কক্সবাংলা ডটকম(৩ জুন) :: রাজধানীর গুলশানে মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় একমাত্র আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে সংবর্ধনা দিয়েছে অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব)। গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশের পর সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। সমালোচনার মূল কথা একজন আলোচিত আসামিকে কেমন করে সাংবাদিকদের একাংশ এভাবে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় বুধবার দুপুরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আনভীরের বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান ক্র্যাব নেতারা। এ সময় আনভীরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তারা। সৌজন্য সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় দেশের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা ছাড়াও, সায়েম সোবহান আনভীর নারী পাচার রোধ ও মাদকের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকর্মীসহ সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
এসময় ক্র্যাবের সহসভাপতি নিত্য গোপাল তুতুর নেতৃত্বে সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আরিফ, যুগ্ম সম্পাদক হাসান-উজ-জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার আরিফ, দপ্তর সম্পাদক ইসমাঈল হুসাইন ইমু, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রুদ্র মিজান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক রুদ্র রাসেল, কার্যনির্বাহী সদস্য গোলাম সাত্তার রনি, এস এম মিন্টু হোসেন, কাজী জামশেদ নাজিম উপস্থিত ছিলেন।
আইন ও নৈতিকতা
একজন আলোচিত আসামির সঙ্গে সাংবাদিকদের এভাবে দেখা করা কতটুকু নৈতিক ও আইনসম্মত, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, “যেহেতু সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাকে মামলায় গ্রেপ্তার করেনি, সে ক্ষেত্রে তার সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনায় আইনি কোনো বাধা নেই। তবে যারা তাকে (আনভীর) সংবর্ধনা দিচ্ছেন, তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।”
সাংবাদিকদের বক্তব্য
এ নিয়ে ক্র্যাবের সহসভাপতি নিত্য গোপাল তুতুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগরণ অনলাইনের সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের সংগঠনের (ক্র্যাব) সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আরিফের সঙ্গে কথা বলেন।”
আলাউদ্দিন আরিফের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি সংবর্ধনার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমরা কাউকে কোনো সংবর্ধনা দিইনি। আপনি এখানে ভুল করছেন।”
ছবি ও খবর প্রকাশের বিষয়টি উল্লেখ করলে আলাউদ্দিন আরিফ বলেন, “নিউজে সংবর্ধনার কোনো কথা উল্লেখ নেই। আমরা উনার (আনভীর) সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। আমরা কারও সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেই পারি। এটা আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ।”
ক্র্যাব তো অপরাধবিষয়ক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে ক্রীড়া বিষয়ে কেন এই আগ্রহ বা সাক্ষাৎ—এমন প্রশ্নের জবাবে ক্র্যাবের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করি। সায়েম সোবহান একজন ব্যবসায়ী। সেই হিসেবে উনার সঙ্গে আমরা দেখা করেছি।”
হঠাৎ করেই সকলের সামনে
এর আগে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার পর গত ২৯ মে শনিবার রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডসংলগ্ন বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনকালে হঠাৎ করেই জনসমক্ষে আসেন বসুন্ধরা গ্রুপের এই এমডি। সেদিন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের (২০২১-২৪) নির্বাচন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ও করেন তিনি। এ নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকাধীন ‘কালের কণ্ঠ’, ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’, বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর অনলাইনসহ সব কটি মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা একাধিক গণমাধ্যমেও খবরটি প্রকাশিত হয়।
মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার ৩৩ দিনের মাথায় হঠাৎ জনসমক্ষে আসেন মামলার প্রধান আসামি আনভীর। জামিন না নিয়ে গুরুতর একটি মামলার আসামি এমন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ঘটনায় নানা মহলে সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠছে। দেশে থাকলেও তাকে খুঁজে না পাওয়ায়, প্রশ্ন ওঠে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি নিয়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় নিন্দা জানিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, মুনিয়া ‘হত্যার’ ঘটনায় অভিযুক্ত আনভীরকে গ্রেপ্তার করছে না কেন পুলিশ? জামিন না নিয়ে তিনি কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরছেন? টাকা ও ক্ষমতার কাছে কি আইন অসহায়? সামনে পেয়েও গণমাধ্যমকর্মীরা কেন মুনিয়ার মৃত্যুর বিষয় তাকে প্রশ্ন করল না? এমন প্রশ্ন ওঠে সচেতন নাগরিক সমাজে।
মুনিয়ার বড় বোনের ক্ষোভ
চাঞ্চল্যকর এ মামলার এত দিন পরেও মূল আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া ও প্রকাশ্য বের হওয়ার সাহস দেখানোর ঘটনায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুনিয়ার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নিতে ও চুপ থাকার প্রস্তাব দিয়ে প্রতিনিয়ত বাসায় লোক পাঠাচ্ছে আমার বোন মুনিয়ার ঘাতক আনভীর। শর্ত দিচ্ছে সাংবাদিক ও সিসি ক্যামেরাবিহীন জায়গায় গোপন বৈঠকে বসার।”
নুসরাত আরও বলেন, “ওই সব প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচার ও কুৎসা রটানো হচ্ছে। মুনিয়ার হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত ও আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপ ওই সব নানামুখী জঘন্য প্রচারণা করাচ্ছে বলে সহজেই সবাই অনুমান করতে পারে।”
এদিকে সায়েম সোবহান আনভীরের মতো একজন আসামি যদি জামিন না নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান, তাহলে দেশের আইনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ জনগণের কাছে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে যে, বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেশের চলমান আইন সমানভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অপরাধ আরও বাড়তে পারে মনে করছেন সচেতন মহল।
যা ঘটেছিল
গত ২৬ এপ্রিল সোমবার রাজধানীর গুলশানের দুই নম্বর অ্যাভিনিউয়ের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর প্লটের বি/৩ ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার ঝুলন্ত অবস্থায় থাকা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করে মামলা করেন মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান।
মামলার এজাহারে বাদী বলেন, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মোসারাত জাহান মুনিরা। দুই বছর আগে মুনিরা ও আনভীরের মধ্যে পরিচয় হয়। এরপর থেকে তারা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেখা করতেন। তাদের প্রায় সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতেন। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আনভীরকে পাওয়া যাচ্ছে না, গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হয়। তিনি দেশ বা বিদেশে আছেন, সে বিষয়েও কেউ সঠিকভাবে অবগত নন। এমনকি এ বিষয়ে কোনো তথ্যই দিতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এ ঘটনায় আনভীরের কোনো বক্তব্য কোনো গণমাধ্যমই পায়নি।
আনভীরের অবস্থান সম্পর্কে সে সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী দাবি করেন, “আনভীরের দেশত্যাগের বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই।” আসামি আনভীর কোথায় আছেন?—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, “অভিবাসন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আসামি (আনভীর) বাংলাদেশে আছেন। তিনি দুটি (বাংলাদেশ ও স্লোভাকিয়া) পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশত্যাগের কোনো রেকর্ড নেই।”
তবে গত ২৯ এপ্রিল আনভীরের স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের কয়েক সদস্য ভাড়া করা বিমানে দেশ ছেড়েছেন—এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও অভিবাসন পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানান, ফ্লাইটটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা দেয়। এটির গন্তব্য দুবাইয়ের আল মাকতুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
জানা যায়, চার্টার্ড ফ্লাইটের (ভাড়া করা বিমান) সদস্য ছিলেন আটজন। যাত্রী তালিকা অনুযায়ী দেশ ছেড়েছেন সায়েম সোবহান আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, তাদের দুই সন্তান, ছোট ভাই সাফওয়ান সোবহানের স্ত্রী ইয়াশা সোবহান এবং তাদের মেয়ে ও দুই পরিবারের তিনজন গৃহকর্মী ডায়ানা হার্নানডেজ চাকানান্দো, মোহাম্মদ কাদের মীর ও হোসনে আরা খাতুন। এর আগে সায়েম সোবহান আনভীরের ছোট ভাই সাফওয়ান সোবহানও দেশ ছাড়েন।
ক্রীড়া জগতে আনভীর
লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন হয় শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রে। নির্বাচনে ৮৮ জন ভোটার তিন বছরের জন্য ৩০ জন পরিচালক নির্বাচন করেন। ক্লাবের পক্ষ থেকে পাঠানো ফলাফলে জানা গেছে, শেখ রাসেলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন সায়েম সোবহান আনভীর। শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের গঠনতন্ত্র অনুসারে নির্বাচিত ৩০ পরিচালক পর্ষদ সভা করে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং স্পোর্টস ও ফাইন্যান্স ডিরেক্টর মনোনীত করা হয়েছে। যেখানে শীর্ষ পদে আবারও সায়েম সোবহান ফিরে আসছেন, তা প্রায় নিশ্চিত ছিল।
১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয় ২০১৪ সালে। এরপরের বছর ক্লাবটির চেয়ারম্যান হন সায়েম সোবহান। বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় ২০২১-২৪ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন। ৩০টি পরিচালক পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৬০ জন। ভোটার ছিলেন মোট ৯৮ জন, তবে দশজন অনুপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি ভোটার ৩০টি করে ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে চারজনের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় বৈধ ভোট ছিল ৮৪টি। নির্বাচন শেষে ভোট গণনায় দেখা যায়, বৈধ ৮৪ ভোটের ৮৪টিই পেয়েছেন সায়েম সোবহান। সমান ভোট পেয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজাম এবং কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন।
জাগরণ অনলাইন
Posted ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ জুন ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta