা ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৬৫-এ নেমেছে। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ২০১৯ সালের হিসাবে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
উন্নয়নের নতুন যাত্রা: বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নতি এবং অর্থনীতির টিকে থাকার সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য মনে করছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ।
গত বছর বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজির অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে বাংলাদেশ। এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কমাতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়। এমডিজি অর্জনের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ।
কাঠামোগত রূপান্তর: বাংলাদেশ ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিপ্রধান থেকে শিল্প ও সেবাপ্রধান অর্থনীতিতে উত্তরণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়ন এনেছে। এখন জিডিপিতে কৃষির অংশ ১৩ শতাংশ। শিল্প এবং সেবার অংশ যথাক্রমে ৩৫ ও ৫২ শতাংশ। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। তৈরি তৈরি পোশাক খাতের বিকাশের মাধ্যমে রপ্তানি খাত এগিয়ে গেছে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
চ্যালেঞ্জ: অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উন্নয়নের নতুন স্তরে পৌঁছে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যে অগ্রাধিকার সুবিধা অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হলে ইইউর বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বর্তমানের শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ইইউর বাইরে অন্যান্য দেশে ২০২৬ সালের পর শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। এ কারণে আগামী ৫ বছরের উত্তরণকালীন সময়ের প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উত্তরণের জন্য এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে শক্তিশালী কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। সার্বিকভাবে আগামী দিনের অগ্রগতির জন্য স্থানীয় বাজার এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতি কমানো, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার এবং সর্বোপরি সম্পদ ও আয়বৈষম্য কমাতে বিশেষ নজর দেওয়ার সুপারিশ উঠে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়।
Posted ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৬ মার্চ ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta