কক্সবাংলা ডটকম(৬ জুলাই) :: কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছ। নতুন কমিটি গঠনের পর সংগঠনের কর্মপন্থা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি আজও। আপাতত নেতাকর্মীদের মুক্তি ও মাদ্রাসা খোলার বিষয় নিয়েই ভাবছে সংগঠনটি।
তবে যে কোনো ভাবেই হোক সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চান সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। এরই অংশ হিসাবে সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করেন হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
মন্ত্রীর ধানমণ্ডির বাসার এ বৈঠকে হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী ও সংগঠনের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর একান্ত সহকারী শফিউল আলমও ছিলেন।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বৈঠকে সারা দেশে গ্রেফতার হওয়া সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ এবং অতি সত্বর কওমি মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে এসব ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগিতা চান হেফাজতের আমির। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে সমন্বিত নীতিমালা তৈরির উদ্যোগের বিষয়েও কথা বলেন।
সূত্র জানিয়েছে, আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত হিসাবে নাম আসায় শুরু থেকেই অস্বস্তিতে ছিলেন বাবুনগরী। ১৫ জুলাই আল্লামা শফী হত্যা মামলার বিষয়ে আদালতের পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে বাবুনগরীর পক্ষ থেকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরদিন মঙ্গলবার বেলা ১১টায় হেফাজত আমির ঢাকার খিলগাঁওয়ে মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির বিশিষ্ট মুরুব্বিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম, সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল আওয়াল, প্রচার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সুবহানী ও মাওলানা জহুরুল ইসলাম।
পরে এক বিবৃতিতে হেফাজতের আমির আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, ব্যক্তিগত কোনো কারণে নয়, জাতীয় ও দীনি স্বার্থে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সোমবার বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আমরা আলেম-উলামাদের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ এবং অতি সত্বর কওমি মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের দাবি-দাওয়াগুলো মনোযোগ সহকারে শুনেছেন এবং আমাদের সে বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা আশা করছি সরকার দ্রুত আমাদের দাবিগুলো মেনে নেবেন।
তিনি বলেন, সারা দেশে অসংখ্য নিরীহ আলেম-উলামাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বৈঠকে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়গুলো বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছি। আমরা জানিয়েছি হেফাজতের বিরুদ্ধে কথিত যে সহিংসতার অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। হেফাজতের কোনো নেতাকর্মী সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কিছু দুষ্কৃতকারী হেফাজতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কয়েকটি জায়গায় পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করেছে। তাদের খুঁজে বের করা দরকার।
এর আগে হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী একাধিকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেও জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক এটাই প্রথম।
হেফাজতের দুজন শীর্ষ নেতা বলেন, আমাদের দাবিগুলোর বিষয়ে সরকার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেফাজত নেতাদের আশ্বাস দিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মাদ্রাসা খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। আর নির্দোষ কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। হেফাজতের বিষয়ে সরকারও সুষ্ঠু সমাধান চায়।
হেফাজতের সঙ্গে সরকার কি সমঝোতা করছে?
গতকালকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হেফাজতের নেতাদের বৈঠকের পর নতুন করে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। হেফাজতের সঙ্গে কি সরকার আবার সমঝোতা করছে? সরকার কি আবার একই ভুল পথে হাঁটছে? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে গিয়েছিল সরকার। হেফাজতের একাধিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং চাপের মুখে হেফাজত কমিটি ভেঙে দিয়েছিল।
দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ যখন চাইছিলো যে হেফাজতের যে ২০১৩ এবং গত ডিসেম্বরের মামলাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হোক ঠিক সেইসময় জুনায়েদ বাবুনগরী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এর পরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে কি হেফাজতের সঙ্গে সরকার আবার নতুন করে সমঝোতা করছে? যারা আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী তারা মনে করছেন যে, এ ধরনের সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হলে সেটি হবে আওয়ামী লীগের আরেকটি ভুল।
আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশই ২০১৩ সালে হেফাজতের তাণ্ডবের পর হেফাজতের বিরুদ্ধে একশনের পক্ষে ছিলেন এবং যারা এই ধরনের তাণ্ডব ঘটিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার কঠোর অবস্থানে থাকতে পারেনি। সরকার একটা পর্যায়ে হেফাজতের সাথে সমঝোতা করে এবং আহমদ শফীর সাথে এই সমঝোতার প্রেক্ষাপটে হেফাজত সরকারের পক্ষের একটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং এই সুযোগ নিয়ে হেফাজত পাঠ্যপুস্তক সংশোধনসহ একাধিক দাবিনামা নিয়ে আসে এবং সরকারও তাদের দাবিনামাগুলো অনেক নমনীয়তার সঙ্গে বিচার করেন। আর এখন আবার যখন হেফাজত কোণঠাসা অবস্থায় আছে তখন হেফাজত নেতাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ জনগণের মধ্যে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে। তারা মনে করছে আওয়ামী লীগ কি আবার ভুল পথে হাঁটছে?
আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, ২০১৩ সালে হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের এই সমঝোতাটা সঠিক ছিল না। তখনই যদি হেফাজতের এই উগ্রবাদী, মৌলবাদীদেরকে আইনের আওতায় আনা যেত বিশেষ করে জুনায়েদ বাবুনগরীদেরকে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত তাহলে বাংলাদেশে মৌলবাদী রাজনীতির মূলৎপাটনের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অগ্রগতি হতো।
কিন্তু সেই সময় আওয়ামী লীগকে যারা সমঝোতার পথে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল তারা আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী কিনা এই প্রশ্ন উঠেছে। এখন আবার যখন হেফাজত লন্ডভন্ড, হেফাজতের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে এমনকি হেফাজতের নেতারা স্বীকার করেছেন যে তারা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিলেন সেই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন হেফাজতকে নিয়ে বৈঠক করলেন বা হেফাজতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন এবং হেফাজতই বা কিভাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করে সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিভিন্ন মহল মনে করছে যে, হেফাজত যখনই চাপের মুখে পড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে তখনই তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে এবং সমঝােতা করে যখনই তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তখন তারা সরকারের বিরোধিতা করে। এটিই হেফাজতের বৈশিষ্ট্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা বর্তমান সরকার একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। হেফজত কখনোই যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করবে না তেমনি আওয়ামী লীগকেও সমর্থন করবে না। কাজেই হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার যে চেষ্টা সেটিতে আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
প্রথমত, আওয়ামী লীগের যারা ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক ভোটার আছে তারা আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবেন।
দ্বিতীয়ত, হেফাজত এটার ফলে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারবে এবং উপযুক্ত সময়ে তারা সরকারের ওপর আঘাত হানবে। এরকম পরিস্থিতিতে হেফাজতের প্ররোচনায় পা না দেওয়াই সরকারের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
Posted ১:০৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৭ জুলাই ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta