কক্সবাংলা ডটকম(১৬ মার্চ) :: ১৯৮৮ থেকে ২০২১ সাল। কয়েক প্রজন্মের পর আবারও সেনাবিরোধী আন্দোলনে মিয়ানমারের ছাত্রজনতা। গেল ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চিকে হটিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া সেনা সরকারের সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, বিক্ষোভ চলছে দেশজুড়ে। ছাত্রজনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এখন পর্যন্ত নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন ১৮৩ জন, আহত আরও কয়েকশ। আটক করা হয়েছে কয়েক হাজার জনকে। জাতিসংঘ বলছে, নিহতদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ বছরের মধ্যে।
১৯৮৮ সালের পর থেকে দেশটির কয়েক দশকব্যাপী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে অনেক মানুষ প্রাণ হারান। ১৯৮৮ সালের বিক্ষোভে কমপক্ষে ৩ হাজার বিক্ষোভকারী মারা যান, আর ২০০৭ সালে মারা যায় ৩০ জন। দুই ঘটনাতেই হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রেঙ্গুন তথা বার্মা ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত জাপানিদের দখলে ছিল। তাদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয় বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। জাপানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেন জেনারেল অং সান এবং বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত। পরে জাপানিদেরও বিতাড়িত করে বার্মাকে স্বাধীন করা হয়।
তৎকালীন বার্মা ভারতের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে। জেনারেল অং সান স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে জুলাই ১৯৪৭ সালে কথিত বিরোধী আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন।
মূলত বার্মা স্বাধীন হয় অং সানের মৃত্যুর পর। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত বার্মা চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে কিন্তু অং সানের সঙ্গে সম্পাদিত তিন প্রধান উপজাতীয়দের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত আরাকান, যার বর্তমান নাম রাখাইন অঞ্চলও যুক্ত হয়।
১৯৬২ সালের ২ মার্চ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে নেয়। সামরিক জান্তার প্রধান ছিলেন নে উইন। তারা ২৭ মে ১৯৯০ সালে প্রথম নির্বাচন দেয়। এ নির্বাচনে অং সান সু চি এর দল “ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি” ৪৯২ টি আসনের মধ্যে ৩৯২টি আসন পায়। কিন্তু নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়।
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উ নু’র সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। সেসময় তিনি মিয়ানমারের ফেডারেল ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ‘নিজস্ব ঘরানার সমাজতন্ত্র’ চালু করেন। পাশাপাশি তিনি অর্থনীতিকে জাতীয়করণ ও সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। জেনারেল উইন দেশটিতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমও নিষিদ্ধ করেন।
১৯৭৪ সালে দেশটিতে নতুন সংবিধান চালু হয়। সশস্ত্র বাহিনীর হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জেনারেল নে উইন ও অন্যান্য সাবেক সামরিক নেতাদের পরিচালিত পিপলস অ্যাসেম্বলির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮১ সালে জেনারেল নে উইন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সান ইউয়ের কাছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তবে তিনি সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
১৯৮৭ সালে মিয়ানমারে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হলে দেশটির জনগণ সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সেসময় সামরিক সরকারের হাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হন। ১৯৮৮ সালে সরকার দ্য স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) গঠন করে। ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারে সামরিক আইন জারি করা হয়। সেসময় বার্মার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার রাখার পাশাপাশি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপন্থি কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানের মেয়ে ও এনএলডি নেতা অং সান সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ও দীর্ঘদিন পশ্চিমের দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা মিয়ানমার সরকার ১৯৯৫ সালে অং সান সু চিকে ছয় বছর গৃহবন্দি রাখার পর মুক্তি দেয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে সু চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় পায়। ২০১৬ সালের মার্চে হতিন কিয়াও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে দেশটিতে নতুন যুগের সূচনা হয়। প্রায় ৫০ বছরের সেনা আধিপত্যের পর সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে।
প্রথম মুক্ত নির্বাচনের চার বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আবার পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন এনএলডি এবং সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতেছিল ৩৩ আসন।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর দেশটির সামরিক বাহিনী ‘কারচুপি’র অভিযোগ তোলে। সেসময় থেকে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকে সেনা অভ্যুত্থানের গুঞ্জন ওঠে। অবশেষে সেই গুঞ্জন বাস্তবে পরিণত হল আজ।
সেনাবাহিনী কেন ক্ষমতা চায়
অনেক কারণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, শুরু থেকেই সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব এবং তাঁদের পরিবারগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজেদের ধনী হওয়ার কাজে ব্যবহার করে আসছে। ফলে যেকোনো গণতান্ত্রিক পরিবর্তন জেনারেলদের সম্পদের পাহাড়কে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। তাদের মনে ভয়—কোনো নতুন সরকার তাদের দুর্নীতির শাস্তি দিতে পারে, বিদেশি ব্যাংক হিসাবগুলোতে রাখা অর্থের স্থানান্তর দাবি করতে পারে।
এ কারণেই সেনাবাহিনী বিভিন্ন ছদ্মবেশে সব সময় ক্ষমতার বলয়ে থাকতে চেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৬২ সালে বিপ্লবী কাউন্সিল, ১৯৭৪ সালে বার্মা সমাজতান্ত্রিক প্রোগ্রাম পার্টি, ১৯৮৮ সালে রাজ্য আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার কাউন্সিল এবং ১৯৯৭ ও ২০১০ সালে রাজ্য শান্তি ও উন্নয়ন কমিটির মাধ্যমে সামরিক বাহিনী দেশটির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে।
মিয়ানমারের দুটি বড় বাণিজ্য সংস্থা মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) ও মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেড (এমইএইচএল) সামরিক মালিকানাধীন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ২০১১ সালের পর রাজনৈতিক সংস্কারের সময়ে বেসরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বড় বড় ব্যবসার লাইসেন্স, জমি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে নিয়ন্ত্রণ চলে আসে সামরিক নেতাদের হাতে। মিয়ানমারের সামরিক মালিকানাধীন সংস্থা মদ, তামাক ও ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে খনি, কলকারখানা, পর্যটন, ভূমি উন্নয়ন এবং টেলিযোগাযোগ খাত পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসা ও বিনিয়োগে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এই বাণিজ্যিক প্রভাব যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য নতুন এক সাংবিধানিক কৌশল নেয় সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংবিধান কার্যকর হওয়ার পরেও এমন একটি ব্যবস্থা তারা চালু করে, যার মাধ্যমে ভেটো শক্তি ও সংসদীয় আসনের ২৫ শতাংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর ফলে তারা যেকোনো সংস্কারকে বাধা দিতে সক্ষম। এনএলডি নেতা অং সান সু চিকে প্রেসিডেন্ট না করার ক্ষেত্রে ওই ভেটো ক্ষমতাই কাজে লাগানো হয়েছিল।
রোহিঙ্গা বিদ্বেষ
২০১৬ সালে সুচির দল নির্বাচনে জয়ী হয়। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সেনাবাহিনীর চাপে উইন মিন্টকে প্রেসিডেন্ট করা হয়। তবে দেশটির জনগণের একটি অংশের কাছে সেনাবাহিনীর কিছু জনপ্রিয়তাও রয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপরে গণহত্যা চালানোর সময় তাদের এই জনপ্রিয়তার মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যারা একটা সময় এই সেনাবাহিনীর হাতেই নির্যাতিত হয়েছিলেন। ২০১৩ সাল থেকে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য রটাতে থাকে। ফলে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে মিয়ানমারের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠার উত্তম ক্ষেত্র তৈরি হয়। ২০১৬ সালে সভা-সমাবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে মিয়ানমারে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল। ওই বিদ্বেষমূলক পরিবেশ সামরিক বাহিনীকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতার বৈধতা দিতে সহায়তা করেছিল।
রোহিঙ্গা গণহত্যার রাজনৈতিক–অর্থনীতি
রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে গঠিত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে সেনাবাহিনীর গভীরভাবে জড়িয়ে থাকার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছিল। সেনাবাহিনীর বাণিজ্যিক স্বার্থের এই জাল সব সময় জবাবদিহি এবং তদারকির বাইরে থেকেছে বলে জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসা ও মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা মন্টস ফেরার সম্প্রতি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনী তাদের ব্যবসা থেকে অর্থ নিয়ে গণহত্যার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করেছিল। এ জন্য তারা প্রতিরক্ষা বাজেটের বরাদ্দের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।’
সর্বশেষ নির্বাচনের পরে সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয় ঢুকে যায় যে সু চির দল সংবিধানের ওপর ও সংসদে সেনাবাহিনীর আধিপত্য কমিয়ে দিতে পারে। সেটি হলে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের রাখা অর্থ-সম্পদ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই তারা অনেক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করে আবারও রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী হয়তো ভেবেছিল, ভারত ও চীনের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এবং বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই দেশটিতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতাকে তারা কাজে লাগাবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী এবং আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক তাদের বাড়তি সুবিধা দেবে।
মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পরিপূর্ণভাবে চীনের প্রতি অনুরাগী নয়। তারা দীর্ঘকাল ধরে সন্দেহ করে আসছে যে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সশস্ত্র নৃগোষ্ঠী বিদ্রোহীদের সমর্থন করছে চীন। এ ছাড়া নিকট অতীতে মিয়ানমারে চীনা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত পশ্চিমা গোষ্ঠীর সঙ্গে চীনের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ককে মিয়ানমারের জেনারেলরা নিজেদের স্বার্থে এত দিন পর্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করে এসেছে।
এবারও চীনা সমর্থনের হিসাব
গণতন্ত্রীকরণের আগে চীনারা মিয়ানমারের জান্তাকে সমর্থন করেছিল। এবারও এই সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও জনগণের কাছে চীনারা খুব বেশি জনপ্রিয় নয়, তা সত্ত্বেও কৌশলগত কারণে উভয় পক্ষই চীনাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে মিয়ানমারে প্রসারিত করতে সহযোগিতা করেছে। তবে জেনারেলরা চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গেও সম্পর্ক ধরে রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৯ সালে ভারত থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনেছিল মিয়ানমার।
ভূরাজনীতি হয়ে উঠছে জটিল
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত সুরক্ষা ফোরাম বা কোয়াডের সঙ্গেও মিয়ানমারের আলোচনা চলছিল। কিন্তু মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান এই কোয়াড সুরক্ষা আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে।
কোয়াডকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি মঞ্চ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত-জাপানের মধ্যে কৌশল ও লক্ষ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। যেমন মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া, তবে ভারত ও জাপান ততটা আগ্রহী নয়। পরবর্তী সময়ে চীনের পরে মিয়ানমারের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছিল ভারত-জাপান। কারণ, দেশ দুটি মিয়ানমারে চীনা প্রভাব হ্রাস করতে চায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যদি তা রোহিঙ্গা ও গণতন্ত্র বিসর্জনের মাধ্যমেও আসে, তবে আসুক না! সম্ভবত এ কারণেই ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে ভারত ও জাপান উভয় দেশই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের রূপরেখার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন মুলুকে ক্ষমতায় থাকলে নিঃসন্দেহে বলা যেত, জেনারেলরা সহজেই পার পাবে। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তা হতে দিচ্ছেন না। তিনি সম্প্রতি ভারত ও জাপানকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার পক্ষে নিয়ে এসেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাইডেনের ফোনালাপের পর, গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় নেতাই ‘বার্মায় আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবশ্যই বহাল রাখার’ বিষয়ে একমত হয়েছেন। এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে কোয়াড দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ৯০ মিনিটের ফোন-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে জাপানের পক্ষে জানানো হয়েছিল, সব দেশই মনে করে, যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।
বিপদ টের পেয়ে মিয়ানমারের জেনারেলরা সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পরপরই নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বার্তা সংস্থা রয়টার্স মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, সেই প্রচেষ্টা আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
সেনা অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের জেনারেলদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ধারণা করা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিত করার লক্ষ্যেই জেনারেল সাহেবরা অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করে। তাই বলা যায়, মিয়ানমারের এই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক-অর্থনীতি জো বাইডেনের বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পুনর্নির্মাণের অভিযানকে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অবশ্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যেও পিছু হটার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের এই গণতান্ত্রিক যুদ্ধই ঠিক করে দেবে ভবিষ্যতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কর্তৃত্ববাদ ও গণতান্ত্রিক প্রভাবের গতিপথ।
Posted ৭:২৭ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta