কক্সবাংলা ডটকম :: বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানা উদ্যোগেও ডলারের লাগাম টানা যাচ্ছে না। পাগলা ঘোড়ার মতোই যেন ছুটছে ডলারের দাম। খোলাবাজারে ডলারের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ১২০ টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না গ্রাহক। দেশে মুদ্রাবাজারের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের এতটা অবমূল্যায়ন আগে হয়নি।
মানি এক্সচেঞ্জে অব্যাহত পরিদর্শন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অভিযান পরিচালনা করছেন। খোলা বাজারের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতেও চলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডলার মজুদ করে মুনাফা করার প্রমাণ পাওয়ায় এরই মধ্যে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের বাজার।
বুধবার দুপুরে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার রেকর্ড ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা আগের দিন মঙ্গলবার বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে ২৫ টাকা বেশিতে খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে মুদ্রাটি।
এর আগে, ২৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ১১২ টাকা। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির পর কয়েক দিন সেখান থেকে কিছুটা কমে ১০৮ টাকায় থিতু হয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে আবার শুরু হয় ঊর্ধ্বগতি। সোমবার খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয় ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
এদিকে বাড়তি দামেও খোলা বাজারে চাহিদামতো ডলার মিলছে না। অর্থাৎ দাম বাড়ার পরও খোলা বাজারে ডলারের সংকট দেখা গেছে। রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন এলাকার বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জার ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।
দেশে খোলা বাজারে প্রথমবারের মতো ডলার ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায় গত ১৭ মে। এরপর আবার কমে আসে। পরে গত ১৭ জুলাই ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে। গত মাসের শেষ দিকে নগদ ডলার ১১২ টাকায় উঠেছিল।
কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলাবাজারে তীব্র সংকট রয়েছে ডলারের। ব্যাংকের মতো খোলাবাজারেও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম।
এই প্রসঙ্গে যমুনা মানি এক্সচেঞ্জের সত্ত্বাধিকারি আনিসুজ্জামান বলেন, বাজারে ডলারের তীব্র সংকট রয়েছে।
কিছু মানুষ ডলার মজুদ করে রেখেছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমরা বেশি দাম দিয়েও ডলার কিনতে পারছি না। ফলে গ্রাহকদেরও চাহিদা মত ডলার সরবরাহ করা যাচ্ছে না। চাহিদা মত গ্রাহকের ডলার দিতে না পারায় বেশ কিছুদিন যাবত অফিস বন্ধ করে রেখেছি।
একদিনের ব্যবধানে এত দাম বাড়ার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে ডলারের দাম উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর দাম বাড়ছেই৷ আর চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ডলার নেই। অনেকে ডলার কিনে ধরে রাখতে চাইছে। অনেকে ডলার কিনতে এলেও সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ।
খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও ডলারের দর অনেক বেড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে।
সর্বশেষ প্রতি ডলার ৯৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলো এই দরে ডলার কিনেছে। গত একবছরে আন্তঃব্যাংক দর বেড়েছে ১২ টাকারও বেশি।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম।
বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রির কারণে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকগুলোতে এখন আমদানির জন্য ১০০ টাকার নিচে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০৭ থেকে ১০৯ টাকায় ডলার কিনে আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সের জন্যও ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে।
এদিকে ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়।
গত সপ্তাহ পর্যন্ত কারসাজির অপরাধে পাঁচ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ৪২টিকে শোকজ করা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করায় ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি গ্রাহকদের ডলারের পরিবর্তে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে যেহেতু ক্যাশ ডলারের সংকট রয়েছে, তাই এসময় স্টুডেন্ট ভিসায় বা চিকিৎসার কাজে যারা বাইরে যাচ্ছেন তারা যদি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে তাহলে তাদের কাজটাও সহজ হবে এবং তারা বেশি লাভবান হবেন। এই বিষয়ে গ্রাহকদেরই ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাত দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা
চলতি আগস্টের প্রথম সাত দিনে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৫৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। বর্তমান বিনিময় হার প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে যার পরিমাণ ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এই অঙ্ক গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। গত বছরের আগস্ট মাসের ৭ দিনে (১ থেকে ৭ আগস্ট) ৩৭ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
আজ বুধবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসের পর আগস্ট মাসেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের পালে হাওয়া লেগেছে। প্রতিদিন এসেছে গড়ে ৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার বা ৭৪৬ কোটি টাকা।
বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এ অর্থের পরিমাণ আরও বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত (১ মাস ৭ দিনে) ২৬৪ কোটি ৭০ লাখ (২.৬৫ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ২২৪ কোটি ৩০ লাখ (২.২৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
ডলার সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা
ডলার সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স নিয়ে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের সঙ্গে ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট স্থাপন বা প্রবাসী রেমিট্যান্স দেশে আনার চুক্তি করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই; শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য জানালেই হবে।
বুধবার (১০ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে।
আগে ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৭ সালের নীতিমালার আওতায় বিদেশ অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউজের সঙ্গে ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট স্থাপনের অনুমোদন প্রদান করত। নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংকগুলো বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশনের পত্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সেখানকার এক্সচেঞ্জ হাউজের সঙ্গে ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট স্থাপন করতে পারবে। সংশ্লিষ্টদের মতে ঘোষিত নীতিমালা প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসনে সহায়তা করবে।